Advertisement
E-Paper

কাঁদলেন জেমাইমা! চোখের জলে প্রতিফলিত হল সমালোচনার জবাব, উৎকণ্ঠা থেকে মুক্তি, হারার আগে হাল না ছাড়ার সাহস

দেশের হয়ে সাত বছর খেলার পরেও জেমাইমাকে অঝোরে কাঁদতে দেখে গোটা দুনিয়া। অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে তাই তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘‘গত কয়েক দিন খুব উৎকন্ঠার মধ্যে কেটেছে। রোজ মায়ের কাছে গিয়ে কেঁদেছি।’’

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২৫ ১৪:৪২
cricket

বৃহস্পতিবারের ম্যাচের পর কাঁদছেন জেমাইমা। ছবি: এক্স।

ভারতের ইনিংস শুরু হতে পাঁচ মিনিট বাকি। সবে স্নান সেরে খেতে বসেছেন। হঠাৎ জানানো হল, ব্যাটিং অর্ডারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিন নম্বরে নামতে হবে।

ঘাড়ে ৩৩৯ রানের বোঝা। বিপক্ষে সাত বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বকাপে টানা ১৫টি ম্যাচে অপরাজিত। ঘাবড়ে যাননি জেমাইমা রদ্রিগেজ। বলেছেন, ‘‘দায়িত্ব পাওয়ার পরেই নিজেকে বলেছিলাম, যা-ই হয়ে যাক, আমি শেষ দেখে ছাড়ব। হারার আগে হাল ছাড়ব না।’’

অপরাজিত ১২৭ রানের ইনিংস খেলে দলকে ফাইনালে তুলে যখন শেষ দেখে ছাড়লেন, তখন ক্রিকেটবিশ্ব বাকরুদ্ধ হয়ে দেখল তাঁকে। দেখল জেমাইমার কান্না। দেখল তাঁর চোখের জলের প্রতিটি ফোঁটায় প্রতিফলিত হচ্ছে সমালোচনার জবাব। উৎকণ্ঠা, মানসিক অস্থিরতা থেকে মুক্তি। আর ‘হারার আগে হাল না ছাড়ার’ সাহস।

জেমাইমা ম্যাচের পর যখন বললেন, ‘‘গত কয়েক দিন খুব উৎকন্ঠার মধ্যে কেটেছে। রোজ মায়ের কাছে গিয়ে কেঁদেছি’’, মনে হচ্ছিল কান্না সামলানোর চেষ্টাটুকুও তিনি করছেন না। বরং বুঝিয়ে দিলেন, আজ কেন কাঁদব না, এই চোখের জলই তো আমাকে লড়াই করার, এই ইনিংস খেলার সাহস জুগিয়েছে, রবিবার জোগাবে, ভবিষ্যতেও জোগাবে।

যে খেলাটিকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছেন, সালোচনা-উৎকণ্ঠা সরিয়ে প্রতিদিন তার জন্য মাঠে নামতেন ওই সাহসে ভর করেই। বাবা-মা ছাড়া সেই লড়াইয়ের সাক্ষী আর হাতে গোণা কয়েক জন। তাঁদের কথা ম‍্যাচের পর নিজেই বলেছেন জেমাইমা, ‘‘একা এটা করতে পারিনি। মা, বাবা, কোচ এবং আমার উপর যাঁরা বিশ্বাস রেখেছিলেন, তাঁদের প্রত্যেককে ধন্যবাদ জানাতে চাই।’’ দুই সতীর্থ অরুন্ধতি রেড্ডি এবং স্মৃতি মন্ধানার কথাও বলেছেন, ‘‘পরিবারের মতো আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমার সঙ্গে ওরাও কাঁদত। ওরা না থাকলে এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারতাম না।’’

যাঁদের সারা দিন কোনও কাজ থাকে না, যাঁরা সোশাল মিডিয়ার পেজ খুলে ওঁত পেতে বসে থাকেন, কখন কার ঘাড় মটকাবেন, তাঁরাও হাঁ করে দেখলেন সাহসী কান্না। তাঁরাই নিদান দিয়েছিলেন, ‘রিলস ক্যুইন’, ‘ডান্স ক্যুইন’, ‘গিটার ক্যুইন’ জেমাইমা নিজের ব্যাটিংয়ের চেয়ে বেশি মনোযোগী রিল বানাতে। রবিসন্ধ্যার তিনটে ঘণ্টা রানের রিল বানিয়ে জেমাইমা তাঁদের জবাব দিয়ে দিলেন।

আধুনিক সমাজে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ‘উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট’, ‘উইমেন লিবারালাইজেশন’ ইত্যাদি ভারী ভারী শব্দ নিয়ে প্রায়শই আলোচনা হয়। যত কচকচি বাড়ে, প্রত্যাশার চাপও বাড়ে। এই প্রত্যাশা সমাজের, সমাজমাধ্যমের। উক্ত থাকুক বা অনুক্ত, সাফল্য থাকুক বা ব্যর্থতা— সমাজ নির্ধারণ করে দেয় মহিলাদের কী ভাবে দেখা হবে। বাদ যান না সেই সমাজের আইকনরাও।

বাদ যাননি জেমাইমা। তাই দেশের হয়ে সাত বছর খেলার পরেও তাঁর ব্যক্তিগত শখ-আহ্লাদ নিয়ে কাটাছেঁড়া হয়। এখন একটুও সময় নষ্ট না করে সেই কান্নারই রিল ছড়িয়ে দিয়ে কাঁদছে সমাজ, সমাজমাধ্যম। এটাই হওয়ার ছিল। সেই কান্না তো তাদেরও এগিয়ে চলার সাহস জোগাচ্ছে।

জেমাইমা গিটার বাজাতে, গান গাইতে ভালবাসেন। ব্যাট করতে, রান করতেও ভালবাসেন। প্রথমটা আছে বলেই দ্বিতীয়টা। জীবনে আনন্দ আছে বলেই ৩৩৯ রান তাড়া করে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে দলকে জেতাতে পারেন। কিন্তু সমাজ সেটা ভুলে গিয়েছিল। সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু করেছিল। বিধান দেওয়া হয়েছিল, কোনও খেলোয়াড় যেন হারার পর না হাসেন, জেমাইমা রান না পেলে যেন গান না করেন।

তাই বৃহস্পতিবার শতরান করার পর জেমাইমা উচ্ছ্বাস করেননি, ব্যাটটাও সামান্য তোলেননি। জেমাইমা দলকে জিতিয়েও গান করেননি, শুধু কেঁদেছেন। যাঁরা ট্রোল করে তাঁর গিটারের তারগুলো ছিঁড়ে দিয়েছেন, প্রতিটি রানে তাঁদের জবাব দিয়েছেন। ১৪টা বাউন্ডারিতে মিশিয়ে দিয়েছেন প্রতিবাদের ছোঁয়া। চোখের জল দিয়ে সকলকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, সমাজের আইকন হওয়া আর নিজের সত্ত্বার মধ্যে কোনও সঙ্ঘাত নেই। জেমাইমা রদ্রিগেজ় একই সঙ্গে রান করতে পারেন, রিলও তৈরি করতে পারেন।

শেষ বার ২০১৭ সালে মহিলাদের বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠেছিল ভারত। লর্ডসে হারতে হয়েছিল। মুম্বই বিমানবন্দরে ঝুলন গোস্বামী-মিতালি রাজদের ভারতীয় দল যখন নামে, তাদের দেখতে হাজির হয়েছিল ১৬ বছরের জেমাইমা। আট বছর পর তিনিই বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলবেন। ঝুলন-মিতালিরা মাইক্রোফোন হাতে তাঁরই বন্দনা করবেন। প্রার্থনা করবেন, রান-রিল সঙ্ঘাত যাঁরা বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আরও এক বার প্রতিবাদী হয়ে উঠুক জেমাইমার ব্যাট।

‘সোশ্যাল-মিডিয়া ক্রিকেটার’ জেমাইমার এই বিশ্বকাপের শুরুটা ভাল ছিল না। শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে শূন্য রানে আউট হয়ে গিয়েছিলেন। যখন ভারতের একজন অতিরিক্ত বোলারের দরকার ছিল, তখন হ‍্যারি দিদি (অধিনায়ক হরমনপ্রীত কৌর) তাঁকেই বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন। মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন‍্য এটা যথেষ্ট ছিল। কিন্তু জেমাইমা ভেঙে পড়ার জন্য তৈরি হননি। বুঝেছিলেন, এই বাদ পড়া আর সমাজমাধ‍্যমে ব্রাত‍্য হওয়ার মধ‍্যে বিস্তর ফারাক আছে। বুঝেছিলেন, দলের প্রয়োজনে তাঁকে বাদ পড়তে হয়েছে।

তিনি যে ঠিক বুঝেছিলেন, তাঁর প্রমাণ দিয়েছেন বাদ দেওয়া ওই হ‍্যারিদিদিরাই। তাঁকেই ব‍্যাটিং অর্ডারে তিন নম্বরে তুলে আনা হয়েছিল। আচমকাই। জেমাইমা নিজেই জানিয়েছেন, ‘‘আমি জানতাম না যে, তিন নম্বরে ব্যাট করতে হবে। আমি স্নান করছিলাম। শুধু বলেছিলাম আমাকে জানাতে। মাঠে নামার পাঁচ মিনিট আগে আমাকে বলা হয়েছিল যে, আমি তিন নম্বরে ব্যাট করছি।’’ ২০১৭ সালের বিশ্বকাপে হরমনপ্রীতের ১৭৫ রানের ইনিংস আজও এক চিরন্তন মহাকাব্য। তিন নম্বরে নেমে জেমাইমার বৃহস্পতিবারের মাস্টারপিস এখন তার পাশেই জায়গা করে নিল।

রবিবারও কি কাঁদবেন জেমাইমা? কাঁদুন। তাঁর কান্না আরও সাহসী করে তুলবে ভারতীয় ক্রিকেটকে।

Jemimah Rodrigues Team India Women ICC Women\'s ODI World Cup 2025
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy