Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
দশ উইকেটের কীর্তি স্পর্শ হলেও কে ভাঙবে উনিশ
Jim Laker

Jim Laker: ডনকে ভুল প্রমাণ করে বোলিং-কোহিনুর জয়

এমন অলৌকিক, অবিশ্বাস্য বোলিং পরিসংখ্যান আর কখনও ক্রিকেটে দেখা গিয়েছে? ভবিষ্যতেও কি আর কখনও দেখা যাবে?

অবিশ্বাস্য: লেকারের রেকর্ড আজও এক বিস্ময়।

অবিশ্বাস্য: লেকারের রেকর্ড আজও এক বিস্ময়। —ফাইল চিত্র।

সুমিত ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২১ ০৫:২৪
Share: Save:

৯০ রানে ১৯ উইকেট!

এমন অলৌকিক, অবিশ্বাস্য বোলিং পরিসংখ্যান আর কখনও ক্রিকেটে দেখা গিয়েছে? ভবিষ্যতেও কি আর কখনও দেখা যাবে?

অনিল কুম্বলে বা অজাজ় পটেল ইনিংসে দশ উইকেটের কীর্তি হয়তো স্পর্শ করেছেন। কিন্তু দূরতম কল্পনাতেও কি কেউ ভাবতে পারবে একই টেস্ট ম্যাচে পর-পর দু’বার এমন বোলিং প্রদর্শনী? পঁয়ষট্টি বছর আগের ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ঘটলেও যা আজও জীবন্ত। জিম লেকার মানে যে শুধুই দশে দশ নয়, কুড়িতে উনিশও!

একই টেস্টে উ-উ-উ-নি-নি-নি-শ-শ-শ উইকেট!

কতটা অভাবনীয় এই বোলিং অভিযান? দু’টো উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও দুই ইনিংস মিলিয়ে সর্বোচ্চ উইকেটশিকার সংখ্যা ১৭ পেরোয়নি। আর সেই টেস্টে টনি লকের বোলিং হিসাবের দিকে তাকালে আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে, লেকার কেমন অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। লক-লেকার বিখ্যাত স্পিন জুটির পাশাপাশি ছিলেন দুই যুযুধান প্রতিদ্বন্দ্বীও। দু’জনেই সারে এবং ইংল্যান্ডের হয়ে খেলতেন এবং সারাক্ষণ একে অন্যকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। একেবারেই বনিবনা ছিল না তাঁদের। দু’জনে ছিলেনও একদম বিপরীত প্রকৃতির। লক আক্রমণাত্মক, সোজাসাপ্টা। লেকার চতুর, নিঃশব্দ ঘাতক। অজাজ় পটেল দেখলে নিশ্চয়ই বিশ্বাসই করবেন না, দশ উইকেট নিয়েও কার্যত কোনও উৎসবই করেননি লেকার। আম্পায়ারের কাছ থেকে সোয়েটারটা নিয়ে এমন ভাবে তিনি হাঁটা শুরু করেন যেন আর পাঁচটা ইনিংস শেষের মতো কিছু ঘটিয়েছেন। সতীর্থরা এসে কেউ ঘাড়ে লাফিয়ে ওঠেননি। শুধু হাত মিলিয়ে যান একে একে। বোলিংয়ের এমন কোহিনুর মণি জিতেও এত শান্ত প্রতিক্রিয়া— এক টেস্টে উনিশ উইকেটের মতোই বিরল।

ম্যাঞ্চেস্টারের সেই টেস্টে লেকারের চেয়ে এক ওভার বেশি বল করে ১৮টি উইকেট কম পান লক! দুই স্পিনারের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ের বিধানও নির্মম ভাবে স্থির করে দিয়ে গিয়েছিল ওল্ড ট্র্যাফোর্ড। টেস্ট জিতেও লক এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে, সতীর্থদের জয়ের উৎসব ছেড়ে এসে তাঁকে সান্ত্বনা দিতে হয়। বহু দিন লেকারের ১৯ উইকেটে তড়িৎপৃষ্ট হয়ে ছিলেন তিনি।

লেকার কিন্তু আগেই হদিশ দিয়েছিলেন তাঁর উইকেট শিকারের নেশার। ইংল্যান্ডের প্রতিশ্রুতিমান একটি দলের বিরুদ্ধে ট্রায়াল ম্যাচে পিটার মে, ডেভিড শেপার্ডের মতো ব্যাটাররা ছিলেন, যাঁরা পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্ট খেলবেন। প্রথম পরিবর্ত বোলার হিসেবে এসে ১৪ ওভার বল করে মাত্র দু’টি সিঙ্গলস দিয়ে আটটি উইকেট তুলে নেন লেকার। প্রতিশ্রুতিমান সেই দল শেষ হয়ে যায় মাত্র ২৭ রানে। লেকারের অবিশ্বাস্য বোলিং গড়: ১৪-১২-২-৮!

এর ছয় বছর পরে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের সেই ঐতিহাসিক টেস্ট। কিন্তু তারও আগে আর একটি ম্যাচ হয়। ১৯৫৬-র গ্রীষ্মেই সফরকারী অস্ট্রেলিয়া দল ওভালে সারের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলে। প্রথম দিন দুপুর বারোটার পরে লেকারের হাতে বল তুলে দিলেন অধিনায়ক। এবং, একটানা অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস শেষ না হওয়া পর্যন্ত বল করে গেলেন তিনি। খেলা শেষ হওয়ার আধ ঘণ্টা আগে অস্ট্রেলিয়া অলআউট হওয়ার সময় লেকারের বোলিং হিসাব: ৪৬-১৮-৮৮-১০।

ওভালে সেই দশ উইকেটের পরেও কেউ ভাবেনি, কোনও টেস্ট ম্যাচে লেকার এমন কাণ্ড ঘটিয়ে ছাড়বেন। কিন্তু তিনি— জিম লেকার। নিঃশব্দে, নীরবে চোয়াল শক্ত করে বরাবর বিশ্বাস আঁকড়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়া লেকার মনে করতেন, সম্ভব! এবং, সম্ভব করেই ছেড়েছেন।

লেকারের অমর কীর্তির সেই টেস্ট যদিও প্রবল বিতর্কিত হয়ে রয়ে গিয়েছে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের বাইশ গজকে কেন্দ্র করে। ঠিক যেমন অনিল কুম্বলের কোটলায় দশ উইকেট নেওয়ার নেপথ্যে নাকি ছিল পিচ প্রস্তুতকারকের বার্তা যে, অন্য দিক থেকে কুম্বলেকে আনো। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের প্রধান পিচ প্রস্তুতকারক বার্ট ফ্ল্যাক বহু বছর পরেও আক্রান্ত হয়েছেন অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট মহলের কাছে। সেই সময়ে আর্থার মরিস লেখেন, ‘‘শুধু অস্ট্রেলিয়ার হয়ে নয়, ক্রিকেটের প্রতিনিধি হিসেবে আপত্তি তুলছি এমন পিচ নিয়ে।’’ আবার অন্য মতও ছিল যে, পিচ খারাপ ছিল বুঝলাম কিন্তু তাতেই তো ইংল্যান্ড ৪৫৯ করল!

শোনা যায়, ম্যাচের আগে সবুজ ঘাস ছিল বাইশ গজে। যা দেখে সকলে ভেবেছিল, পেসাররা সাহায্য পাবে। কিন্তু টেস্ট শুরুর সকালে রহস্যজনক ভাবে ঘাস উড়ে যায়। এমনকি স্বয়ং লেকার সন্দিগ্ধ ছিলেন। তত দিনে অবসর নিয়ে ফেলা ডন ব্র্যাডম্যান সংবাদমাধ্যমের হয়ে কাজ করতে ম্যাঞ্চেস্টারে ছিলেন। আগের দিন মাঠে দেখা হতেই লেকার তাঁর কাছে জানতে চান, পিচ নিয়ে কী পূর্বাভাস আপনার? ডনের জবাব, ‘‘আমার তো মনে হয়, মন্থর আর নিষ্প্রাণ উইকেট। প্রচুর রান আছে।’’ কে জানত, ডনের পূর্বাভাসকেও ভুল প্রমাণ করে দিয়ে যাবেন আগের সন্ধ্যার প্রশ্নকর্তা। শুধু তা-ই নয়, শেন ওয়ার্নের সেই মাইক গ্যাটিংকে করা শতাব্দীর সেরা বলের মতোই অবিশ্বাস্য ডেলিভারিতে নীল হার্ভির উইকেট নিয়েছিলেন লেকার। এক হাত ঘুরে যা হার্ভির অফস্টাম্পের উপরে গিয়ে আঘাত করে। হার্ভি পরে বলেন, ‘‘জীবনে এর চেয়ে ভাল বলের মুখে আমি পড়িনি।’’ আর লেকারের সেই বিখ্যাত মন্তব্য, ‘‘নিজের ঢাক নিজে পেটাচ্ছি না। কিন্তু আমি মনে করি, ওই বলটাই সিরিজ় জিতিয়েছিল।’’

ওই একটা বলেই থরহরিকম্প বেঁধে যায় অস্ট্রেলিয়া ড্রেসিংরুমে। এর পরে স্কোরবোর্ড জুড়ে শুধুই জিম লেকার, জিম লেকার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jim Laker Ajaz Patel Anil Kumble
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE