এক-দু’বার নয়, তিন তিন বার!
মরণ-বাঁচন ম্যাচে বিপক্ষের দুই সেরা ক্রিকেটারের ক্যাচ তিন বার ফস্কালে, সেই ম্যাচ জেতার আশা করা যায় না। ঠিক সেটাই হল গুজরাত টাইটান্সের ক্ষেত্রে। ক্রিকেট কতটা নির্মম, তা বুঝতে পারলেন শুভমন গিল। কিছু দিন পরেই তিনি ইংল্যান্ডে উড়ে যাবেন সাদা জার্সিতে ভারতকে নেতৃত্ব দিতে। তবে শুক্রবারের এই হারের ক্ষত তার পরেও দগদগে হয়ে থেকে যাবে। গোটা প্রতিযোগিতায় ভাল খেলেও কী ভাবে শেষ মুহূর্তে এসে ডুবে যেতে হয়, তা দেখাল গুজরাত। এ দিন তিন বার ক্যাচ ফস্কালেন গুজরাত ফিল্ডারেরা। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটাও ফস্কে গেল। আগে ব্যাট করে মুম্বইয়ের তোলা ২২৮/৫-এর জবাবে গুজরাত থেমে গেল ২০৮/৬ রানে।
১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে তাঁর ক্যাচ ফেলার পর দক্ষিণ আফ্রিকার হার্শেল গিবসকে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক স্টিভ ওয় বলেছিলেন, ‘ক্যাচ নয়, তুমি বিশ্বকাপটাই ফেলে দিলে।’ শুক্রবার সেই কথাটাই গুজরাতের দুই ক্রিকেটারকে বলতে পারেন রোহিত। তাঁরা ক্যাচ নন, হাত থেকে ফেলে দিলেন আইপিএলটাই! না হলে যে দলকে লিগ পর্বে অপ্রতিরোধ্য দেখাচ্ছিল তারাই এ ভাবে শেষ দিকে এসে ভেঙে পড়ল কী করে।
দ্বিতীয় ওভারের পঞ্চম বলটা প্রসিদ্ধ কৃষ্ণ করেছিলেন রোহিতের কাঁধের উচ্চতায়। মুম্বইয়ের প্রাক্তন অধিনায়ক একটুও না ভেবে পুল করেন। বল অনেকটা উঁচু হয়ে ডিপ স্কোয়্যার লেগের দিকে এগোতে থাকে। জেরাল্ড কোয়েৎজ়ির সামনে সুযোগ ছিল লোপ্পা ক্যাচ ধরার। বল তাঁর হাতে লাফিয়ে আয়ত্তের বাইরে চলে যায়।
পরের ওভারে একই কাজ করেন কুশল মেন্ডিস। এ বার মহম্মদ সিরাজের বলে উইকেট ছেড়ে চালাতে যান রোহিত। ব্যাটের কানায় লেগে সরাসরি উইকেটকিপার কুশলের দিকে যাচ্ছিল বল। সহজ ক্যাচও গ্লাভসবন্দি করতে পারেননি শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটার। দর্শকাসনে বসা স্ত্রী রিতিকার হাসি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল দিনটা রোহিতের হতে চলেছে।
দু’বার প্রাণ ফিরে পেয়ে রোহিত সুযোগ ছেড়ে দেবেন এমন ক্রিকেটার নন। যত ক্ষণ ক্রিজ়ে ছিলেন, মন ভোলানো সব শট খেলেছেন। সিরাজকে স্ট্রেট ড্রাইভে চার মেরেছেন, সাই কিশোরকে যথেচ্ছ সুইপ করেছেন, রশিদ খানকে এগিয়ে এসে কভারের উপর দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন। সেই ফাঁকে আইপিএলে দ্বিতীয় ব্যাটার (প্রথম বিরাট কোহলি) হিসাবে সাত হাজার রান পূরণও করেছেন। নবম ওভারে রশিদকে যে ভাবে সুইপ মেরে স্কোয়্যারের উপর দিয়ে উড়িয়ে দিলেন তা চোখে লেগে থাকার মতো।
তার পরেও শতরান এল না ব্যাটে। অর্ধশতরানের পরেই রান তোলার গতি খানিকটা কমে গিয়েছিল। প্রসিদ্ধের বলে ৮১ রানে রোহিত ক্যাচ দেন রশিদের হাতে।
আলাদা করে প্রশংসা প্রাপ্য জনি বেয়ারস্টোর। অতীতে পঞ্জাব, হায়দরাবাদের হয়ে খেলার সুবাদে আইপিএলের মঞ্চ অচেনা নয়। কিন্তু প্রতিযোগিতার শেষ পর্বে প্রথম ম্যাচ খেলতে নামা একটু চাপেরই। বেয়ারস্টোকে দেখে অবশ্য বোঝা গেল না। মনে হল শুরু থেকেই আইপিএলে খেলছেন। প্রথম বল থেকে যে ভাবে চালাতে শুরু করলেন ইংরেজ ব্যাটার, তার দিশা খুঁজে পেলেন না গুজরাতের বোলারেরা। প্রসিদ্ধের একটি ওভার থেকে ২৮ রান নেন বেয়ারস্টো।
সূর্যকুমার যাদব (৩৩) এবং তিলক বর্মা (২৫) ক্রিজ়ে নেমে নিজেদের কাজটা করে দিয়েছিলেন। তবে মুম্বই যে দুশোর গণ্ডি পেরিয়েও খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল, তার নেপথ্যে হার্দিক পাণ্ড্য। শেষ ওভারে কোয়েৎজ়িকে তিনটি ছয় না মারলে দুশো পেরিয়েই শেষ হয়ে যায় মুম্বইয়ের ইনিংস।
গুজরাত খেলতে নেমেছিল দলের অন্যতম সফল ব্যাটার জস বাটলারকে ছাড়াই। তার উপর প্রথম ওভারেই শুভমনকে হারায় তারা। ট্রেন্ট বোল্টের মতো বোলার সাধারণত ইনিংসের শুরুর দিকে ভরপুর আত্মবিশ্বাস নিয়ে মাঠে নামেন। সেই বোল্টকে শুরুতেই আড়াআড়ি খেলতে গেলেন শুভমন। বল ব্যাটের নাগাল এড়িয়ে আছড়ে পড়ল প্যাডে। খালি চোখেই বোঝা যাচ্ছিল বল মাঝের স্টাম্পে লাগছে। শুভমন জোর করে ডিআরএস নিলেও সিদ্ধান্ত বদলায়নি।
বাটলারের অভাব পূরণ করার দায়িত্ব দেওয়া হয় মেন্ডিসকে। ক্রিজ়ে নেমে বিশেষ কিছু করতে পারেনি। ১০ বলে ২০ রান করেন। তবে ‘হিট উইকেট’ হয়ে তাঁর আউট হওয়া দিনের অন্যতম সেরা ঘটনা হয়ে থাকল। মিচেল স্যান্টনারের বল হাঁটু মুড়ে ডিপ মিড উইকেটে খেলেছিলেন। বল ব্যাটে ভাল করে লাগার আগেই মেন্ডিসের ডান পা উইকেট ভেঙে দেয়।
দু’উইকেট হারানোর পর যথেষ্ট চাপে পড়েছিল গুজরাত। সেই চাপ কাটিয়ে দেন ওয়াশিংটন সুন্দর এবং সাই সুদর্শন। চলতি আইপিএলে শুভমনের সঙ্গে জুটি বেঁধে অনেক স্মরণীয় ইনিংস খেলেছেন শুভমন। তবে এ দিন চাপের মুখে যে ভাবে মাথা ঠান্ডা রেখে খেললেন তা আলাদা করে নজর কাড়ল। বোঝাল, ইংল্যান্ডগামী দলে তাঁকে নিয়ে ভুল করেননি নির্বাচকেরা। তবে চিন্তাও থাকল তাঁর অনভিজ্ঞতা নিয়ে। ৮০ রানে ব্যাট করার সময় রিচার্ড গ্লিসনকে ও ভাবে স্লগ সুইপ করতে যাওয়া উচিত হয়নি তাঁর। অনায়াসে সোজাসুজি শট খেলে রান নিতে পারতেন। সাহসী হতে গিয়ে উইকেট খোয়াতে হল তাঁকে।
আরও পড়ুন:
প্রশংসা প্রাপ্য ওয়াশিংটনেরও। এমনিতে তাঁর ব্যাটের হাত বেশ ভাল। তবে বিপুল রান তাড়া করতে হওয়ায় আগ্রাসী খেলতে হত। সেই দায়িত্ব ভাল ভাবে পালন করেন ওয়াশিংটন। ম্যাচটা যে শেষ ওভার পর্যন্ত গুজরাত টেনে নিয়ে গেল, তার নেপথ্যে ওয়াশিংটনের অবদান ভুললে চলবে না। জসপ্রীত বুমরাহের ইয়র্কার মাটি ধরাল তাঁকে। আউট করার পর বুমরাহের কঠোর মুখই বলে দিচ্ছিল যে এই জুটি ভাঙতে কতটা মরিয়া ছিলেন তিনি।
জুটি ভাঙার পর গুজরাতের হার যে অবধারিত এটা বোঝার জন্য ক্রিকেটবোদ্ধা হওয়ার দরকার ছিল না। গুজরাতের মিডল অর্ডার চলতি প্রতিযোগিতায় সে ভাবে পরীক্ষাতেই পড়েনি। এ রকম গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে শাহরুখ খান, রাহুল তেওতিয়ারা বৈতরণী পার করে দেবেন এমন ভাবার কোনও কারণ ছিল না। সেটা হয়ওনি।