নিজে টেলিভিশনে ছেলের কাণ্ড দেখেননি সমর মুর্মু। অন্যদের কাছে শোনেন সৌভিকের কীর্তির কথা। তখনই অজানা আশঙ্কায় বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল আরামবাগের কাবলের মধুরপুর আদিবাসী পাড়ার বাসিন্দা গ্রামীণ চিকিৎসকের। পাঁচ-সাত ভাবতে ভাবতেই ফোন পান রাঁচী পুলিশের। ক্রিকেটপাগল ছেলেকে বাড়ি ফেরাতে তিন আত্মীয়কে নিয়ে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির শহরে যাচ্ছেন সমর।
আনন্দবাজার ডট কম-এর সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় সমর খড়গপুরে। ট্রেনে। বেশ দ্রুতগতিতে ছুটছে ট্রেন। কথা ঠিকমতো শোনা যাচ্ছে না। তার মধ্যেই উদ্বিগ্ন বাবা কথা বলতে শুরু করলেন, ‘‘ছেলেটা কী করল বলুন তো। এমন কেউ করে। এটা অপরাধ। এ ভাবে মাঠে ঢুকে ঠিক করেনি। বিরাট কোহলি কত বড় মানুষ। নিরাপত্তার ব্যাপার আছে। সৌভিক অপরাধ করে ফেলল।’’
অপরাধ কেন বলছেন? ‘‘অপরাধ নয়! খেলা দেখবে ঠিক আছে। মাঠে ঢোকার কী দরকার? পা জড়িয়ে ধরার কী দরকার। এটা ঠিক নয়।’’ সৌভিক কবে গিয়েছিল রাঁচী? সমর বললেন, ‘‘শুক্রবার ট্রেনে গিয়েছিল। তার পর এই ঘটনা। রাঁচী পুলিশ ফোন করেছিল। আমি হিন্দি বুঝি না। বলতেও পারি না। পুলিশ কী বলছে, বুঝতেই পারছিলাম না। খুব সমস্যায় পড়ে যাই। আমার ভাগ্নে হিন্দি বলতে, বুঝতে পারে। পরে ও-ই কথা বলেছে পুলিশের সঙ্গে।’’
কী বলল রাঁচী পুলিশ? সমরবাবুর ভাগ্নে সুখলাল মুর্মু বললেন, ‘‘পুলিশ আমাদের রাঁচী যেতে বলেছে। তাই ওখানেই যাচ্ছি আমরা। পুলিশের হেফাজতে রয়েছে ও। পৌঁছোতে মঙ্গলবার সকাল ৬টা মতো বাজবে। রাঁচী পৌঁছে পুলিশকে ফোন করতে হবে। তখন ওরা লোকেশন পাঠাবে। সেইমতো আমাদের যেতে হবে।’’ রবিবারের ঘটনার পর সৌভিকের সঙ্গে কথা হয়েছে? সুখরাম বললেন, ‘‘হ্যাঁ, কথা হয়েছে। রবিবার রাতে হয়েছে। সোমবার দুপুরেও হয়েছে। এমনি কোনও সমস্যা নেই। পুলিশ ওকে ভাল ভাবে রেখেছে। রাতে শোয়ার জন্য কম্বল দিয়েছে। ভাল খাওয়া-দাওয়া দিচ্ছে। মারধরও কিছু করেনি। সে সব চিন্তা আমরা করছি না। সৌভিককে নিয়ে আরামবাগে ফিরতে পারলেই শান্তি।’’
ভাগ্নের কথা শেষ হতেই ফোন নিয়ে নিলেন সমর। টানা বলতে শুরু করলেন, ‘‘ছেলেটা খালি ক্রিকেট ক্রিকেট করে। ছোট থেকেই ওর খেলার ইচ্ছে। আমিই খেলতে দিইনি। আমাদের নিম্নবিত্ত পরিবার। পড়াশোনা না করলে কাজ করবে কী করে? মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে। এখন বিএ দ্বিতীয় বর্ষ। এই কলেজে ওঠার পর থেকে একটু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে। এমনি খারাপ অভ্যাস কিছু নেই। একা একাই খেলা দেখতে চলে যায়। এ বারও একা গিয়েছে। কলকাতায় গিয়ে ইডেন গার্ডেন্সে খেলা দেখেছে। গত বছর তো ১৮ দিন ধরে প্রায় ১৬৫০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে চেন্নাই গিয়েছিল। ধোনির খেলা দেখতে। আগে শুধু ধোনি-ধোনি করত। এখন মাথায় ঢুকেছে কোহলি।’’
সাইকেলে সৌভিকের চেন্নাই যাত্রা। ছবি: সংগৃহীত।
আপনারা কত জন যাচ্ছেন রাঁচীতে? সমর বললেন, ‘‘চার জন যাচ্ছি। অচেনা জায়গা তো। আমি, আমার শালা যাচ্ছি। সঙ্গে ভাগ্নে আর ভাগ্নে-বৌকেও নিয়েছি। ওরা না গেলে কথা বলতে সমস্যা হবে। আমার স্ত্রী আর মেয়ে বাড়িতে আছে। ওরা একটু টেনশন করছে।’’
ট্রেন সিটি বাজাতে বাজাতে ছুটছে। মোবাইলের টাওয়ার যাচ্ছে-আসছে। তার মধ্যেই স্নেহশীল বাবার আফসোস ভেসে এল, ‘‘কী হল, ছেলেটা খেলাটাও পুরো দেখতে পেল না এত দূর থেকে গিয়ে। ও সব করার পরই তো পুলিশ ওকে নিয়ে থানায় চলে যায়।’’ ছেলেকে নিয়ে কবে বাড়ি ফিরতে পারবেন, জানেন না সমর। তবে রাঁচী পুলিশের আশ্বাসে মনে বল পাচ্ছেন। এ যাত্রা বড় বিপদ হবে না বলেই মনে করছেন।