Advertisement
০৩ মে ২০২৪
Sourav Ganguly

সিএবি সভাপতি ভোটে কেন মনোনয়ন পেশ করলেন না সৌরভ? পিছনে কোন অঙ্ক? জল্পনা সব মহলে

একেবারে শেষ মুহূর্তে সিএবি-র সভাপতি পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে এনেছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। এগিয়ে দিয়েছেন দাদা স্নেহাশিসকে। ভোটে লড়ার ঘোষণা করেও শেষে কেন এই সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি?

সিএবি সভাপতি হওয়া থেকে নিজেকে শেষ মুহূর্তে নিজেকে সরিয়ে নিলেন সৌরভ।

সিএবি সভাপতি হওয়া থেকে নিজেকে শেষ মুহূর্তে নিজেকে সরিয়ে নিলেন সৌরভ। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০২২ ১৬:৪৯
Share: Save:

তিনি নিজেই ঘোষণা করেছিলেন, তিনি সিএবি সভাপতি পদে মনোনয়ন জমা দেবেন। তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন, ‘জবাব দিতে’ সিএবি সভাপতি পদে লড়বেন। কিন্তু সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় শেষমেশ বাংলার ক্রিকেট প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদ থেকে দূরেই রইলেন। আপাতদৃষ্টিতে।

রবিবার ছিল সিএবি নির্বাচনে মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিন। তার আগে অবশ্য জানা গিয়েছিল, শনিবারই মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিন। কিন্তু তা পরে এক দিন বাড়ানো হয়। রবিবার বিকেল ৫টার সময় মনোনয়ন পর্ব শেষ হওয়ার কথা ছিল। তার কয়েক মিনিট (যাঁরা মন দিয়ে ঘড়ি দেখছিলেন, তাঁদের দাবি, ৫টা বাজার ঠিক দু’মিনিট) আগে সৌরভ জানিয়ে দেন, তিনি সিএবি সভাপতি পদে মনোনয়ন জমা দিচ্ছেন না। অর্থাৎ, একেবারে শেষ মুহূর্তে।

তার পর থেকেই বাংলার ক্রিকেট প্রশাসন এবং রাজনীতিতে জল্পনা শুরু হয়েছে, কেন সিএবি সভাপতি পদের লড়াইয়ে গেলেন না সৌরভ। তার বিবিধ কারণ শোনা যাচ্ছে। যার পুরোটাই বিভিন্ন জনের ঘনিষ্ঠ সূত্রে প্রাপ্ত। সৌরভ নিজে ওই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে কিছু বলেননি। তাতে ধারণা, জল্পনা এবং বিশ্লেষণ বেড়েছে বই কমেনি।

রবিবার সিএবি-তে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।

রবিবার সিএবি-তে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি পিটিআই

প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, সিএবি সভাপতি পদে না গিয়ে সৌরভ কয়েকটি বিষয় নিশ্চিত করেছেন। প্রথমত, তিনি নিশ্চিত করেছেন, সিএবি-তে নির্বাচন হবে না। ময়দানের একটা অংশ ধারণা, ভোট হলে এবং সেই ভোটে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘নিরপেক্ষ’ থাকলে সৌরভ হেরে যেতে পারতেন। তিনি সেই ‘ঝুঁকি’ নিতে চাননি। কারণ, তিনি ভোটে হেরে গেলে সেটা তাঁর ক্রিকেট প্রশাসক তো বটেই, সফল প্রাক্তন ক্রিকেটার ভাবমূর্তিতেও ধাক্কা দিত। অতীতে মমতা হেরে যাবেন জেনেও সোমেন মিত্রের বিরুদ্ধে বা শশী তারুর মল্লিকার্জুন খড়্গের বিরুদ্ধে দলীয় নির্বাচনে লড়েছিলেন। বা ভাইচুং ভুটিয়া লড়েছিলেন কল্যাণ চৌবের বিরুদ্ধে। সৌরভ সে পথে হাঁটতে চাননি।

কিন্তু এরই পাশাপাশি ময়দানের অন্য একটি অংশ আবার মনে করছে, ভোট হলেও সৌরভই জিততেন। কারণ, বাংলার ক্রিকেটে সৌরভ সবচেয়ে বড় নাম। তাই সকলেই বা অধিকাংশই তাঁর বিরোধিতায় চলে যাবেন, সেটা সম্ভব নয়। বস্তুত, বিরোধী শিবিরের এক সদস্যেরও কথায়, ‘‘সৌরভ বাংলার ক্রিকেটের সবচেয়ে উজ্জ্বল মুখ। উনি দাঁড়ালে আর কারও সম্ভাবনা থাকত না।’’ এই সদস্যের ভোটে লড়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সৌরভ ময়দানে এসে পড়ায় তিনিও শেষ বেলায় বলছিলেন, ভোট না হওয়াই উচিত। যা হওয়ার ‘সর্বসম্মত’ হলেই ভাল।

দ্বিতীয়ত, নিজে সভাপতি না-হয়েও তাঁর ‘নিজস্ব’ প্যানেল নিশ্চিত করিয়ে নিয়েছেন। যে পাঁচ জন সিএবি-র মূল চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করবেন, তাঁরা প্রত্যেকেই সৌরভের ‘লোক’। তাঁদের কারও সঙ্গে নবান্নের যোগাযোগ আছে বলে শোনা যায়নি। অর্থাৎ, সভাপতি না হয়েও, আঙুলের ছাপ না-রেখেও সৌরভই পিছন থেকে সিএবি তথা বাংলার ক্রিকেট প্রশাসন চালাতে পারবেন। ময়দানের রাজনীতিতে মূলস্রোতের রাজনীতির যে ‘অনুপ্রবেশ’ ঘটছিল, সেটা বাদ দিয়ে সৌরভ নিজের ‘টিম’ গুছিয়ে নিয়েছেন।

তৃতীয়ত, সৌরভ প্রমাণ করেছেন, তিনি ‘পদলোভী’ নন। একইসঙ্গে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁর সিএবি-র সভাপতি হওয়া বা না-হওয়া সম্পূর্ণ তাঁর নিজের উপর নির্ভর করে। অন্য কারও ইচ্ছার উপর নয়। কিন্তু তিনি আর আগে এটা নিশ্চিত করে নিয়েছিলেন যে, বিরোধীদের কোনও প্যানেল আসছে না। যখনই সেই বিষয়টি তিনি পাকা করিয়ে নিতে পেরেছেন, তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, নিজে সভাপতি হবেন না।

চতুর্থত, বিজেপি-কে একটা বার্তা পাঠানো। যে, তিনি ‘মমতার লোক’ নন। উল্টে মমতা যথেষ্ট চেষ্টা করা সত্ত্বেও তিনি নিজেকে বৃত্তের বাইরেই রেখে দিয়েছেন। বিসিসিআইয়ের পদ গেলেও, তাঁকে আইসিসি-তে না পাঠালেও তিনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সহায়তায় সিএবি-র সভাপতি হয়ে যাননি। সৌরভ শিবিরের এক সদস্য যাকে বর্ণনা করছেন, ‘একটা জীবন জিইয়ে রাখা’ বলে।

সিএবি-তে সৌরভের দাদা স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায়। রবিবার।

সিএবি-তে সৌরভের দাদা স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায়। রবিবার। ছবি পিটিআই

একটি শিবিরের দাবি, দাদা স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায় সৌরভকে বলেছিলেন, একই পরিবার থেকে দু’জনের সিএবি-তে থাকাটা ঠিক হবে না। তা হলে বিরোধীরা বলার সুযোগ পাবে যে, সিএবি-তে ‘পরিবারতন্ত্র’ চলছে। সে ক্ষেত্রে সৌরভ সভাপতি হলে স্নেহাশিস মনোনয়ন তুলে নেবেন। কারণ, সৌরভ সভাপতি হলে স্নেহাশিস হয়তো সচিব পদেই থেকে যেতেন। কিন্তু এখনই সভাপতি হতে না পারলে নিয়ম অনুযায়ী সভাপতি হতে গেলে স্নেহাশিসকে আরও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হত। সেই কারণে সৌরভ শেষ মুহূর্তে সভাপতি পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। তবে আনুষ্ঠানিক ভাবে কেউই এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি।

বস্তুত, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সিএবি-র রাজনীতি নিয়ে জল্পনা বেড়েছিল। কারণ, সিএবি-র শাসনভার কোন পক্ষের উপর থাকবে, তা নিয়ে টানা-পোড়েন চলছিল। এই পরিস্থিতি তৈরি হত না, যদি সৌরভ বিসিসিআইয়ের সভাপতি পদে দ্বিতীয় মেয়াদে যাওয়ার সুযোগ পেতেন বা তাঁকে আইসিসি-র চেয়ারম্যান করে পাঠানো হত। ঘটনাচক্রে, তার কোনওটিই হয়নি। ফলে সৌরভ আবার এসে পড়েছিলেন সিএবি-র বৃত্তে।

অন্য দিকে, সৌরভ আর রাজ্যের ক্রিকেট প্রশাসনে থাকবেন না ধরে নিয়ে বিরোধী শিবির ক্ষমতা দখলের জন্য তৈরি হচ্ছিল। তাদের পাল্টা প্যানেলও তৈরি ছিল। যার অন্যতম মুখ ছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর ‘আস্থাভাজন’ সাংবাদিক বিশ্ব মজুমদার। যদিও শেষ পর্যন্ত বিশ্ব সিএবি প্রশাসনে এলেন না। সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী ‘সদিচ্ছা’ দেখিয়ে ক্রিকেট প্রশাসনের ভার প্রাক্তন ক্রিকেটার এবং পোড়খাওয়া ক্রিকেটকর্তাদের উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন।

বোর্ডের বার্ষিক সাধারণ সভায় সৌরভ। দু’পাশে জয় শাহ এবং রাজীব শুক্ল।

বোর্ডের বার্ষিক সাধারণ সভায় সৌরভ। দু’পাশে জয় শাহ এবং রাজীব শুক্ল। ছবি পিটিআই

অনেকে অবশ্য বলছেন, যে ভাবে কোনও একটি ক্লাবের প্রশাসন রাজনীতি দিয়ে বা রাজনৈতিক প্রতিনিধিকে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সে ভাবে কোনও বড় সংগঠনের প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান ক্লাবের রাজনীতি মূলস্রোতের রাজনীতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও এআইএফএফের মতো সংগঠনের রাজনীতির ক্ষেত্রে তা করা যায় না। কারণ, সেখানে অনেক কিছু একসঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। পাশাপাশিই, ময়দানের একটা নিজস্ব রাজনীতি আছে। যা মূলস্রোতের রাজনীতি থেকে যেমন ভিন্ন, তেমনই মূলস্রোতের রাজনীতি এবং রাজনীতিকদের সম্পর্কে অনীহা রাখে। দিনের শেষে ময়দানি রাজনীতির কু‌শীলবেরা মূলস্রোতের রাজনীতির লোকজনকে তাঁদের বৃত্তের মধ্যে খুব একটা ঢুকতে দিতে চান না। সিএবি-র ক্ষেত্রেও তেমনই ঘটেছে বলে অনেকে মনে করছেন। এই অংশের মতে, সিএবি-র রাজনীতিতে শেষ দিকে মূলস্রোতের রাজনীতি ঢুকে পড়েছিল।

সৌরভকে বিসিসিআই এবং আইসিসি— দু’টি সংস্থা থেকেই দূরে থাকতে হওয়ায় আসরে নামেন মমতা। তিনি সরাসরিই নিশানা করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং তাঁর পুত্র জয় শাহকে। নাম না করলেও মমতা বলেন, ‘কাউকে একটা’ জায়গা করে দিতে সৌরভকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সামগ্রিক বিজেপি বিরোধিতার সুর চড়িয়ে তিনি আরও বলেন, সৌরভকে বিসিসিআইয়ের সভাপতি পদে রাখা না-হলেও জয় শাহকে সচিব পদে রেখে দেওয়া হয়েছে। আরও এক ধাপ এগিয়ে মমতা সর্বসমক্ষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে অনুরোধ জানান সৌরভকে আইসিসি-তে পাঠানোর জন্য। তৃণমূলও ময়দানে নেমে পড়ে সৌরভ তথা বাঙালির প্রতি ‘অবিচার’-এর প্রতিবাদে।

কিন্তু ঘটনাপ্রবাহে দেখা যায়, আইসিসি চেয়ারম্যান পদে জন্য ভারত থেকে কাউকেই মনোনীত করা হয়নি। যার ফলে জয় শাহের কারণে সৌরভ ‘বঞ্চিত’, সেই তত্ত্বও ধোপে টেকেনি। ফলে ময়দানি রাজনীতি আবার মূলস্রোতের রাজনীতি থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে নিতে পেরেছে।

তাঁর সমর্থক এবং হিতৈষীরা বলছেন, সিএবি-র সভাপতি না-হয়ে সৌরভ একটা বার্তা নির্ভুল ভাবে পাঠাতে পেরেছেন— বাংলার ক্রিকেটে তিনিই এখনও শেষ কথা। কারণ, দিনের শেষে তিনি প্রত্যক্ষ এবং মূলস্রোতের রাজনীতি থেকে সিএবি-কে দূরে রাখতে পেরেছেন। পিছনে থাকলেও রাজ্যের ক্রিকেট প্রশাসনের রাশ নিজের হাতে রাখতে পেরেছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE