Advertisement
E-Paper

ডাফির গোলে মাঘে বসন্ত

ড্যারেল ডাফিকে ঘিরে তখন চলছে বাগান-উৎসব। সবুজ-মেরুন যোদ্ধারা কেউ তাঁকে কোলে তুলছেন, কেউ উঠে পড়ছেন ঘাড়ে। স্কটিশ স্ট্রাইকারের মুখ তখন রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামের আলোর চেয়েও উজ্জ্বল।

রতন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:৪২
হাসছি আমি। শনিবার ডাফিময় মোহনবাগান। -উৎপল সরকার

হাসছি আমি। শনিবার ডাফিময় মোহনবাগান। -উৎপল সরকার

মোহনবাগান ৩ : আইজল ২

(ডাফি পেনাল্টি-সহ ২, জেজে) (জয়েশ, আশুতোষ)

ড্যারেল ডাফিকে ঘিরে তখন চলছে বাগান-উৎসব।

সবুজ-মেরুন যোদ্ধারা কেউ তাঁকে কোলে তুলছেন, কেউ উঠে পড়ছেন ঘাড়ে।

স্কটিশ স্ট্রাইকারের মুখ তখন রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামের আলোর চেয়েও উজ্জ্বল। কে বলে তিনি বৃদ্ধ? কে বলবে তিনি পঁয়ত্রিশ পেরোচ্ছেন? গোয়া বা কলকাতা যেখানেই যে ক্লাবে যান কী ভাবে এত গোল করেন? ম্যাচের পর প্রশ্ন করলে স্কটিশ স্ট্রাইকার হাসেন, ‘‘স্ট্রাইকারের কাজ তো গোল করা। না হলে ক্লাব আমাকে রাখবে কেন?’’ আরও রাঙা হয় তাঁর মুখ।

নিজের কাজ ডাফি করলেন, জেতালেন ম্যাচ। জেজেও তাঁর মনস্কামনা পূর্ণ করলেন নিজের রাজ্যের টিমের বিরুদ্ধে গোল করে। গোল-পার্থক্যে আপাতত লিগ টেবলের এক নম্বর ট্রেভর মর্গ্যানের টিমের চেয়ে এক ধাপ পিছিয়ে থাকলেও বাগানে যেন মাঘেও বসন্তের আগমনী বাজিয়ে দিল। কারণ ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে পয়েন্টের বিচারে একই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে গেল সঞ্জয় বাহিনী।

সনি নর্ডি-হীন বাগানে পলাশ ফুলের রং-ও যেন লেগে গেল এ দিন, তীব্র কাঁটা ছড়ানো রাস্তায় হেঁটেও পাহাড় টপকে যাওয়ার জন্য। আইজলের বিরুদ্ধে বদলা নেওয়ার মানসিকতা না, ইস্টবেঙ্গলকে চাপে ফেলে দেওয়ার জেদ—কোনটা কার্যত হারা ম্যাচ জেতাল কাতসুমিদের? সঞ্জয় সেন বললেন, ‘‘কামব্যাক করার জেদ। ম্যাচটা আমরা হেরেও যেতে পারতাম হয়তো। কিন্তু খারাপ দিনেও যে ফিরে আসা যায় সেটা আমার ছেলেরা আজ দেখিয়ে দিল। এর পরে যারা আমাদের সঙ্গে খেলতে আসবে তাদের মাথায় এটা নিশ্চয়ই ঘুরবে।’’ বাগান কোচের যুক্তিকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এটা ঘটনা যে, জেতার একটা মরিয়া তাগিদ ছিল ডাফিদের। যা ঢেকে দিয়ে গেল বাগানের অসংখ্য ভুল, অনেক ব্যর্থতা। শেহনাজ-বিক্রমদের নিয়ে গড়া মাঝমাঠও তো ক্ষত-বিক্ষত হল পাহাড়ি কাঁটায়। তবে আনাস-কিংশুকদের রক্ষণ ফুটিফাটা করেও শেষ পর্যন্ত হেরে গেল মিজোরামের টিম!

বাগান বনাম পাহাড়ের কোনও দলের লড়াই মানেই ইদানীং একটা জমজমাট ম্যাচ। যা উত্তেজনার বারুদে ঠাসা থাকবেই। এ দিনের সরোবরেও তার দেখা পাওয়া গেল। অভিজ্ঞতা বনাম তারুণ্যের লড়াইতে পাঁচ-পাঁচটা গোল হল, ছবির মতো পাস দেখা গেল বেশ কয়েকটা, ধাক্কাধাক্কি-কড়া ট্যাকল, পেনাল্টি— আর কী ‘সুখাদ্য’ চাই! ম্যাচের ফলও দুলল পেন্ডুলামের মতো। ১-০, ১-১, ২-১, ২-২ এবং ৩-২। ফুটবল মাঠে টেনিসের মতো স্কোর হলে তাঁকে তো হাড্ডাহাড্ডি বলতেই হবে। বলতে হবে রক্তক্ষয়ী।

ফেসবুক খুললেই অসংখ্য বাগান ফ্যান ক্লাবের দেখা পাওয়া যায় এখন। কারও রক্তে, কারও হৃদয়ে প্রিয় টিম সেটাও জানান দেয় কেউ কেউ নানা অ্যাকাউন্ট খুলে। নতুন ট্রেন্ড আবার নিজেকে সবুজ-মেরুন সমর্থক বোঝাতে নিজের নাম আর পদবির মাঝে কোথাও কাতসুমি, কোথাও সনি বা ড্যারেল গুজে দেওয়া। কিন্তু সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এ ক্লাবের জন্য আবেগের নৌকো উথলে ওঠা কথাবার্তা লেখা হলেও সরোবরে তাঁর রেশ কোথায়? শনিবারের সন্ধ্যায় পাহাড়ি যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে উত্তেজক ম্যাচ, দরজায় কড়া নাড়ছে মরসুমের প্রথম ডার্বি, কলম্বো থেকে এএফসি কাপের ম্যাচ জিতে এসেছে টিম— এ রকম আবহেও মাঠে সমর্থকদের ভিড় কোথায়? বারো হাজারি স্টেডিয়ামের অনেকটাই ফাঁকা। মেরেকেটে হাজার চারেক দর্শক। এত আবেগ দেখানোর পরও কেন এই বিমুখতা কে জানে?

তবে যাঁরা এসেছিলেন বা স্টেডিয়ামের দু’কোণে হ্যান্ডমাইক নিয়ে নাগাড়ে গান গেয়ে গেলেন প্রিয় দলকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য, তাঁরা কিন্তু উপভোগের রসদ পেয়ে গিয়েছিলেন খেলার শুরুতেই। ভাল করে গুছিয়ে বসার আগেই। কাতসুমি-ডাফি যুগলবন্দির ফসলে গোল হয়ে গেল শুরুর এক মিনিট পেরোতেই।

হাঁটু মুড়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে গোল করে গেলেন স্কটিশ স্ট্রাইকার। গোলটার পর বাগান কিছুক্ষণের জন্য খেলাটা মুঠোয় পুরেছিল। তখন মনে হচ্ছিল পাহাড়ি হার্ডল হেলায় টপকানোর সেরা মঞ্চটা পেয়ে গিয়েছে সঞ্জয়ের টিম। কিন্তু সেটা যে ভুল তা বোঝা গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। বাগানের মুঠি থেকে বেরিয়ে এল পাহাড়ি টাট্টু ঘোড়ারা। গতি-ই যাঁদের সম্পদ। ইচ্ছেশক্তি যাদের অদম্য করে দেয়। এমনিতে মিজো ফুটবলারদের বুকে বাড়তি একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকেই। সেটা ছিল এই টিমটাতেও। আইজল টিমটায় তিন বিদেশি আর মুম্বই থেকে আসা দুই ফুটবলার ছাড়া সবাই ভূমিপুত্র। তাদের হার না মানা মনোভাব দেখলে চমকে যেতে হয়।

আইএসএলে জয়েস রানে খেলেন চেন্নাইয়ানে। সেখানে টিম-কোচ মাতেরাজ্জি তাঁকে আদর করে ডাকতেন নাকি ‘নেইমার’ বলে। তা সেই ‘নেইমার’-ই বিরতির আগে কিছুক্ষণের জন্য অন্ধকার নামালেন সুখের বাগানে। নিজে গোল করলেন, করালেনও। আইজলকে দু’-দুবার সমতায় ফেরাল তাঁর মগজাস্ত্র। খালিদ জামিলের টিমকে এ দিন দু’বার যুদ্ধে ফেরানোর পিছনে জয়েশ যদি হন প্রধান কুশীলব, তা হলে বাগান ডিফেন্সকে কাঁপিয়ে দেওয়ার পিছনে কারিগর ছিলেন আলফ্রেড নামের এক বিদেশি আর মিজো-পুত্র কিমা-রালতেরা।

সনি নর্ডি ছিলেন না। এডুও চোট পেয়ে বাইরে। এই অবস্থায় বাগান-কোচ নির্ভর করেছিলেন যাঁদের উপর তাঁরা অবশ্য কখনও ডোবালেন, কখনও ভাসালেন। সনি-র বদলে মাঝমাঠকে শক্তিশালী করতে নামা প্রবীর দাশ এমন গোল মিস করলেন যা দেখে পাড়ার ফুটবলাররাও লজ্জা পাবেন। সোদপুরের এই ছেলেটা মাঠে আরও যা যা করলেন তা হাসির খোরাক জোগাল গ্যালারিতে। সেটা আরও বাড়ল তাঁকে ম্যাচ কমশিনার হিরো অব দ্য ম্যাচ বাছায়। তিনি খেলাটা দেখেছেন কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে প্রশংসা পাবেন ডাফি, কাতসুমি এবং জেজে। কাতসুমির জন্যই পেনাল্টিটা পেল বাগান। বাগানের এদিনের সেরা ফুটবলার এই জাপানিই। ডাফি তাঁর আই লিগের ছয় নম্বর গোলটা করলেন ঠান্ডা মাথায়। পেনাল্টি থেকে। এবং তাতেই ফুল ফুটল বাগানে।

ডাফি সর্বোচ্চ স্কোরার হয়ে গেলেন আই লিগে। নিজের চার নম্বর গোলটা করে ফেললেন জেজেও। জোড়া স্ট্রাইকারের ভাঁড়ারে দশ গোল। এটা আই লিগের কোনও ক্লাবে নেই।

ডাফি-জেজের গোল করার প্রতিযোগিতা ডার্বির আগে প্লাজা-বুকেনিয়াদের রক্তচাপ তাই বাড়াবেই। সন্দেহ নেই।

মোহনবাগান: দেবজিৎ, প্রীতম, কিংশুক (বিক্রমজিৎ জুনিয়র), আনাস, শুভাশিস, প্রবীর, বিক্রমজিৎ (সৌভিক), শেহনাজ (প্রণয়), কাতসুমি, জেজে, ডাফি।

Darryl Duffy Mohun Bagan Aizawl FC I League
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy