Advertisement
E-Paper

ইতিহাসে ভল্ট বাঙালির

ছোট্টখাট্টো চেহারার মেয়েটা পারল! পাড়ার আর পাঁচটা সাধারণ স্কুলছাত্রীর মতো দেখতে মেয়েটা ইতিহাস গড়ে ফেলল! বাঙালি তা হলে পারে বিশ্বের সর্বোচ্চ মঞ্চে চমকে দিতে, তা-ও আবার বঙ্গ কোচের হাত ধরে!

রতন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৬ ০৩:২৩
রিও দে জেনেইরোর অলিম্পিক্স আসরে দীপা কর্মকার। রবিবার। ছবি: পিটিআই

রিও দে জেনেইরোর অলিম্পিক্স আসরে দীপা কর্মকার। রবিবার। ছবি: পিটিআই

ছোট্টখাট্টো চেহারার মেয়েটা পারল! পাড়ার আর পাঁচটা সাধারণ স্কুলছাত্রীর মতো দেখতে মেয়েটা ইতিহাস গড়ে ফেলল! বাঙালি তা হলে পারে বিশ্বের সর্বোচ্চ মঞ্চে চমকে দিতে, তা-ও আবার বঙ্গ কোচের হাত ধরে!

বিস্ময়ের ঘোরে দীপা কর্মকারকে দেখছিলাম বারবার। অলিম্পিক্সের বিশাল জিমন্যাস্টিক্স ভেলোড্রোমের অ্যাড্রেস সিস্টেেম তখন ঘোষণা হচ্ছে, ‘‘কর্মকার প্রথম ভারতীয় জিমন্যাস্ট যিনি অলিম্পিক্সে ফাইনাল রাউন্ডে উঠেছেন।’’ দীপার উচ্ছ্বসিত মুখটা এক বার ঝকঝক করে উঠল। আবার পরমুহূর্তেই মুছে গেল। ‘‘সবে প্রথম হার্ডলটা পেরোলাম। এ বার তো পদকের লড়াই। কাজটা আরও কঠিন। তবে আমি কিন্তু শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব। এখন থেকে অলিম্পিক্স পদকই লক্ষ্য আমার।’’ বোঝা গেল, পরের লক্ষ্য কতটা দৃঢ় ভাবে স্থির করে ফেলেছেন।

দেশের স্বাধীনতা দিবসের আগের রাতে ভল্টের ফাইনাল রাউন্ডের লড়াই দীপার। সাত দিন আগে থেকেই চূড়ান্ত যুদ্ধের মানসিক প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। এত দিন ‘পদক’ শব্দটা শুনলেই ছিটকে সরে যেতেন। বারবার বলেছেন, ‘‘আগে তো ফাইনালে উঠি।’’ আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিক্সের ভল্ট ইভেন্টে অষ্টম প্রতিযোগী হিসেবে ফাইনালে ওঠার পর সেই দীপার গলাতেই এখন পদকের কথা। তাঁর কোচ বিশ্বেশ্বর নন্দীও বলে দিলেন, ‘‘যে আট জন ফাইনালে উঠেছে তারা সকলেই পদক পেতে পারে। সে দিন আবার তো সব নতুন ভাবে শুরু হবে। সকলেই পদকের জন্য ঝাঁপাবে। তাদের মধ্যে দীপাও আছে।’’

বাহান্ন বছর পরে অলিম্পিক্সে প্রথম ভারতীয় জিমন্যাস্ট হিসেবে নামলেন ত্রিপুরার বঙ্গকন্যা। দীপার সবচেয়ে পছন্দের ভল্ট ইভেন্ট শুরুর সময় দেখছিলাম তাঁর চোখমুখ। ছাত্রীর লঞ্চিং প্যাডটা ঠিক করে দিলেন গুরু। বিশ্বেশ্বরকে দীপা ইশারা করলেন, সেটা আর একটু ডান দিকে রাখতে। গেঞ্জির বুকের কাছে আঁকা জাতীয় পতাকাটা এক বার ছুঁলেন, চোখ বন্ধ করলেন এক বার, তার পর শুরু করলেন সেই দৌড়টা। যেটা জেদ আর একাগ্রতার নিশান হয়ে আছড়ে পড়ল সঠিক লক্ষ্যে। প্রোদুনোভা ভল্ট তাঁর ‘পেটেন্ট’। প্রথমটা পারফেক্ট হল। কোচ পিঠে হাত দিয়ে শাবাশ বললেন। হাসলেন দীপা।

এ বার পরেরটা। সেই একই ভঙ্গি। তবে ল্যান্ডিংয়ের সময় পা সামান্য নড়ে গেল। তবুও তো জীবনের সেরা স্কোর। ১৪.৮৫০। তার পরেও ফাইনালে ওঠা নিয়ে দীপা সামান্য সংশয়ে ছিলেন। কারণ কোয়ালিফাইংয়ের ৯৮ প্রতিযোগীর মধ্যে তখনও ৫৮ জনের নামা বাকি। ‘‘বলতে পারেন তখন আমি পঞ্চাশ-পঞ্চাশ ধরে রেখেছিলাম। তবে আমার বিশ্বাস ছিল, এত দিনের পরিশ্রম বৃথা যাবে না,’’ বলছিলেন দীপা। ভারতে তখন সোমবার ভোররাত।

আশেপাশে তো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, অলিম্পিক্স চ্যাম্পিয়ন, ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন! ভয় লাগছিল না? প্রশ্ন শুনে মাথা নাড়েন সবুজ-সাদা ট্রাউজার্স, পনিটেলের দীপা। ‘‘দেখুন, এটা ঠিক যে কখনও এত দর্শকের সামনে নামিনি। এটা একটা আলাদা অভিজ্ঞতা। রিওতেই যখন অলিম্পিক্সে কোয়ালিফাই করতে এসেছিলাম তখন মেরেকেটে দশ-বারো জন দর্শক ছিল গ্যালারিতে। আজ সেখানে একেবারে ভর্তি। এত চিৎকার হচ্ছিল, ফ্লোর এক্সারসাইজের সময় কিছু শুনতেই পাচ্ছিলাম না।’’ সে কারণেই কি পা পিছলে গিয়েছিল? ‘‘না না, ও রকম হয়। সব জিমন্যাস্টেরই হয়,’’ সাফ বলেন দীপা। আর অলিম্পিক্সে নামার চাপ? ‘‘ভয় পাব কেন? আমার স্যার যা শিখিয়েছেন সেটা করতে পারলেই তো সফল হবো, জানতামই। আর সেটাই করেছি।’’

দীপার কথাগুলো যে কতটা হৃদয় থেকে বলা, বুঝতে কষ্ট হয় না। যে মঞ্চে জিতু রাই, হিনা সিধু, দীপিকা কুমারী, সানিয়া মির্জা, লিয়েন্ডার পেজরা ব্যর্থ, সেখানে জীবনের সেরা স্কোর করে দীপা ফাইনালে। বিশ্ব জিমন্যাস্টিক্সে ভারতীয় মেয়ের আলোড়ন ফেলে দেওয়া। আলোড়নই তো! ইভেন্টের পরে মিক্সড জোনে গ্রেট ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনামের জিমন্যাস্টদের নিয়ে বিশ্ব মিডিয়ার যা আগ্রহ ছিল, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ছিল দীপাকে নিয়ে। আধ ঘণ্টা ধরে ইংরেজি, হিন্দি, বাংলায় লাগাতার ইন্টারভিউ দিতে হল। ক্লান্ত দীপা এক সময় বলেই ফেললেন, ‘‘এ বার ছেড়ে দিন।’’ কিন্তু কে শোনে কার কথা? এক বৃদ্ধা মার্কিন সাংবাদিক দীপাকে জড়িয়েই ধরলেন। ‘‘তুমি অসাধারণ। কত ক্ষণ প্রোদুনোভা প্র্যাকটিস করো?’’ দীপা বললেন, ‘‘রোজ আট ঘণ্টা।’’

আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিক্সে চারটে ইভেন্ট। ভল্ট ছাড়া আনইভেন বার, ব্যালান্স বিম এবং ফ্লোর এক্সারসাইজ। ভল্ট বাদে বাকি তিনটেতে ভাল করতে পারেননি দীপা। ওভারঅল স্কোরেও অনেক নীচে। তবে দীপার একটা সুবিধেও হয়ে গিয়েছিল। কোয়ালিফাইংয়ে তাঁর প্রথম ইভেন্টই ছিল ভল্ট। ফলে তাজা শরীরে নিজের সেরা অস্ত্রের ব্যবহার করতে পেরেছেন এখনই ভারতের জিমন্যাস্টিক্সে আইকন হয়ে ওঠা বাঙালি মেয়ে।

দীপার জয়যাত্রায় ভগীরথ তাঁর কোচ বিশ্বেশ্বর নন্দী। ত্রিপুরার মেয়েটিকে একেবারে ছোটবেলা থেকে গড়েপিটে তুলে এনেছেন অলিম্পিক্স মঞ্চে। বিদেশে ট্রেনিং করার সুযোগ থাকলেও দীপাকে নিয়ে যাননি। দিল্লিতে সাই সেন্টারের পরিকাঠামোই ব্যবহার করেছেন। দীপাও তাঁর কোচ ছাড়া এক পা নড়েন না। কোচ যা বলেন, অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। দু’মাস মোবাইল ফোন নিজের কাছে জমা রাখতে চেয়েছিলেন কোচ। দীপা তা-ই করেছেন।

অলিম্পিক্স জিমন্যাস্টিক্সের নিয়ম, যে দেশের প্রতিযোগী বেশি তাঁরা দল হিসেবে ইভেন্টে নামেন। আর এক বা দু’জন হলে তাঁরা মিক্সড টিমে পড়েন। দীপা পড়েছিলেন মিক্সড টিমে। এখানে ভারতের হকি ম্যাচে বা জিতুদের শ্যুটিংয়ের সময় তেরঙ্গা হাতে বেশ কিছু ভারতীয় দর্শককে দেখেছিলাম। দীপার ইতিহাস গড়ার দিন কিন্তু একটিও জাতীয় পতাকা ছিল না স্টেডিয়ামে। দীপা আর তাঁর কোচকে যেন লাগছিল একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা। দীপা একটা করে ইভেন্ট শেষ করছিলেন আর বিশ্বেশ্বর এগিয়ে এসে তাঁকে অভয় দিচ্ছিলেন পিঠ চাপড়ে। পরে ভদ্রলোক বললেন, ‘‘ওকে কোনও টেনশন নিতে দিইনি কখনও। সব টেনশন আমিই নিই। আজও তাই করেছি।’’ আগরতলার এক মফস্সল শহরের এই বাঙালি কোচের কথা শুনলে মনে হয়, এ তো ব্যাগ কাঁধে নিত্য ট্রেনযাত্রীর মতো নেহাতই সাদামাঠা কেউ। সারাক্ষণ যিনি তাঁর মেয়ের জন্য প্রাণপাত করে চলেছেন।

অলিম্পিক্সে পদকের জন্য আমাদের দেশের অন্য সব খেলায় এখন বিদেশি কোচের ছড়াছড়ি। দীপা অলিম্পিক্সে পদক পাবেন কি না সেটা সময় বলবে। তবে এক জন সাধারণ বাঙালি মেয়ে তাঁর সাদাসিধে বাঙালি কোচের হাত ধরে রিওতে এখনই যে ইতিহাস গড়ে দেখালেন, তা ভারতীয় খেলাধুলোয় সর্বকালের গৌরবের অধ্যায় হয়ে থেকে যাবে!

Rio Olympics Dipa Karmakar Vault
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy