Advertisement
২৩ মার্চ ২০২৩
গাওস্করকেই সর্বকালের সেরা বাছলেন স্বর্ণযুগের স্পিন-ত্রয়ী

নারিন ভস্ম, দুসরা মানেই চাকিং বেদীর কাছে

ওহে তুমি, বল ছাড়ার সময় কনুইটা খেয়াল করো একটু। পরিষ্কার ছুড়ছ! ব্যাপারটা কী তোমাদের? মিডল স্টাম্পে একজনও তো রাখতে পারছ না দেখছি। ব্যাটসম্যান থাকলে কী করবে? আনসার মি! কেন পারছ না জানো? মন টার্গেটে থাকছে না বলে। কী বললে, গা গুলোচ্ছে? আর দৌড়োতে পারছ না? জানো, তোমার বয়সে সচিন তেন্ডুলকর ইন্ডিয়া খেলেছে! পঙ্কজ গুপ্ত ইন্ডোরে বুধবার ভরদুপুরে উনি কে? এত জোরে চিত্‌কার করছেন?

বেদীর পাঠশালা।

বেদীর পাঠশালা।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৫২
Share: Save:

ওহে তুমি, বল ছাড়ার সময় কনুইটা খেয়াল করো একটু। পরিষ্কার ছুড়ছ!

Advertisement

ব্যাপারটা কী তোমাদের? মিডল স্টাম্পে একজনও তো রাখতে পারছ না দেখছি। ব্যাটসম্যান থাকলে কী করবে? আনসার মি! কেন পারছ না জানো? মন টার্গেটে থাকছে না বলে।

কী বললে, গা গুলোচ্ছে? আর দৌড়োতে পারছ না? জানো, তোমার বয়সে সচিন তেন্ডুলকর ইন্ডিয়া খেলেছে!

পঙ্কজ গুপ্ত ইন্ডোরে বুধবার ভরদুপুরে উনি কে? এত জোরে চিত্‌কার করছেন?

Advertisement

চেনা খুব সহজ। উনি— বিষেণ সিংহ বেদী। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে চাকারদের তুলোধোনা করে এখন বঙ্গ স্পিনারদের সংশোধনে বেরিয়ে পড়েছেন, এবং কনুই এক ডিগ্রিও ভেঙেছ কী তুমি গেলে!

বেদীর কড়া ডোজের ধমক খেয়ে বঙ্গ ক্রিকেটের অনূর্ধ্ব স্পিনাররা দেখা গেল, ভয়ে মুখ খুলতে পারছে না। স্বাভাবিক। লাঞ্চ ঠান্ডা হচ্ছে, তবু কড়া ‘হেডস্যরের’ ওঠার নাম নেই। সিএবির কিছু আধা কর্তা কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করে উগ্র মেজাজ দেখে সরে পড়লেন। বেদীর শর্তই তো ছিল, উঠতি স্পিনারদের সঙ্গে সময় কাটাবেন। গ্রিপ দেখিয়ে দেবেন। দেখালেন। অসুবিধে হলে ফোন করতে বললেন। টেকনিক্যাল কচকচির মধ্যে না গিয়ে ইচ্ছাশক্তি আর খাটুনি বাড়াতে বললেন। আর সিএবি ইন্ডোরে স্পিনার কনুই ভাঙলে যা-যা উড়ে এল, নেহাতই হাইলাইট্স।

পূর্ণাঙ্গ সিনেমাটা তো হয়ে গেল তার ঘণ্টাখানেক আগে, সিএবি-র টক শোয়ে। স্পিন-স্বর্ণযুগের দুই অবিচ্ছেদ্য বন্ধু ‘প্রাস’ আর ‘চন্দ্রা’কে পাশে বসিয়ে। যেখানে কাঠগড়ায় বিশ্বব্যাপী চাকার-কুল। আর বিচারক তিনি— বিষেণ সিংহ বেদী। শিরোনাম-সম সব ‘রায়’, যা সূদুর ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত কম্পন ধরিয়ে দিতে পারে!

দুর্ভাগ্য সুনীল নারিনের। কেকেআর স্পিনার সন্দেহজনক অ্যাকশনের আওতায় পড়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ টি-টোয়েন্টি ফাইনাল খেলতে পারেননি। নারিন সত্যিই চাকার? বেদীর সিংহ-বিক্রম, “ও তো পরিষ্কার চাকার। কেকেআরের এটা নিয়ে চিত্‌কার করার কারণই নেই। আর আমি বুঝতেও পারছি না এত সন্দেহ কীসের? লোকে কেন ভাবছে, ওকে অহেতুক ভুগতে হল!”

প্রসন্ন ততক্ষণে মনে করিয়ে দিয়েছেন, আইসিসি-র পনেরো ডিগ্রি পর্যন্ত কনুই ভাঙার নিয়ম অর্থহীন। “০.১ ডিগ্রি ভাঙাও বেআইনি,” এবং ‘প্রাসে’র কথাবার্তা শুনে আবার বিষেণ, “সবচেয়ে অবাক লাগে ভেবে, এটা নিয়ে মিডিয়া চুপ। আম্পায়াররা চুপ। কেউ কিছু বলছে না। এই নিয়ম চালু করতে কুড়িটা বছর লেগে গেল আইসিসির। আরে, এ সব দুসরা, তিসরা চাক না করে সম্ভব নয়। সব রাবিশ! দুসরা-তিসরা উপমহাদেশেই হয়। অস্ট্রেলিয়ার স্পিনারকে দেখেছেন দুসরা করতে? প্রথমে এটা ছিল টেকনিক্যাল সমস্যা, পরে দাঁড়িয়েছে পলিটিক্যাল প্রবলেম। মনে রাখতে হবে, এশিয়ার ভোট কিন্তু চারটে! ম্যাচ গড়াপেটারও এশিয়ায় জন্ম। সেটা কী ভাবে হয় বলতে পারব না। কিন্তু চাকিং তো সবার নাকের ডগায় ঘটছে!”

নারিন ভস্ম। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নিস্তার পেলেন না। ক্লাবহাউসে তাঁর লর্ডসে জামা ওড়ানোর ছবি মোটেও পছন্দ হয়নি বেদীর। বলেও দিলেন, ক্রিকেটের আভিজাত্যের সঙ্গে এ সব যায় না। টাইগার এমন প্ররোচনায় জীবনে পা দেননি। সচিন তেন্ডুলকর— তাঁকেও ভারতের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যানের শিরোপা দিলেন না বেদী। সেটা তুলে দিলেন ‘অরিজিন্যাল লিটল মাস্টারের’ মাথায়, যাঁর নাম সুনীল মনোহর গাওস্কর।

শেষোক্ত মন্তব্য শুনে উপস্থিত কারও কারও মনে হল, এর মাহাত্ম্যও কম নয়। শোনা যায়, বেদীর সঙ্গে গাওস্করের বাক্যালাপ বন্ধ বহু দিন। সেখানে সচিনের আগে গাওস্করকে বসিয়ে গেলেন বেদী। বলে দিলেন, “মাঝে মাঝে আমি বুঝতে পারি না ওর জন্ম কোথায়? শিবাজি পার্কে, না ইংল্যান্ডে? একটা ছোট আর্মগার্ড নিয়ে কী ভাবে খেলত, দেখে তাজ্জব হয়ে যেতাম। কী অদ্ভুত কনফিডেন্স!” বিজয় মঞ্জরেকর ভারতের সর্বকালের সেরা ওপেনার হিসেবে বিজয় মার্চেন্টকে বেছে নেওয়ায় বেদী এক বার তর্ক জুড়ে দিয়েছিলেন। শুনিয়েছিলেন, দেশের সর্বকালের সেরা ওপেনার গাওস্করই। ভারতের সবচেয়ে কমপ্লিট ব্যাটসম্যান।

একা বেদী তো নন, ওঁরা তিন জনই গাওস্করকে সেরার শিরোপা দিয়ে গেলেন। ছিয়াত্তরে ওয়েস্ট ইন্ডিজে চারশো তাড়া করতে গিয়ে গাওস্করের সেঞ্চুরির কথা বলা হল। এরাপল্লি প্রসন্ন এবং ভগবত্‌ চন্দ্রশেখরেরও স্বীকারোক্তি, গাওস্কর সর্বকালীন এক নম্বর। চন্দ্রর যুক্তি খুব সহজ, গাওস্কর হেলমেট-বিহীন থেকে লিলি-হোল্ডিং সামলেছেন। ফাস্ট বোলারদের মহড়া তাঁকে নিতে হয়েছে নেটে প্রসন্ন-বেদী-চন্দ্রকে খেলে! পটৌডির প্রিয় ‘প্রাস’ সচিনের একটা খুঁত ধরিয়ে দিলেন। বললেন, “বাউন্সার খেলার সময় সচিন চোখ বুজে ফেলত। যেটা গ্রেটের লক্ষণ নয়।” সঙ্গে অদ্ভুত সুন্দর একটা বিশ্লেষণ। সচিন বোলারকে একেবারে থেঁতলে দেবে। বোলারকে মারবে নির্দয় ভাবে। গাওস্কর সেখানে একেবারে নয়, বোলারকে ধীরে ধীরে ঠেলে দেবে মৃত্যুর দিকে!

এত দিন যা যা অনুষ্ঠান হয়েছে সিএবিতে, অধিকাংশে আধিপত্য দেখিয়েছে প্রাক্তনদের ঘিরে নস্ট্যালজিয়া। বুধবারের অনুষ্ঠান সেখানে যেমন নস্ট্যালজিয়া দিয়েছে, তেমন ভারতীয় ক্রিকেটের চিরন্তন তুলনাকে মঞ্চে টেনে এনেছে, আবার সঞ্চালক গৌতম ভট্টাচার্য-র চোখা প্রশ্নে বিতর্কের অগ্নিবাণও ছিটকে বেরিয়েছে মুহুর্মুহু।

’৭৫-এর ইডেন টেস্টের সময় টাইগার পটৌডি যে এক পেগ হাতে নিয়ে প্রসন্নর ঘরে ঢুকে সোজা “প্রাস, কী হবে কাল” জিজ্ঞেস করেছিলেন, এ দিনের আগে ক’জন জানত? ওয়েস্ট ইন্ডিজের তখন আর ১৭০-৮০ দরকার, সাত উইকেট মতো হাতে। অধিনায়কের প্রশ্নে একটু থতমত খেয়ে প্রসন্ন বলে ফেলেন, “তুমি ক্যাপ্টেন, তুমি বলো।” পটৌডি তাঁকে আবার বলেন, স্পিনারদের নিয়ে তুমি কী প্ল্যান করছ, সেটা বলো। “চন্দ্রকে আমি খুব ভাল চিনতাম। কিন্তু ওকে এ ভাবে বল করো, ও ভাবে বল করো, বলার মানে ছিল না। প্ল্যানমাফিক ওকে দিয়ে কিছু সম্ভব ছিল না,” বলছিলেন প্রসন্ন। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়, বেদী-চন্দ্র ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যানদের আক্রমণ করবেন। আর প্রসন্ন রান যেমন আটকাবেন, তেমন ব্যাটসম্যানকে ভয়ে-ভয়েও রাখবেন। চন্দ্রর সে দিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা আরও রোমাঞ্চকর। “প্রথম তিন ওভারে আঠাশ দিলাম। ভাবলাম, বলটাই আর পাব না। আচমকাই দেখি, মিটিং করে আবার আমাকেই বল দেওয়া হল। লয়েড আউট হল, কালীচরণ গেল, বুঝলাম ম্যাচটা আমরা জিতে গিয়েছি,” হাসতে হাসতে বলে চলেন চন্দ্রশেখর। “আসলে আমি কোনও দিন প্ল্যান করে কিছু করিনি। জানতাম, আমার দিনে বিশ্বের কোনও ব্যাটসম্যান আমাকে হারাতে পারবে না।”

করতালির মেঘগর্জন।

কী হল নয়, প্রশ্ন হওয়া উচিত অনুষ্ঠানে কোন প্রসঙ্গ উঠে এল না। বেদীর অধিনায়কত্বে কলঙ্কিত পাকিস্তান সফর এসেছে, যেখানে ‘গুডউইল’ সফরের নাম করে ভারতীয় টিমকে রাখা হয়েছিল ডরমিটরিতে। পোড়া পাউরুটি আর ওমলেট যে সফরে বরাদ্দ থাকত প্রসন্ন-চন্দ্রদের খাওয়া-দাওয়ার জন্য। সেই সিরিজের দুই পাকিস্তানি আম্পায়ার নিয়ে অসূয়া এখনও যায়নি। কিন্তু একই সঙ্গে ইমরান খানের তুমুল প্রশংসাও করতে বেদী দু’বার ভাবেন না। “নিরপেক্ষ আম্পায়ার নিয়ে আওয়াজটা ইমরানই তুলেছিল। যেটা করতে বুকের পাটা লাগে।” প্রসন্ন আবার কী ভাবে কলকাতার জামাইবাবু হলেন, সেই গল্পও বেদী শুনতে চাইলেন পুরনো বন্ধুর মুখ থেকে। ঠাট্টায় পাল্টা দিলেন প্রসন্ন, “আমার বরাবরই সুন্দরী মহিলাদের দিকে চোখ থাকত। সবচেয়ে সুন্দরী যাকে পেলাম, তাকেই বিয়ে করে ফেললাম!’’ চন্দ্র আবার এত দিন পরেও কানে স্পষ্ট শুনতে পান অতীতে বল করতে গেলে ইডেনের ‘চন্দ্র, চন্দ্র’ আওয়াজ, শুনে অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ কতটা হত আজও মনে পড়ে। টাইগার পটৌডি তিনিও এলেন। আনলেন বেদী, সঙ্গে অবধারিত সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।

বেদীর অভিমত, ভারতীয় ক্রিকেটে দু’জন আজ পর্যন্ত মুখে সোনার চামচ নিয়ে জন্মেছেন। এক জন পটৌডি। দ্বিতীয় জন সৌরভ। বাকি সবাই মধ্যবিত্ত। বেদীর মনে হয়, অধিনায়ক টাইগার তাঁর সময়ের চেয়ে একশো বছর এগিয়ে ছিলেন ক্রিকেট-চেতনায়। যিনি গর্বিত এক ভারতীয় তো বটেই, একই সঙ্গে ক্রিকেটারদের ধমনীতে জাতীয়তাবাদ ঢুকিয়েছিলেন। সৌরভকে সেখানে দূর থেকে দেখেছেন আর দেখে বেদীর উপলব্ধি, “জেতার অভ্যেসটা ও তৈরি করেছিল। কিন্তু ক্রিকেটের আইনকানুন সব সময় মানত না। ক্লাবহাউসে ওর জামা ওড়ানোর যে ছবিটা দেখলাম, তাতে জেন্টলম্যানশিপ কিছু নেই। টাইগারকে জীবনে দেখিনি প্ররোচনায় পড়তে। ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরি করুক বা বোলার উইকেট নিক, টুপিটা খুলে হালকা স্যালুট করত। ওটাই আসল ক্রিকেট-সংস্কৃতি!”

ঠিকই আছে, আজ পুরাতনের দিন ছিল, তারাই জিতেছে। সৌরভের দুঃখ করার কিছু নেই। কোনও এক সচিন রমেশ তেন্ডুলকরও তো আজ জিততে পারলেন না!

ছবি: উত্‌পল সরকার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.