হতাশ: স্বপ্নভঙ্গের পুনরাবৃত্তি। আই লিগ খেতাব অধরাই থেকে গেল ইস্টবেঙ্গলের। বিষণ্ণ বিজয়ন। নিজস্ব চিত্র
স্বপ্নভঙ্গের পুনরাবৃত্তি। আই লিগ খেতাব অধরাই থেকে গেল ইস্টবেঙ্গলের।
শনিবার কোঝিকোড়ের ইএমএস কর্পোরেশন স্টেডিয়ামে গোকুলম এফসি-র বিরুদ্ধে পিছিয়ে থেকেও ইস্টবেঙ্গলের দুরন্ত জয়ের কাহিনি কেউ মনে রাখবে না। ইতিহাসে থেকে যাবে একটাই তথ্য— জয় দিয়ে আই লিগ শেষ করেও ট্রফি হাতে তোলা হল না।
গোকুলমের বিরুদ্ধে ম্যাচটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মাঠের ঘাসে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লেন ফুটবলারেরা। কোচ আলেসান্দ্রো মেনেন্দেস গার্সিয়া সান্ত্বনা দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। প্রায় মিনিট কুড়ি পরে যখন উঠলেন জনি আকাস্তোরা, দেখে মনে হচ্ছিল মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। অধিনায়ক লালরিনডিকা রালতে ড্রেসিংরুমে ফিরলেন জার্সিতে চোখের জল মুছতে মুছতে। কোঝিকোড়ের স্টেডিয়ামে লাল-হলুদ জার্সি গায়ে ফুটবলারেরা যেন অ্যালান ডোনাল্ড, শন পোলক, জন্টি রোডসদের উত্তরসূরি। দক্ষিণ আফ্রিকার এখনও পর্যন্ত বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। শন পোলক থেকে জন্টি রোডস, ক্রিকেটবিশ্বে সেরা হয়েও কখনও বিশ্বসেরার মুকুট মাথায় তুলতে পারেননি। ‘চোকার্স’ তকমা নিয়েই পোলকরা শেষ করেছেন খেলোয়াড়জীবন।
শনিবার ইস্টবেঙ্গলের কাছেও ছিল আই লিগে চোকার্স বদনাম ঘোচানোর অগ্নিপরীক্ষা। তবে শুধু গোকুলমের বিরুদ্ধে জিতলেই হত না। ঘরের মাঠে মিনার্ভা এফসি-র বিরুদ্ধে হারতে হত চেন্নাই সিটি এফসি-কে।
ম্যাচ শুরু হওয়ার তিন মিনিটের মধ্যে কোঝিকোড় স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে উৎসব শুরু করে দিলেন লাল-হলুদ সমর্থকেরা। কারণ, মিনার্ভার বিরুদ্ধে পিছিয়ে পড়েছে চেন্নাই। আই লিগে চ্যাম্পিয়ন হওয়া যেন শুধু সময়ের অপেক্ষা। যদিও ইস্টবেঙ্গল যে ভাবে এ দিন শুরু করেছিল, তাতে সমর্থকদের অনেকেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। এনরিকে এসকুয়েদা, খাইমে সান্তোস কোলাদো থেকে ব্রেন্ডন ভানলালরেমডিকা, কারওর খেলায় ছন্দ নেই। আলেসান্দ্রো সাইড লাইনের ধারে গিয়ে বারবার চিৎকার করছিলেন। তাতেও অবশ্য কোনও খেলায় পরিবর্তন হয়নি। মনে হচ্ছিল যেন, প্রচণ্ড ক্লান্ত এনরিকেরা। মন চাইলেও শরীর দিচ্ছে না। দু’দিন আগে কোঝিকোড়ে এলে হয়তো আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারতেন তাঁরা। চব্বিশ ঘণ্টা আগে পৌঁছে প্রচণ্ড গরম ও আর্দ্রতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া যে সহজ নয়, তা বোঝা গেল। তবে প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে বদলে গেল কোচের অভিব্যক্তি।
পকেট থেকে মোবাইল ফোন বার করে চেন্নাই ম্যাচের স্কোর এক ঝলক দেখে যখন ড্রেসিংরুমের দিকে এগোলেন আলেসান্দ্রো, ড্রেসিংরুমে যখন ফিরছিলেন, চোখেমুখে তখন স্বস্তির ছাপ। কিন্তু কে জানত নাটকীয় ভাবে বদলে যাবে পরিস্থিতি। কোয়েম্বত্তূরে। কোঝিকোড়ে।
ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা এখন সারাক্ষণ গ্যালারি থেকে গান গেয়ে ফুটবলারদের উদ্বুদ্ধ করেন। দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হওয়ার মিনিট দশেকের মধ্যেই গান থেমে গেল। গ্যালারিতে বসে থাকলেও তাঁদের প্রত্যেকের চোখ ছিল মোবাইলে চেন্নাই-মিনার্ভা ম্যাচে। ৫৬ মিনিটে চেন্নাইয়ের পেদ্রো মানজ়ি পেনাল্টি থেকে সমতা ফেরাতেই খেতাব হাতছাড়া হওয়ার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল গ্যালারিতে। যা আরও বাড়ল ৭০ মিনিটে মার্কাস জোসেফ গোল করে গোকুলমকে এগিয়ে দেওয়ার পরে। অনেকেই দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছেন। পরিস্থিতি এমন যে, তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার কেউ নেই। প্রত্যেকেরই তো এক অবস্থা।
আই লিগে ইস্টবেঙ্গলের চ্যাম্পিয়ন হওয়া দেখতে পরিবার নিয়ে ত্রিশূর থেকে কোঝিকোড় এসেছিলেন আই এম বিজয়ন। গোকুলমের গোলের পরে হতাশায় মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকলেন। বলছিলেন, ‘‘বুঝতে পারছি না ইস্টবেঙ্গল কেন ফরোয়ার্ডে একা এনরিকে-কে খেলাচ্ছে। ওদের তো হারানোর কিছু নেই। এই ম্যাচটার উপরেই আই লিগ ভাগ্য নির্ভর করছে।’’ তিনি যোগ করেন, ‘‘জবি জাস্টিন থাকলে ইস্টবেঙ্গল এত ক্ষণে এগিয়ে যেত। ওর ছিটকে যাওয়াটা বড় ক্ষতি। আশা করছি, আলেসান্দ্রো নিশ্চয়ই এ বার রণকৌশল বদল করবেন।’’
বিজয়নের অনুমানই ঠিক। এনরিকের পরিবর্তে টোনি দোভাল, ব্রেন্ডন ভানলালরেমডিকার জায়গায় বালি গগনদীপ সিংহকে নামালেন আলেসান্দ্রো। সাত মিনিটের মধ্যেই পেনাল্টি থেকে সমতা ফেরালেন কোলাদো। ৮৬ মিনিটে গোল করে ইস্টবেঙ্গলকে এগিয়ে দিলেন ডানমাওয়াইয়া রালতে। কিন্তু কী লাভ? তত ক্ষণে দেওয়াল লিখন অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। গৌরব বোরার গোলে ২-১ এগিয়ে চেন্নাই। শুরু হল লাল-হলুদ শিবিরে প্রার্থনা— কয়েক জন সমর্থককে দেখা গেল, বুকে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রয়েছেন। যদি মিনার্ভা সমতা ফেরায়। হল উল্টো। সংযুক্ত সময়ে ফের গৌরব গোল করে চেন্নাইকে ৩-১ এগিয়ে দিলেন।
ম্যাচের পরে বিজয়ন বলছিলেন, ‘‘অন্য দলের উপরে ভরসা করে কখনও চ্যাম্পিয়ন হওয়া যায় না। ট্রফি সব সময় ছিনিয়ে নিতে হয়। ইস্টবেঙ্গল বেশ কয়েকটা ম্যাচ নিজেদের ভুলে পয়েন্ট নষ্ট করেছে বলেই চ্যাম্পিয়ন হতে পারল না।’’ কেন আই লিগ জিততে পারল না ইস্টবেঙ্গল? স্প্যানিশ গুরু আলেসান্দ্রোর সোজসাপটা ব্যাখ্যা, ‘‘ব্যর্থতার বিশেষ কোনও কারণ নেই। অনেক সময় প্রচুর পরিশ্রম করেও ফল পাওয়া যায় না। আমাদের ক্ষেত্রেও এ বার তা-ই হয়েছে।’’
স্বপ্নভঙ্গের রাতে ব্যতিক্রমী দৃশ্য দেখা গেল কোঝিকোড়ে। সম্ভবত এই প্রথম চ্যাম্পিয়ন হতে না পারার জন্য কোচ ও ফুটবলারদের কাঠগড়ায় তুললেন না লাল-হলুদ সমর্থকেরা। টিম বাসে ওঠার সময় গার্ড অব অনারের ভঙ্গিতে দু’হাত শূন্যে তুলে আলেসান্দ্রোবাহিনীকে সম্মান জানালেন!
বদলে যাওয়া ইস্টবেঙ্গলে বদলাল না শুধু আই লিগ-ভাগ্য। তীরে এসেই ফের ডুবল তরী।
ইস্টবেঙ্গল: রক্ষিত ডাগার, লালরাম চুলোভা, বোরখা গোমেস পেরেস, জনি আকোস্তা, মনোজ মহম্মদ (সামাদ আলি মল্লিক), ব্রেন্ডন ভানলালরেমডিকা (বালি গগনদীপ সিংহ), কাশিম আইদারা, লালরিন্ডিকা রালতে, লালডানমাওয়াইয়া রালতে, খাইমে সান্তোস কোলাদো ও এনরিকে এসকুয়েদা (টোনি দোভাল)।
গোকুলম এফসি: অর্ণব দাসশর্মা, মহম্মদ ইরশাদ, আন্দ্রে ডেনিস, ড্যানিয়েল আদো, ভর্বে ফ্রান্সিস, মনোতোষ চাকলাদার, অর্জুন জয়রাজ, ইমরান খান, লালমুনকিমা (বিজেশ টি বি), ইজিয়োগো এমানুয়েল (ভি পি সুহের), ও মার্কাস জোসেফ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy