সিনেমা দেখতে ভালবাসেন দু’জনেই!
ভালবাসেন পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে!
ছেলেবেলায় দু’জনের কেউ-ই অবশ্য ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন না!
অথচ এখন বল পায়ে মাঠে নামলে বাহ্যিক সব কিছু ভুলে যান তাঁরা। থেকে যায় শুধু গোলের খিদেটুকুই! দু’চোখ থেকে ঠিকরে বের হতে থাকে গোলের জন্য মরিয়া জেদ আর নিজেদের প্রমাণ করার আগুন।
ডার্বিতে দুই প্রধানের দুই পিভট— ড্যারেল ডাফি আর উইলিস প্লাজা!
৩২ বছরের স্কটিশ ডাফি বয়সকে শুধুমাত্র সংখ্যা মনে করে সমালোচকদের যাবতীয় সমালোচনা ফুৎকারে উড়িয়ে চলতি আই লিগে ছ’ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করে রেখেছেন। আবার প্রথম বার ভারতে এসেই নজর কেড়েছেন ত্রিনিদাদ টোবাগোর ২৯ বছরের স্ট্রাইকার প্লাজা। তাঁর ঝুলিতেও নয় নয় করে পাঁচ গোল।
১২ ফেব্রুয়ারি শিলিগুড়ির কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে লড়াইটা শুধু দুই হাইতিয়ান ফুটবলার সনি আর ওয়েডসনের মধ্যে হবে না। লড়াইটা হবে প্লাজা বনাম ডাফিরও। গোলের জন্য দুই প্রধানের সমর্থকরা যাঁদের দিকে তীর্থের কাকের মতোই চেয়ে থাকবেন!
প্লাজা যেমন বৃহস্পতিবার সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন। যাতে তিনি ডার্বির জন্য নিজের নতুন বুটের ছবি দিয়ে বলেছেন, ‘‘ভারতে এটাই আমার প্রথম ডার্বি। আমি এই ম্যাচটা পুরো উপভোগ করতে চাই। আর নিজের টিমকে তিন পয়েন্ট এনে দিতে চাই।’’ শোনা যাচ্ছে ডাফি আবার ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন, ‘‘কলকাতা লিগে ডার্বি খেলতে পারিনি বলে মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু ওটা ক্লাবের সিদ্ধান্ত ছিল। তবে এ বার আমি প্রথম কলকাতা ডার্বি খেলতে চলেছি। এর আগে এই ডার্বি নিয়ে অনেক গল্প শুনেছি। তাই গোল করে প্রথম ডার্বি স্মরণীয় করে রাখতে চাই। গুরুত্বপূর্ণ এই ম্যাচ থেকে টিমকে তিন পয়েন্ট এনে দিতে চাই।’’ দু’জনের কথাতেই পরিষ্কার ডার্বির জন্য কতটা তেতে রয়েছেন দুই প্রধানের দুই তারকা স্ট্রাইকার!
আসলে ফুটবলকে ঘিরে ডাফি বা প্লাজা দু’জনেই আবেগপ্রবণ। গোল মিস করলে বা কোনও ম্যাচে ব্যর্থ হলে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন। অথচ প্লাজা তো একটা সময় ফুটবল খেলার কথা ভাবতেনই না। তাঁর দু’ চোখ জুড়ে তখন বড় ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন। স্কুলের টিমের হয়ে তিনি ক্রিকেট খেলতেন। ভাল বল তো করতেনই। মিডল অর্ডারে ব্যাটও করতেন। সুনীল নারিনের খুব ভাল বন্ধু হন প্লাজা। তাঁরা একই স্কুলে একই টিমে ক্রিকেট খেলতেন। কিছু দিন আগেই ইস্টবেঙ্গল প্র্যাকটিসের পর গল্প করতে গিয়ে প্লাজা বলছিলেন, ‘‘আমার বাবার আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। সেটা আমার স্কুলের ফুটবল শিক্ষক জানতেন। তাই আমাকে ডেকে তিনি বলেছিলেন, ক্রিকেটের বদলে ফুটবলে মন দিতে। সে সময় আমি চুটিয়ে ক্রিকেট খেলছি। জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু বাস্তবটা যে বড় কঠিন।’’ সে দিন কথাগুলো বলার সময় একটু যেন উদাস হয়ে পড়ছেন বলে মনে হচ্ছিল প্লাজাকে দেখে। পুরনো স্মৃতিতে তিনি তখন বিভোর। না থেমে বলেছিলেন, ‘‘সত্যি কথা বলতে ক্রিকেটের মতো খরচ সাপেক্ষ খেলার সঙ্গতি আমার ছিল না। তখন থেকে তাই ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নে জল ঢেলে ফুটবলে মন দিলাম। তবে এখন যখন পিছন ফিরে তাকাই তখন স্কুলের সেই ফুটবল স্যারের কথা মনে পড়ে। ওঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’’ সুনীল নারিনের সঙ্গে এখনও তাঁর ফোনে যোগাযোগ রয়েছে বলে জানালেন ব্রায়ান লারার ভক্ত নিজেই।
ডার্বির জুতো বাছতে ব্যস্ত প্লাজাও।
ডাফি আবার গল্ফার হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঘটনাচক্রে ফুটবলার হয়ে যান। মোহনবাগান মাঠে দাঁড়িয়েই একদিন তিনি নিজের ছোটবেলার গল্প করতে করতে বলেছিলেন, ‘‘ছোটবেলায় আমি গল্ফ খেলতে খুব পছন্দ করতাম। গল্ফার হওয়ার স্বপ্নও দেখতাম। কিন্তু যত বড় হতে থাকলাম ফুটবলের প্রতি আগ্রহ বাড়তে লাগল। ফুটবলার না হলে হয়তো আমি গল্ফই খেলতাম।’’
কলকাতা লিগের পর ডাফির পারফরম্যান্স নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। তাঁকে আই লিগের টিমে রাখাটা আদৌ ঠিক হবে কি না, তা নিয়েও নানা জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। ‘বুড়ো ডাফি’ বলেও তাঁকে কম ব্যঙ্গ করা হয়নি। মুখে অবশ্য কখনও একটি কথাও বলেননি। আই লিগ শুরু হতেই মাঠে নেমে যাবতীয় সমালোচনার জবাব দিতে শুরু করেছেন তিনি। ঘনিষ্ঠ মহলে ডাফি নাকি একদিন হাসতে হাসতে বলেওছেন, ‘‘বুড়ো বলে আমাকে নিয়ে এত দিন সবাই হাসাহাসি করত। তারা এখন কোথায় গেল?’’ প্রকাশ্যে অবশ্য বারবারই স্কটিশ স্ট্রাইকার বলছেন, ‘‘ভাল টিম পেলে খেলাটাই অনেক সহজ হয়ে যায়। কলকাতা লিগের সময় টিমটা এতটা ভাল ছিল না। আই লিগের টিমটা অসাধারণ। প্রত্যেকেই অভিজ্ঞ। মাঠে তাই আমরা প্রত্যেকেই খেলাটা উপভোগ করছি। যে কারণে সাফল্যও আসছে।’’ প্লাজা আবার মনে করেন, ‘‘আই লিগ পেতে হলে টিমগেমই ভরসা। আর ডার্বিতে জেতাটাও নির্ভর করছে আমাদের পুরো টিমের উপর। সবাই ভাল খেললেই সাফল্য পাব। কে গোল করল, কে গোল করল না, সেটা কোনও বিষয়ই নয়। তিন পয়েন্টই আসল।’’
পৃথিবীর দুই প্রান্তে থাকা দুই কিশোরের স্বপ্ন একদিন টুকরো টুকরো হয়েই ভেঙে গিয়েছিল। ঘটনাচক্রে সেই দুই কিশোর এখন পরিণত। তাঁরা রবিবার ডার্বির মহাযুদ্ধে মুখোমুখি। ডাফি আর প্লাজা— দু’জনেরই বর্তমান স্বপ্ন রবিবার গোল করে টিমকে জেতানো। তবে একজনের স্বপ্ন পূরণ হতে গেলে, অন্য জনের স্বপ্ন তো ভাঙবেই। দেখার, এ বার কার স্বপ্ন পূরণ হয়!
ছবি: টুইটার।