Advertisement
E-Paper

র‌্যান্টির রংমশালে লাল-হলুদে চারশো ওয়াটের আলো

মেয়ের কান্না কতটা উদ্বেল করে তোলে বাবাকে? কতটা মরিয়া করে? বুধবার যুবভারতীর র‌্যান্টি মার্টিন্সকে না দেখলে সেটা বোঝা হয়তো সম্পূর্ণ না! ‘‘মুম্বই ম্যাচে পেনাল্টি নষ্ট করে বাড়ি ফিরে দেখি আমার মেয়ে কাঁদছে। বলেছিল, বাবা আজও পারলে না? সেই কান্নাটা এমন নাড়া দিয়ে গেল....’’ বলতে বলতে রাগী চেহারার নাইজিরিয়ান স্ট্রাইকারের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা স্নেহমিশ্রিত গলাও। যেখানে উচ্ছ্বাসের রংমশালের মধ্যেও জেদের শপথ।

রতন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৫ ০৪:৩৩

মেয়ের কান্না কতটা উদ্বেল করে তোলে বাবাকে? কতটা মরিয়া করে?
বুধবার যুবভারতীর র‌্যান্টি মার্টিন্সকে না দেখলে সেটা বোঝা হয়তো সম্পূর্ণ না!
‘‘মুম্বই ম্যাচে পেনাল্টি নষ্ট করে বাড়ি ফিরে দেখি আমার মেয়ে কাঁদছে। বলেছিল, বাবা আজও পারলে না? সেই কান্নাটা এমন নাড়া দিয়ে গেল....’’ বলতে বলতে রাগী চেহারার নাইজিরিয়ান স্ট্রাইকারের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা স্নেহমিশ্রিত গলাও। যেখানে উচ্ছ্বাসের রংমশালের মধ্যেও জেদের শপথ।
ভারতীয় ফুটবলের গোলমেশিন র‌্যান্টির বছর সাতেকের মেয়ের নাম ব্লেসিং। তাঁর ভালবাসার স্মারক এ দিন বুকে করে নিয়ে এসেছিলেন ভারতীয় ক্লাব ফুটবলে খেলা সমস্ত বিদেশির মধ্যে সর্বাধিক গোলের মালিক।
আই লিগে নিজের দুশো গোলের মাইলফলক ছোঁয়ার পর জার্সিটা খুলে যখন গ্যালারির দিকে ছুটে যাচ্ছেন র‌্যান্টি, তখনই বেরিয়ে পড়ল ‘ব্লেসিং’ লেখা ইনার-এর গেঞ্জিটা। তাতে প্রভু যীশুকে ধন্যবাদ জানানোর পাশেই মেয়ের নাম জ্বলজ্বল করছিল। সঙ্গে স্ত্রী, বন্ধুবান্ধবদেরও।

এগারো বছর আগে শুরু করেছিলেন ডেম্পোর হয়ে। আর গোল-যাত্রা শুরু স্টেট ব্যাঙ্ক অব ত্রিবাঙ্কুরের বিরুদ্ধে। তার পর ‘গোল যাত্রায় যাও হে’ নিশান উড়িয়ে জালে বল জড়িয়ে চলেছেন দেশ জুড়ে। কোথায় পিছনে পড়ে রইলেন ওডাফা ওকোলি (১৬৭)! কোথায় ইয়াকুবু (১৪৬)! এ দিনের পর র‌্যান্টি যেন ভারতীয় গোল-আকাশের ধ্রুবতারা।

জিভ দিয়ে ঠোট চাটতে চাটতে যখন বলছিলেন, ‘‘স্ট্রাইকারদের কাছে গোল আসে না, গোল তৈরি করে নিতে হয়’’ তখন র‌্যান্টিকে দেখে মনে হচ্ছিল ছেলেটা পাহাড়ি চিতা। যিনি গোলের গন্ধ পেলেই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন। এ দিনও যেমন হলেন! বিরতি পর্যন্ত জঘন্য ফুটবল। ঘুমপাড়ানি বললেও সব বলা হয় না। ডুডু-র‌্যান্টি যুগলবন্দি ডেরেক পেরিরার সালগাওকরের ডিফেন্সিভ ফুটবলের জালে বন্দি। গোল তো কোন ছার, গোলের সুযোগও তৈরি করতে পারছিলেন না এলকোর ছেলেরা। হতাশায় জলের বোতলে লাথি মারলেন স্বয়ং ডাচ কোচ।

আর ঠিক তখনই—র‌্যান্টি হাজির হলেন চিতার ভঙ্গিতে। বাঁ দিক থেকে উইং ধরে উঠছিলেন রবার্ট। বলটা গোয়ান ক্লাবের বক্সের মাথায় তুললেন। পিছন থেকে দৌড়ে এসে সবাইকে টপকে র‌্যান্টি হেডে ফ্লিক করলেন বলটা। এত গতি ছিল যে সালগাওকর গোলে থাকা ‘ইন্ডিয়ান স্পাইডারম্যান’ সুব্রত পালও বোকা বনে গেলেন। সোদপুরের মিষ্টুকে দাঁড়িয়ে দেখতে হল, অর্ধেক জার্সি খুলে ফেলা র‌্যান্টির নাচ।

‘‘ভারতে আসার পর প্রথম গোলটার কথা এখন আর মনে নেই। তার পরে প্রচুর ভাল গোল করেছি। কিন্তু আজকের গোলটা আমার মতে সেরা। দু’শো গোল! মা বেঁচে থাকলে খুশি হতেন। মমকেই উৎসর্গ করছি গোলটা।’’ সাংবাদিক সম্মেলনে এসে মনের আগল খুলে বলে দেন একই দিনে ইস্টবেঙ্গলকেও আই লিগে দু’শো ম্যাচ জয়ের মাইলফলক ছোঁয়ানো স্ট্রাইকার। মেনে নিচ্ছেন, ভারতে যত স্ট্রাইকারের সঙ্গে জুটি বেঁধেছেন তাঁর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছেন বেটোর পাশে খেলে। সুখের দিনে ভুলে যাননি প্রয়াত সতীর্থ জুনিয়রকে। ‘‘ও আমার ভীষণ ভাল বন্ধু ছিল। মাঠেই চোখের সামনে ওর মৃত্যু দেখার পর দেশেই ফিরে গিয়েছিলাম দুঃখে।’’

র‌্যান্টির সাফল্যের রসায়ন কী? তাঁকে নিয়ে কাজ করা কোচেরা বলছেন, ছেলেটা আদ্যন্ত টিম ম্যান। অসম্ভব শৃঙ্খলাপরায়ণ। প্রচণ্ড পরিশ্রমী আর লক্ষ্যে অবিচল। খেলার বাইরে পরিবার ছাড়া আর কিচ্ছুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন না। এই মুহূর্তে আই লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা (১৫) তিনি। ইস্টবেঙ্গল পয়েন্ট তালিকায় চার নম্বরে। টিমের লিগ খেতাব না, নিজের হায়েস্ট স্কোরারের ট্রফি—দু’টোর মধ্যে বাছতে বললে কোনটা বাছবেন? ‘‘হায়েস্ট স্কোরার অনেকবার হয়েছি। ইস্টবেঙ্গলের হয়ে প্রথম আই লিগটা পেতে চাই।’’

যদিও লিগ টেবলের যা অবস্থা তাতে লাল-হলুদের এ বার খেতাব পাওয়ার সম্ভাবনা বোধহয় এক শতাংশেরও কম। টিমটার ফিটনেস লেভেল খুব খারাপ। রক্ষণ থেকে মাঝমাঠ, মাঝমাঠ থেকে আক্রমণ—সব যেন কেমন অগোছাল। এলকো টিমটাকে খেলাতে চান বার্সেলোনার মতো—মেহতাব, বার্তোসরা খেলছেন ‘বাংলা ফুটবল’। স্ট্র্যাটেজি শব্দটা বাক্সে ভরে মাঠের বাইরে রেখে আসা দলকে দেখাচ্ছে হ-য-ব-র-ল। সালগাওকরের মতো একটা নখদন্তহীন বাঘের সামনে পড়েও কী দশা! সঞ্জু প্রধানের দুরন্ত শটটা লাল-হলুদ কিপার অভিজিৎ মন্ডল না বাঁচালে এ দিন লিগ টেবলে বরং আরও পিছিয়ে পড়তেন মেহতাবরা!

অভিজিৎ বাঁচালেন। কিপাররা বাঁচান-ই। কিন্তু র‌্যান্টি বাবা পার না করলে, কে দু’শো জয়ের মাইলফলক স্পর্শ করাতেন দলকে? র‌্যান্টির দু’শো প্লাস ইস্টবেঙ্গলের দুশো—একই দিনে চারশো ওয়াটের রংমশাল!

ইস্টবেঙ্গল: অভিজিৎ, অভিষেক (দীপক), অর্ণব, গুরবিন্দর, রবার্ট, মেহতাব (সুবোধ), খাবরা, বার্তোস (তুলুঙ্গা), লোবো, ডুডু, র‌্যান্টি।

তথ্য হরিপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।

ছবি উৎপল সরকার।

Ratan Chakroborty East Bengal football Salgaocar FC I League Vivekananda Yuva Bharati Krirangan Nigerian forward kolkata Ranty Martins
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy