Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ইংল্যান্ডের সাহসই জমিয়ে দেবে টেস্টের শেষ দিন?

রাজকোট প্রেসবক্সের ঠিক বাইরেটায় রাখা ছোট-ছোট দু’টো বালতি। তাক করে তাতে শুধু গোটা কয়েক টেবল টেনিস বল ফেলতে হবে। দু’জনেরই হাতে দু’টো করে বল-ভর্তি বাটি ধরিয়ে দেওয়া আছে।

হামিদ ও আদিল। শনিবার ভারতকে ভোগালেন যে দুই।

হামিদ ও আদিল। শনিবার ভারতকে ভোগালেন যে দুই।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
রাজকোট শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:১০
Share: Save:

রাজকোট প্রেসবক্সের ঠিক বাইরেটায় রাখা ছোট-ছোট দু’টো বালতি। তাক করে তাতে শুধু গোটা কয়েক টেবল টেনিস বল ফেলতে হবে। দু’জনেরই হাতে দু’টো করে বল-ভর্তি বাটি ধরিয়ে দেওয়া আছে। ক্যামেরা প্যান করলেই যুদ্ধটা শুরু হয়ে যাবে!

দু’জন মানে দুই ভদ্রলোক। অতীব পরিচিত এবং ভারতীয় ক্রিকেটের কিংবদন্তি। লোকে একডাকে চেনে।

কপিলদেব নিখাঞ্জ এবং বীরেন্দ্র সহবাগ!

পুরোটাই ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজের সম্প্রচার সংস্থার একটা প্রয়াস। টেস্ট ম্যাচ চলাকালীন ধারাভাষ্যকারদের নিয়ে রোজই এরা কিছু না কিছু আকর্ষণীয় ব্যাপারস্যাপার দেখায়, এটাও কখনও না কখনও দেখানো হবে। আশ্চর্য তাই কপিল বনাম সহবাগ নয়। আশ্চর্য অন্যটা। বিলিতি এবং ভারতীয় প্রেসের একটা বড় অংশকে দেখা গেল, এমন অভিনব যুদ্ধ দেখতে প্রেসবক্সের দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে। অথচ ম্যাচ চলছে। দিনের তৃতীয় সেশন শুরু হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। কে না জানে, একটা টেস্ট ম্যাচের শেষ সেশনটাই অনেক সময় চরম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। তার উপর ফোর্থ ডে পিচে অশ্বিন-জাডেজা জুটির সামনে অ্যালিস্টার কুক। এ সব ছেড়ে ওঠা যায় নাকি?

কিন্তু মিডিয়াকুল উঠে পড়ল। শুধু তাই নয়, মিনিট পনেরোর মধ্যে ভিড়টাও বাড়িয়ে ফেলল। কী ব্যাপার, না রবি শাস্ত্রী কমেন্ট্রি বক্সের লাগোয়া রেলিংয়ে ঝুঁকে এ বার কপিলদেবের সঙ্গে হালকা হাসি-ঠাট্টা চালু করে দিয়েছেন। কপিলকে টেবল টেনিস বল হাতে দেখে অতীব পুলকিত শাস্ত্রীকে বলতে শোনা গেল, আরে, আপনি তো দেখছি ফ্লোরেও বল ফেলে সিম করাচ্ছেন! শুনে সম্প্রচার সংস্থার ক্রু সমেত চর্তুদিকে একটা হাসির হুল্লোড় উঠল। একটু দূরে দাঁড়িয়ে কিরণ মোরে ততক্ষণে আবার পুরনো দিনের গল্প শোনাচ্ছেন। অতীতের এক ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের গল্প। জামাইকা টেস্ট। ভিভ রিচার্ডস খেলছেন। খেলতে খেলতে আচমকা নাকি রান আউট হয়ে যান ভিভ। কিন্তু ভারতীয় টিম অ্যাপিল করে-টরে দেখতে পায়, আম্পায়ার তা খেয়ালই করেননি। মোরে ভেবেচিন্তে ওই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান আম্পায়ারের নামটা মনে করতে পারলেন না। কিন্তু কারণটা পারলেন। আম্পায়ার নাকি দাঁড়ানো অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন!

শোনামাত্র আবারও একপ্রস্থ হাসাহাসি চলল এবং ফের কেউ মাঠের দিকে তাকানোর প্রয়োজন করল না। করবেও বা কেন? তাকালে তো ওই ক্যারিবিয়ান আম্পায়ারের মতো দশা হতে পারে। ঘুমিয়ে পড়তে হতে পারে!

পাঁচ দিনের একটা টেস্ট যুদ্ধের পরিণতি যদি তৃতীয় দিন থেকে পরিষ্কার হয়ে যেতে শুরু করে, চতুর্থ দিনে এসে যদি তাতে পড়ে যায় প্রায় সিলমোহর— কার আর আগ্রহ বেঁচে থাকতে পারে? এমন নয় যে টেস্টের রেজাল্ট নিশ্চিত। কিন্তু একটা ব্যাপার নিশ্চিত। পঞ্চম দিনে অতি-নাটকীয় কিছু না ঘটে গেলে রাজকোট টেস্টের কোনও রেজাল্টই নেই।

ইংল্যান্ডের ৫৩৭-এর জবাবে ভারত ৪৮৮ অলআউট। এবং শনিবারের তৃতীয় সেশনে সাঁইত্রিশ ওভার বল করেও ভারত উইকেটহীন। ইংল্যান্ডের ৪৯ রানের লিড চড়চড়িয়ে দিনের শেষে ১৬৩-তে পৌঁছে গিয়েছে। অ্যালিস্টার কুক হাফসেঞ্চুরি করব-করব করছেন, উনিশ বছরের ভারতীয় বংশোদ্ভূত হাসিব হামিদ জীবনের প্রথম টেস্ট হাফসেঞ্চুরি করে ইতিহাসে ঢুকেও পড়েছেন। জ্যাক ক্রফোর্ড, ডেনিস কম্পটনের পর তিনিই কোনও কুড়ির নীচে থাকা ইংরেজ, যাঁর টেস্ট হাফসেঞ্চুরি হল। রেকর্ড-টেকর্ড ঠিক আছে। দুঃখের হল, রবিচন্দ্রন অশ্বিনরা স্পিনের-বিষে হামিদের টেকনিকে ন্যূনতম আঁচড়ও কাটতে পারলেন না। ঘুরেফিরে পরিস্থিতি যা, তাতে কিছুটা নাটকীয়তা আমদানিতে পঞ্চম দিন জমিয়ে দেওয়া শুধু ইংল্যান্ডের পক্ষে সম্ভব। শেষ দিন লাঞ্চের মধ্যে যদি তারা আরও একশো-সওয়া একশো মতো তুলে ছেড়ে দেয় (যার ভাবনাও আছে), তিনশোর টার্গেট দিয়ে দু’টো সেশনের জন্য যদি নামায় ভারতকে, একমাত্র তবে কিছুটা জমলেও জমতে পারে। কিন্তু বাস্তব বিচারে জমার সম্ভাবনা কম। কারণ এই টেস্টে ভারতীয় বোলিংকে দারুণ না লাগলেও ব্যাটিংকে লেগেছে। দু’টো সেশনে তারা ধ্বংস হওয়ার নয়। সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা— ক্রিকেটারদের নিয়মরক্ষার জন্য মাঠে আসা। অনেকটা হালফিল ব্যাঙ্কে গিয়ে নতুন নোট তোলার লাইন দেওয়ার মতো। লাইনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়াতে হবে। কিন্তু টাকা পাওয়ার কোনও গ্যারান্টি নেই!

রবিবার ভারত যাঁদের দিকে তাকিয়ে।

এক-এক সময় মনে হচ্ছে, এ দিনের সাঁইত্রিশ ওভারের বোলিংয়ে অশ্বিনদের নিষ্ফলা থেকে যাওয়ার দায় সম্পূর্ণ তাঁদের উপর চাপানো ঠিক নয়। রাজকোট পিচ ধর্মগত ভাবে ব্যাটিং-বন্ধু থাকে জানা ছিল। কিন্তু তাই বলে চতুর্থ দিনেও এতটা নিষ্প্রাণ থাকবে? কেউ কেউ বলতে পারেন, আদিল রশিদ তা হলে চার উইকেট পেলেন কী ভাবে? এটা অনস্বীকার্য, তুলনায় ভাল বল করেছেন। কিন্তু এটাও মানতে হবে যে, কয়েকটা ফাটলে পড়লেই শুধুমাত্র ঘুরছে। মোরে বলছিলেন যে, আসল ঝামেলাটা বাঁধিয়েছে বাইশ গজের ঘাস। যাতে পিচের বাঁধন এখনও অটুট। ফাটলেও তাই খুব লাভ হচ্ছে না। প্রশ্ন— সেটাও উঠছে। বলাবলি চলছে, গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে মারাত্মক ঘূর্ণি বানিয়ে আইসিসির ধাতানি খেয়েছিল ভারতীয় বোর্ড। তার পর না হয় অতটা ঘূর্ণি হবে না, বোঝা গেল। কিন্তু রেজাল্টই পাওয়া যাবে না, এমন উইকেট বানিয়েও বা কী লাভ? প্রাক্তন নির্বাচক প্রধান মোরে শুধু একটা লাভ দেখছেন। বললেন যে, হালফিল আগে ব্যাট করে ভারত পাঁচশো তুলত। এ বার তাড়া করল। আর তাড়া করার ধরনটা মনে রাখার মতো। বাকি সিরিজে যা কাজে দেবে। ভারতকে দু’দিনে কখনওই পাঁচশোর চাপে ন্যুব্জ মনে হয়নি।

ঘটনা। বিজয়-পূজারার পর রবিচন্দ্রন অশ্বিন আজ যে ভাবে ব্যাটিংটা করে গেলেন, তা পাঁচশো তাড়ার সেরা ভবিষ্যৎ-ম্যানুয়াল হিসেবে থেকে যেতে পারে। খেলা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে রাহানে বোল্ড। তার আধঘণ্টার মধ্যে বিরাট কোহালি কি না হিট উইকেট! দুর্ভাগ্য বিরাটের। খেয়ালও করেননি কখন রশিদের শর্ট বলটার যথাযোগ্য ব্যবস্থা করার সময় পা-টা বিদ্রোহ করে ‘বেল’ ফেলে দিয়েছে। রশিদ নিজেও বুঝতে পারেননি। ধরেন উইকেটকিপার জনি বেয়ারস্টো। দেখেটেখে প্রায় দু’তিন মিনিট অবিশ্বাসে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভারত অধিনায়ক। তাঁর আগে লালা অমরনাথ ছাড়া কোনও ভারত অধিনায়ককে তো আজ পর্যন্ত হিট উইকেটে আউট হতে হয়নি। এবং ঠিক ওখান থেকে অশ্বিনের যুদ্ধ শুরু। প্রথমে ঋদ্ধিমানের সঙ্গে একটা ভাল পার্টনারশিপ। তার পর শামিকে নিয়ে নাটকীয় যুদ্ধ। প্রতি ওভারে একটা করে বাউন্ডারি মেরে পঞ্চম বা ষষ্ঠ বলে সিঙ্গলস নিয়ে ফের স্ট্রাইকে চলে আসছিলেন। কুক ছ’সাত জনকে সার্কলে তুলে আনছিলেন। কিন্তু লাভ হচ্ছিল না। বিরাটের অদ্ভুত আউটের আক্ষেপ বাড়তে দেননি অশ্বিন। ভারত অধিনায়ক বরং আক্ষেপ করতে পারেন নিজের অধিনায়কত্ব নিয়ে। ওটা আজ ভাল হয়নি। অশ্বিনকে ব্যবহারটা ভাল হয়নি। বোলিংয়ের শুরুটা অশ্বিনকে দিয়ে করতে পারতেন। মাঝে একটা সময় অনেকক্ষণ আনলেনও না। শামি-উমেশকে দিয়ে করিয়ে গেলেন টানা।অমিত মিশ্রকে আনলেন সাতাশ নম্বর ওভারে। ইংল্যান্ড থিতু হওয়ার সময়টা পেয়ে গেল।

সে যাই হোক, এটা সিরিজের প্রথম টেস্ট সবে। ড্র হয়ে গেলে কোনও অপরাধ হবে না। চারটে টেস্টে বাকি থাকবে, সুযোগ পাওয়া যাবে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের। আর সবক’টার উইকেট নিশ্চয়ই রাজকোট বাইশ গজ হবে না!

যুযুধান দুই শিবির থেকে

রবিচন্দ্রন অশ্বিন

শেষ দিন ওদের দুই এন্ড থেকেই চাপে রাখতে হবে। প্রচুর মেডেন নিতে হবে। ওদের এমন চাপে ফেলতে হবে যাতে পরের টেস্টেও এই চাপটা থাকে। চেষ্টা করব যাতে দ্রুত কতগুলো উইকেট নিতে পারি। কে বলতে পারে ম্যাচটা টানটান হয়ে উঠবে না?

মুরলী বিজয়

অবশ্যই আমরা এগিয়ে। শেষ দিনে প্রথম সেশনে কয়েকটা উইকেট তুলতে পারলে ম্যাচ জমে যাবে। উইকেট এখন স্লো হয়েছে। স্পিনারদের সেটা সাহায্য করবে। আশা করছি সকালের সেশনে আমরা উইকেট তুলতে পারব।

আদিল রাশিদ

তিন ভাবেই ম্যাচটা শেষ হতে পারে। এখনও শেষ দিনে অনেক ক্রিকেট খেলা বাকি রয়েছে। প্রথম আমাদের দেখতে হবে লাঞ্চের আগে আমরা কী রকম অবস্থায় রয়েছি। যদি ভাল রান উঠে যায় তা হলে ডিক্লেয়ার দেওয়াই যেতে পারে।

ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংস: ৫৩৭

ভারত প্রথম ইনিংস: (আগের দিন ৩১৯-৪)

কোহালি হিট উইকেট বো রশিদ ৪০

রাহানে বো আনসারি ১৩

অশ্বিন ক আনসারি বো মইন আলি ৭০

ঋদ্ধিমান ক ব্যারিস্টো বো মইন আলি ৩৫

জাডেজা ক হামিদ বো রশিদ ১২

উমেশ ক স্টোকস বো রশিদ ৫

শামি ন.আ. ৮

অতিরিক্ত ২৬। মোট ৪৮৮ (১৬২ ওভারে)।

পতন: ৬৮, ২৭৭, ৩১৮, ৩১৯, ৩৪৯, ৩৬১, ৪২৫, ৪৪৯, ৪৫৯, ৪৮৮।

বোলিং:

ব্রড ২৯-৯-৭৮-১ ওকস ৩১-৬-৫৭-০

মইন আলি ৩১-৭-৮৫-২ আনসারি ২৩-১-৭৭-২

রশিদ ৩১-১-১১৪-৪ স্টোকস ১৭-২-৫২-১।

ইংল্যান্ড দ্বিতীয় ইনিংস

কুক ন.আ. ৪৬

হামিদ ন.আ. ৬২

অতিরিক্ত ৬। মোট ১১৪ (৩৭ ওভারে)।

বোলিং:

শামি ৬-১-১২-০ জাডেজা ১০-১-৩৩-০

অশ্বিন ১০-২-৩২-০ উমেশ ৫-১-১৩-০

মিশ্র ৬-০-১৯-০

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE