ইডেনেও সিদ্ধিলাভ ঋদ্ধির। শনিবার। ছবি: উৎপল সরকার।
ভুবনেশ্বর কুমারের পাঁচ উইকেট। দশ মিনিটের বৃষ্টিতে আড়াই ঘণ্টা খেলা বন্ধ থাকা।
অন্য কোনও দিন হলে এগুলোই শিরোনামে উঠে আসত। এ দিন কিন্তু আসছে না। আসছে না কারণ, এ দিন সকাল-সকাল আর একটা শিরোনাম শহরকে দিয়ে গিয়েছেন শহরেরই এক ছেলে। দেশের মাটিতে প্রথম টেস্ট হাফসেঞ্চুরি করে গিয়েছেন ঋদ্ধিমান সাহা। টিমকে আড়াইশোর কমে শেষ হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে। ভাল লিড নেওয়ার আশা দেখিয়ে। এবং একটা প্রশ্ন তুলে দিয়ে।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনির যোগ্য টেস্ট উত্তরসূরি কি পেয়ে গেল টিম ইন্ডিয়া?
কিরণ মোরের মতে, একেবারেই। ঋদ্ধিমানের অপরাজিত ৫৪ দেখে মুগ্ধ প্রাক্তন জাতীয় উইকেটকিপার। এবং তিনি মনে করেন, ধোনির উত্তরসূরি হিসেবেই ঋদ্ধিকে দেখছেন জাতীয় নির্বাচকরা। যার জন্য তাঁকে গত দু’তিন বছর টেস্ট টিমের সঙ্গে রাখা হয়েছে। ‘‘ওয়েস্ট ইন্ডিজে ওর সেঞ্চুরি দারুণ ছিল। টেস্টে সেঞ্চুরি করা কম কথা নয়। তা-ও বিদেশে। আর ইডেন হাফসেঞ্চুরি দেখে বলব, অসাধারণ উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান ঋদ্ধিমান। আড়াইশোর কমে সাত উইকেট পড়ে গিয়েছে, পিচ কখন কী করবে জানা নেই, এমন অবস্থায় ওর ইনিংসটা অমূল্য,’’ এ দিন সন্ধেয় ফোনে বলছিলেন মোরে। তাঁর মনে হয়, উইকেটকিপার হিসেবে দলে থিতু হতে পারাটা ব্যাটসম্যান ঋদ্ধির আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে।
শনিবারের ইনিংসে বুদ্ধি আর পরিণত মনন দেখতে পাচ্ছেন বাংলার প্রাক্তন উইকেটকিপার এবং রঞ্জিজয়ী অধিনায়ক। ‘‘প্রথমে ডিফেন্ড করেছে। পরে অ্যাটাক। উল্টো দিকে উইকেট পড়ে গেলেও স্বাভাবিক খেলেছে। যারা বলত ওর কিপিং ভাল কিন্তু ব্যাটিং অতটাও নয়, তাদের আজ দারুণ জবাব দিয়ে দিয়েছে ঋদ্ধি,’’ বলছিলেন সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
দেশের হয়ে খেলা বাংলার আর এক উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান দীপ দাশগুপ্ত আবার আশা করছেন, ধোনি বা অন্য কারও উত্তরসূরি নয়, ঋদ্ধি নিজেকে চেনাবেন ঋদ্ধিমান সাহা হিসেবে। এত উচ্চতায় নিয়ে যাবেন নিজেকে যে, তিনি খেলা ছাড়ার সময় প্রশ্ন উঠবে, পরের ঋদ্ধি আদৌ পাবে দেশ? ‘‘ঋদ্ধি দারুণ ফিট, ওর প্রতিভা আছে। এই পর্যায়ে আত্মবিশ্বাসটা খুব জরুরি। ওয়েস্ট ইন্ডিজে সেঞ্চুরির পর যেটার অভাব ঋদ্ধির হবে বলে মনে হয় না,’’ বলে দীপের আরও ব্যাখ্যা, ‘‘আজকের ইনিংসটা দেখুন না। একটা বল বুকে খেল। একটা কনুইয়ে। এক বারের জন্যেও বুঝতে দিল না যে, ওর লেগেছে। চুপচাপ ব্যাট করে গেল।’’
শিখর ধবন, রোহিত শর্মাদের মতো ফ্ল্যামবয়েন্স তাঁর নেই। বিরাট কোহালির মতো সেকেন্ডে সেকেন্ডে আবেগের লাভাস্রোত বইয়ে দেওয়া তাঁর পক্ষে শুধু অস্বাভাবিক নয়, বোধহয় অসম্ভবও। আর মাঠে শুধু নয়, মাঠের বাইরেও ঋদ্ধিমান বরাবর চুপচাপ। তাঁর স্ত্রী রোমি এ দিনও মাঠে বসে বলছিলেন, ‘‘ওর স্বভাবটাই এ রকম। ওর যে কোনও একটা জিনিস যদি বদলাতে পারতাম, তা হলে চাইতাম ও যাতে আর একটু কথা বলতে পারে!’’
সত্যি, কথাটা একেবারেই বলতে পারেন না ঋদ্ধিমান। নিজেকে নিয়ে তো নয়ই। দিনের সফলতম ব্যাট হিসেবে সাংবাদিক সম্মেলনে এসেও বাকিদের অবদানের কথা বারবার বলে যান। শনিবারের ইনিংসটা নিজের সেরার তালিকায় কোথায় রাখবেন, প্রশ্ন শুনে শুধু বলেন, ‘‘টিমের দরকার ছিল এই ইনিংসটা। রাহানে-পূজারাও তো ভাল করেছে। শামি আর জাডেজার সঙ্গে পার্টনারশিপটা জরুরি ছিল।’’ কিছুটা চাপাচাপির পরে জোড়েন, ‘‘বাকি ইনিংসগুলোর সঙ্গে একসঙ্গেই রাখব। আমার কাছে প্রত্যেকটা ম্যাচ সমান। প্রত্যেকটাকে নর্ম্যালি দেখি।’’ ছয় মেরে হাফসেঞ্চুরি, টিমের রান তিনশো পার করানো— এগুলোর পর টিম কী বলল? ‘‘তার পরপরই তো কিপ করতে নামতে হল, অত কিছুর সময় পাইনি।’’
ঋদ্ধি সময় পাননি, কিন্তু শনিবার শহর তার পুরো সময়টাই যেন ঋদ্ধিকে দিয়ে দিয়েছে। তাঁর ক্লাব মোহনবাগানের এক কর্তা বারবার বলে যাচ্ছেন, এ রকম টেস্ট ক্রিকেটার জীবনে দেখেনি। যিনি টেস্ট খেলে শহরে ফেরার পরের দিন পুরো সময়টা ক্লাব ম্যাচে মাঠে থাকেন শুধু নয়, স্বেচ্ছায় টুয়েলফথ ম্যানের কাজ করে দেন। যিনি আইপিএল ফাইনাল খেলার দিন সকালে ক্লাবে ফোন করে বলেন, পরের দিন সবচেয়ে ভোরের ফ্লাইটে তাঁর টিকিট কেটে রাখতে। ওই দিন শহরে ফিরে এএন ঘোষ ফাইনাল খেলতে হবে যে!
ঋদ্ধিমান সাহার পৃথিবীটা আসলে এ রকমই। সেখানে বাহ্যিক আবেগ নেই, আছে নীরব আত্মবিশ্বাস। নিজেকে তারকা ভাবা নেই, আছে সব কিছু খুব সাধারণ রাখার নিরন্তর চেষ্টা। গরম-গরম শিরোনাম দেওয়া নেই, আছে বিনম্র প্রচারবিমুখতা।
না, ঋদ্ধিমান সাহা কথা খুব একটা বলেন না। ক্রিকেট থেকে জীবন, পুরোটাই যার মুখর, ব্যতিক্রমী বিবৃতি, শব্দ খরচের প্রয়োজন তার আর থাকে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy