Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

স্ত্রী তানিয়ার প্রেরণায় প্রত্যাবর্তন, ইশান্ত-মন্ত্রেই গোলাপি বলে সাফল্য ইডেনে, বলছেন উমেশ

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সদ্য সমাপ্ত সিরিজে দু’টেস্টে সর্বোচ্চ (ইশান্ত শর্মার সঙ্গে যুগ্ম ভাবে) ১২ উইকেট নিয়েছেন। ইডেনে  দ্বিতীয় ইনিংসে নেন পাঁচ উইকেট।

কৃতজ্ঞ: স্ত্রী তানিয়ার উৎসাহেই নেতিবাচক ভাবনা ঝেড়ে ফেলে নতুন মেজাজে ফিরে এলেন  উমেশ যাদব। টুইটার

কৃতজ্ঞ: স্ত্রী তানিয়ার উৎসাহেই নেতিবাচক ভাবনা ঝেড়ে ফেলে নতুন মেজাজে ফিরে এলেন উমেশ যাদব। টুইটার

কৌশিক দাশ 
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৯ ০৪:২২
Share: Save:

প্রায় হারিয়ে যাওয়ার মুখ থেকে দুরন্ত প্রত্যাবর্তন ঘটেছে তাঁর। টেস্ট ক্রিকেটে ভারতীয় আক্রমণের অন্যতম মুখ হয়ে উঠেছেন তিনি। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সদ্য সমাপ্ত সিরিজে দু’টেস্টে সর্বোচ্চ (ইশান্ত শর্মার সঙ্গে যুগ্ম ভাবে) ১২ উইকেট নিয়েছেন। ইডেনে দ্বিতীয় ইনিংসে নেন পাঁচ উইকেট। সেই উমেশ যাদব বুধবার ফোনে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন আনন্দবাজারকে।

প্রশ্ন: মাঝে একটা সময় আপনি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ থেকে দুরন্ত ভাবে ফিরে এসেছেন। ওই সিরিজে দুই টেস্টে ১১ উইকেট নেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও দারুণ সফল। এই প্রত্যাবর্তনের রহস্যটা কী?

উমেশ: রহস্য কিছু নয়। সাফল্যের পিছনে দুটো কারণ। পরিশ্রম আর মানসিকতা। আমি যখন দলের বাইরে ছিলাম, কঠোর পরিশ্রম করে গিয়েছি নিজেকে উন্নত করতে। আর অপেক্ষায় ছিলাম দলে ডাক পাওয়ার। আমি চেয়েছিলাম, টানা কয়েকটা ম্যাচ খেলার সুযোগ। যেটা দক্ষিণ আফ্রিকা আর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পেলাম। টানা চারটে টেস্ট। যেখানে ২৩টি উইকেট নিয়েছি। কঠোর পরিশ্রমের দামটা পেলাম, দলকেও জেতাতে পারলাম। এটাই সব চেয়ে বড় তৃপ্তির।

প্রশ্ন: আপনার এই প্রত্যাবর্তনের পিছনে কে আছেন? বিশেষ কাউকে কি উৎসর্গ করতে চান এই সাফল্য?

উমেশ: আপনি নিশ্চয়ই ওই প্রবাদটা শুনেছেন। প্রত্যেক সফল পুরুষের পিছনে এক জন নারীর ভূমিকা আছে। আমার ক্ষেত্রেও তাই। আমার জীবনের সেই নারী হল স্ত্রী তানিয়া। নিজের উপরে আমার যত না আস্থা, তার চেয়ে অনেক বেশি আস্থা তানিয়ার। আমি যখন দলের বাইরে থাকতাম বা ভাল খেলতে পারতাম না, তখন সব সময় আমার পাশে দাঁড়াত। বলত, উমেশ, তুমি এর চেয়ে অনেক ভাল খেলার ক্ষমতা রাখো। বোঝাত, তুমি পরিশ্রম করে যাও, ফল ঠিক পাবে।

প্রশ্ন: স্ত্রী কী ভাবে সাহায্য করেছেন আপনাকে?

উমেশ: আমি সাদা বলের ক্রিকেট খেলছিলাম না। টেস্ট খেলার সুযোগ আসত অনেক পরে পরে। দল থেকে ছিটকে গিয়েছিলাম। এই সময় অনেক নেতিবাচক চিন্তা ভিড় করে আসে। এই অবস্থায় যে কোনও ক্রিকেটারই মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে। সেই সময় এমন এক জনকে পাশে দরকার, যে আপনাকে সাহস জোগাবে, ভরসা দেবে। সেই কাজটা করেছে তানিয়া। ও কখনও আমার হাত ছাড়েনি। সাহস দিয়েছে লড়াই করার।

প্রশ্ন: তা হলে স্ত্রীই আপনার আসল শক্তি?

উমেশ: সেটা অবশ্যই বলতে পারেন। তানিয়া আমাকে বুঝিয়েছে, আমি বাইশ গজে যা পেয়েছি তার চেয়ে অনেক বেশি অর্জন করার ক্ষমতা রাখি। এমন অনেক দিন গিয়েছে মনটা খারাপ, প্র্যাক্টিসে যেতে ইচ্ছে করত না। কিন্তু ও আমাকে ঠেলে ঠেলে প্র্যাক্টিসে পাঠিয়েছে। আমি বিশ্রাম চাইলেও আমাকে নিতে দেয়নি। আমি এমনিতে খুব বেশি বাইরে ঘোরাঘুরি করি না। প্র্যাক্টিস করি আর ঘরে থাকতেই পছন্দ করি। সে সময় স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে মনটা অনেক হাল্কা থাকত। যা আমাকে মানসিক ভাবে শক্তিশালী থাকতে সাহায্য করেছে। এই সাফল্যের পিছনে অবশ্যই তানিয়ার নাম করতে হবে।

প্রশ্ন: আপনার এই সাফল্যে স্ত্রী নিশ্চয়ই দারুণ খুশি হয়েছে?

উমেশ: অবশ্যই। আমি যত না খুশি হয়েছি, তার চেয়ে অনেক বেশি খুশি হয়েছে তানিয়া। ও তো দেখেছে আমি কতটা পরিশ্রম করেছি ফিরে আসার জন্য।

প্রশ্ন: আপনি ইডেনে একটা ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকলেন। গোলাপি বলের টেস্ট নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতাটা কী রকম?

উমেশ: একটু অন্য রকম অভিজ্ঞতা হল। লাল বলে খেলে খেলে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। সেখানে হঠাৎ করে অন্য রঙের একটা বলে খেলাটা একটু কঠিন ছিল। তা ছাড়া লাল বলের সঙ্গে গোলাপি বলের পার্থক্যও নজরে পড়ল।

প্রশ্ন: সেটা কী রকম?

উমেশ: বলের রংটা তো বটেই, পালিশটাও একটু অন্য রকম। সিমটাও (বলের সেলাই) একটু চওড়া মনে হল। আর একটা ব্যাপার মনে হয়েছে। গোলাপি বলটা লাল বলের তুলনায় একটু বেশি ভারী। কয়েক দিন প্র্যাক্টিস করে সেই সমস্যাগুলো কাটানোর চেষ্টা করেছি।

প্রশ্ন: এর বাইরে ইডেনে আর কোনও সমস্যার সামনে পড়েছিলেন?

উমেশ: রাতের ক্রিকেটে শিশিরে তো একটু সমস্যা হয়ই। শিশিরের জন্য বলটা একটু ভিজে যাচ্ছিল। ওতে বলটা ধরতে একটু সমস্যা হচ্ছিল। তা ছাড়া বেশ মজাই লেগেছে দিনরাতের টেস্ট খেলে। গোধূলির সময় বলটা সুইং করেছে। রাতেও করেছে। সব মিলিয়ে উপভোগই করেছি ব্যাপারটা।

প্রশ্ন: আপনি আর ইশান্ত শর্মা মিলে তো দিনরাতের টেস্টে বাংলাদেশকে শেষ করে দিলেন। আপনারা কি নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করেন বোলিং করার সময়। একে অন্যকে সাহায্য করেন?

উমেশ: অবশ্যই। আমাদের মধ্যে থেকে কেউ যদি ভাল বল করে, তা হলে আমরা গিয়ে তার কাছ থেকে পরামর্শ নিই। জানতে চাই, কী ভাবে এত ভাল বল করছ? আলাদা কী করছ? এই তো কলকাতা টেস্টের কথাই ধরুন না। ইশান্ত খুব ভাল বল করছিল। আমি গিয়ে ওর কাছে পরামর্শ চাই। ইশান্ত বলে, ব্যাটসম্যানের আরও কাছাকাছি বলটা ফেলতে। তা হলে সুইংটা পাব। ইশান্তের পরামর্শ কাজে দিয়েছিল। এই ভাবে আমরা সব সময় একে অন্যকে সাহায্য করি। এতে বোলিং গ্রুপ হিসেবেও আমাদের পারফরম্যান্স ভাল হয়। বিপক্ষকে তাড়াতাড়ি আউটও করে দেওয়া যায়।

প্রশ্ন: ভারত এখন স্পিন শক্তি থেকে পেস শক্তি হয়ে উঠছে। গতির দাপটে নাজেহাল করে দিচ্ছে বিপক্ষকে। এই ব্যাপারটা কী ভাবে দেখছেন?

উমেশ: শুধু গতি বললে কিন্তু ঠিক বলা হবে না। আমাদের বোলাররা সবাই ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার গতির উপরে বল করে ঠিকই, কিন্তু পাশাপাশি বলটা সুইংও করাতে পারে। ওই রকম সুইং, লেংথ এবং গতি— এই তিনের মিশেলেই কিন্তু আমরা এত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছি। আমাদের ভাগ্য ভাল, এই ধরনের পেসার এক সঙ্গে বেশ কয়েক জন উঠে এসেছে।

প্রশ্ন: এই মুহূর্তে ভারতীয় পেস আক্রমণ বিশ্বের অন্যতম সেরা। আপনাদের বিরুদ্ধে খেলতে নেমে ব্যাটসম্যানেরা ভয় পাচ্ছে। এক জন ফাস্ট বোলার হিসেবে ব্যাপারটা কী রকম লাগে?

উমেশ: ব্যাটসম্যানের চোখে ভয় দেখলে কিন্তু এক জন ফাস্ট বোলারের আত্মবিশ্বাসটা অনেক বেড়ে যায়। তখন উইকেট কী রকম বা উল্টো দিকে কে আছে, তা মাথায় থাকে না। বল করার মজাই অন্য রকম হয়ে যায়। ব্যাটসম্যান যখন কোনও এক বোলারকে ছয় মারে, তখন বোঝা যায় ওই বোলার ঘাবড়ে গিয়েছে। ঠিক তেমনই আমরা বুঝে যাই এই ব্যাটসম্যান আমাদের দেখে ভয় পাচ্ছে। দিনের শেষে আমরা তখন নিজেদের বলতে পারি, আজ এমন বল করেছি ব্যাটসম্যানরা ভয় পেয়ে গিয়েছে। এটা কিন্তু অন্য রকম একটা তৃপ্তি।

প্রশ্ন: আপনাদের বলে এখন ব্যাটসম্যান আহত হচ্ছেন। বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসে দু’জন তো মাথায় চোট পেয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ব্যাটসম্যানের মাথায় লাগছে, এটা দেখলে বোলার হিসেবে কি আপনারাও শঙ্কিত হয়ে পড়েন? বিশেষ করে ফিল হিউজের ঘটনার পরে?

উমেশ: হ্যাঁ, অবশ্যই। হিউজের ঘটনা তো ভোলা যাবে না। আর এটাও মাথায় রাখতে হবে, ব্যাটসম্যানকে বাউন্সার দেওয়াটা কিন্তু একটা পরিকল্পনার অংশ। যে ব্যাটসম্যান শর্ট (খাটো লেংথ) বলে সমস্যায় পড়ে, তাকে আউট করার জন্য বাউন্সার দেওয়া হয়। সব সময় আহত করার জন্য শর্ট বল করা হয় না। আমরাও চাই না ব্যাটসম্যানের খুব বেশি চোট লাগুক। আমরা ব্যাটসম্যানকে ভয় দেখাতে চাই অবশ্যই, কিন্তু হাসপাতালে পাঠাতে চাই না।

প্রশ্ন: এখন তো ব্যাটসম্যানদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য ‘কনকাশন সাব’ নিয়ম চালু হয়েছে। মাথায় আঘাত লাগলে খেলা থেকে বেরিয়ে যেতে পারে ব্যাটসম্যান। এই নিয়মটা নিয়ে কী বলবেন?

উমেশ: আগে তো ব্যাটসম্যানদের মাথায় লাগলেও খেলা চালিয়ে যেতে হত। কোনও উপায় ছিল না। এখন খেলা ছেড়েই বেরিয়ে যেতে পারে। এই ব্যাপারটা অবশ্যই ব্যাটসম্যানদের একটা সুবিধে দেয়। এটা পরিষ্কার, আইসিসি এখন ব্যাটসম্যানদের জীবন নিয়ে কোনও ঝুঁকি নিতে চায় না। তবে এক জন ব্যাটসম্যানের কতটা চোট লেগেছে বা উঠে যাওয়ার প্রয়োজন আছে কি না, সেটা চিকিৎসকদের ভাল করে দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

প্রশ্ন: আপনার কি কোনও স্বপ্ন আছে, যা পূরণ করতে চান?

উমেশ: শুধু স্বপ্ন দেখলেই তো হবে না, সেটা পূরণ করার ক্ষমতা থাকা দরকার। আমি স্বপ্ন দেখতেই পারি, ভারতের হয়ে একশোটা টেস্ট খেলব। কিন্তু তার জন্য ফিট থাকতে হবে। ফর্ম ধরে রাখতে হবে। আমার স্বপ্ন যদি বলেন, তা হল, দেশের হয়ে যত বেশি সম্ভব টেস্ট খেলা।

প্রশ্ন: কোচ রবি শাস্ত্রী গত কাল বলেছেন, পরের বছর আইপিএল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। ওই প্রতিযোগিতা দেখেই মোটামুটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দল গড়া হবে। আপনি কি সাদা বলের ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তনের জন্য আইপিএলকে মঞ্চ হিসেবে বেছে নেবেন?

উমেশ: দেখুন, সাদা বলের ক্রিকেট হল এমন একটা খেলা, যেখানে যে কোনও সময় পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে। আমি একটা কিছু করব ভেবে মাঠে নামলাম, কিন্তু ম্যাচে ঠিক তার উল্টোটা হয়ে গেল। পরের আইপিএলে আমার লক্ষ্য থাকবে সেরাটা দেওয়ার। পরিকল্পনাটা ঠিকঠাক কাজে লাগানোর। দেশের হয়ে বিশ্বকাপ খেলতে কে না চায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE