Advertisement
E-Paper

‘আমি উন্মাদ নই, কেন পাল্টাব এই আগ্রাসন’

আক্রমণাত্মক, মেজাজি, ভয়ডরহীন। নানা ভাবে তাঁকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কেরিয়ারের নানা সময়ে প্রবল বিতর্কেও জড়িয়েছেন। আবার অনেকে মনে করেন, এই বেপরোয়া মনোভাব তাঁর সাফল্যের অন্যতম কারণ। আনন্দবাজার-কে দেওয়া দীর্ঘ, একান্ত সাক্ষাৎকারে বিরাট কোহালি এ বার খোলামেলা তাঁর আগ্রাসন নিয়ে। গত এক বছরে ভারতের কোনও সংবাদপত্রকে দেওয়া একমাত্র একান্ত সাক্ষাৎকারের আজ শেষ পর্ব। জীবন কিন্তু শুধুই মাঠের মধ্যে কী করলাম, সেটা নয়। জীবন তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু। জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো দেখলে এই সব রেকর্ড, মাইলস্টোন, পরিসংখ্যানকে খুব ক্ষুদ্র মনে হবে।

সুমিত ঘোষ

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৪:০১
আগ্রাসী: মাঠে এ ভাবেই দল চালাতে দেখা যায় কোহালিকে। —ফাইল চিত্র।

আগ্রাসী: মাঠে এ ভাবেই দল চালাতে দেখা যায় কোহালিকে। —ফাইল চিত্র।

আনন্দবাজার-কে দেওয়া দীর্ঘ, একান্ত সাক্ষাৎকারে বিরাট কোহালি এ বার খোলামেলা তাঁর আগ্রাসন নিয়ে। গত এক বছরে ভারতের কোনও সংবাদপত্রকে দেওয়া একমাত্র একান্ত সাক্ষাৎকারের আজ শেষ পর্ব।

প্রশ্ন: একের পর এক রেকর্ড ভাঙছেন। কিংবদন্তিদের চেয়ে অর্ধেক ম্যাচ খেলে তাঁদের রেকর্ড ধরে ফেলছেন। অধিনায়ক হিসেবেও প্রথম ২৯ টেস্টে সাফল্যের হারে আপনি শুধু স্টিভ ওয় এবং রিকি পন্টিংয়ের চেয়ে পিছিয়ে। এই সব পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে কী অনুভূতি হয়?

বিরাট কোহালি: এগুলো এখন আর আমার জীবনে কোনও পার্থক্য করে না। যে দিন আপনি জেনে গেলেন, সংখ্যা বা পরিসংখ্যান শুধু জীবনের পাঁচ মিনিটের ভাল লাগাই হতে পারে, সে দিন থেকে আর কিছুই তফাত ঘটবে না এ সবে। জীবনেই যেখানে কোনও কিছুর গ্যারান্টি নেই, সেখানে এ সবে কী আলাদা অনুভূতি হতে পারে! সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর আপনি কি জানেন, দিনটা কেমন যাবে? কী বাধা আপনার সামনে আসতে পারে? জানেন না। আর সেই বাধা-বিপত্তিগুলো কিন্তু মাঠে আমরা যা করি, তার চেয়ে শতগুণ বেশি চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।

প্র: বিরাট জীবন দর্শন...অনেকেই এটা মন দিয়ে শুনতে চাইবেন...

বিরাট: জীবন কিন্তু শুধুই মাঠের মধ্যে কী করলাম, সেটা নয়। জীবন তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু। জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো দেখলে এই সব রেকর্ড, মাইলস্টোন, পরিসংখ্যানকে খুব ক্ষুদ্র মনে হবে। আমার মনে হয়, জীবনে ভারসাম্য রেখে চলাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পরিশ্রম করে যাও। যে কাজই করো না কেন, নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করো আর কোনও প্রত্যাশা রেখো না।

প্র: কোনও প্রত্যাশা রাখব না?

বিরাট: না, রাখব না। আমার মনে হয়, প্রত্যাশা হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ জিনিস। কারণ, প্রত্যাশা থেকেই হতাশা আসতে পারে। এই যে পরিসংখ্যানগুলো, এগুলো এখন আমার জন্য খুব ভাল দেখাচ্ছে। এখন যদি আমি এগুলো নিয়ে মাতামাতি করি, তা হলে যখন লোকে আমার পরিসংখ্যান নিয়ে ভাল কথা বলবে না তখন তো হতাশ হয়ে পড়বই। আমি তাই এর থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি। আমি জানি, এটা কঠিন। পরিসংখ্যান, রেকর্ড এগুলো ভাবনায় চলে আসতেই থাকবে। তবু দূরে রাখার চেষ্টা করে যেতে হবে। সেটাই তোমার অনুশীলন।

প্র: সম্প্রতি মাইকেল হাসি আপনার সঙ্গে রিকি পন্টিংয়ের তুলনা করলেন। মাঝেমধ্যে আমাদেরও মনে হয়েছে, তুলনাটা একদম ঠিক। পন্টিংয়ের আগ্রাসী অস্ট্রেলীয় ভঙ্গি কি কখনও আপনাকে প্রভাবিত করেছে?

বিরাট: কখনওসখনও এ রকম দেখা যায় যে, দু’টো মানুষের ভঙ্গি অনেকটা একই রকম। হয়তো সেটাই হয়েছে আমার আর রিকি পন্টিংয়ের ক্ষেত্রে। খুব সচেতন ভাবে ব্যাপারটা ঘটেছে বলে আমার মনে হয় না। আমি অন্যদের কথা শুনে কখনও নিজেকে পাল্টাতে চাইনি। আমি নিজে এখানে বসে তো অন্যদের বলছি না যে, একে এরকম হতে হবে বা তাকে সেরকম হতে হবে। এই জাজমেন্ট দেওয়ার ব্যাপারটা আমি একদম মানি না। যত ক্ষণ আমি দলের হয়ে ১২০ শতাংশ দিচ্ছি, বাকি মতামতে কিছু এসে-যায় না। আমি যদি নিজে পরিশ্রম করা বন্ধ করে দিই, তা হলে সে দিনই অন্যদের প্রশ্ন করার অধিকার আমি হারিয়ে ফেললাম। তার পর আমি চলে গেলাম, ভাগ্যের হাতে। আমি এই ধরনের মনোভাবে বিশ্বাস করি। বাইরের লোকেরা আমাকে কী ভাবে দেখতে চাইছে, সেটা ভেবে আমি চলি না। হতে পারে, রিকি পন্টিংয়ের মনোভাবটাও এরকম ছিল। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার ব্যাপারটায় হয়তো দু’জনের মধ্যে মিল পাওয়া যায়। তবে এটা ঠিক, যেভাবে রিকি পন্টিং অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কত্ব করেছে, সেটা আমার দারুণ লাগত। দেখে মনে হতো, অন্যরা কী বলছে তা নিয়ে ও ভাবছেই না। নিজের বিশ্বাসের উপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখে এগিয়ে চলেছে।

প্র: এই যে বিরাট কোহালিকে অনেকে খুব আক্রমণাত্মক বলে, আপনি নিজে সেটাকে কী ভাবে দেখেন? আর একটা কথাও জিজ্ঞেস করতে চাই। সাম্প্রতিককালে আপনাকে খুব নিয়ন্ত্রিত আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে দেখছি। এটা কি জেনেবুঝে কোনও পরিবর্তন?

বিরাট: একেবারেই কোনও পরিবর্তন নয়। আমার নিজেকে পাল্টানোর কোনও দরকার নেই। আবেগের বহিঃপ্রকাশটা আসলে একটা স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া। যখন যে রকম ভাবে বেরিয়ে আসে, সেটাই দেখতে পান। কখনওসখনও টিমের জন্য বাড়তি কিছু করার দরকার পড়ে, সেটা আলাদা। টিমের স্বার্থের কথা ভেবে, টিমের জয়ের জন্য যা যা করা দরকার, সেটা তো করতেই হবে। আরে বাবা, আমি তো মাঠের মধ্যে গিয়ে মারামারি করছি না। আমি একটা খেলা খেলতে নামছি। আমি উন্মাদ নই যে, মাঠে গিয়ে সকলের সঙ্গে ফাটাফাটি করতে শুরু করে দিলাম। বাইরে থেকে অনেকে বুঝতে পারে না, ভিতরে কী ঘটছে। না জেনেই তারা একজনের উপর ক্যামেরা ফোকাস করতে পারে, তাকে আলাদা করে দেখাতে পারে। এটা নিয়ে আমি কী-ই বা করতে পারি? ওরা ওদের কাজ করছে, আমরা আমাদের কাজ করছি। স্পিরিট নষ্ট না করে টিমের জন্য যা করণীয়, তা আমি করে যাব। কারও কাছে জবাবদিহি করার ব্যাপার নেই। আমি জানি, পদে থাকলে জবাবদিহি করতে হয় অনেক ক্ষেত্রে। কিন্তু এই পদটা তো আমি নিজে চাইনি। আমাকে এই দায়িত্বটা দেওয়া হয়েছে। এবং, আমি লোকটা কে সেটা জেনেবুঝেই তো দায়িত্বটা দেওয়া হয়েছে। আমাকে কেউ অধিনায়কত্বের দায়িত্বটা দেওয়ার সময় বলেনি যে, এই তোমাকে ক্যাপ্টেন্সি দেওয়া হল, এখন থেকে তুমি রোবট হয়ে যাও। বলে দেয়নি, আমরা চাই তুমি এ-ভাবে আচরণ করো। আসলে পুরো ব্যাপারটাই নির্ভর করছে বাকিদের ‘কমফোর্ট জোন’-এর উপর। আমার আক্রমণাত্মক মনোভাব কারও ভাল লাগবে, আবার কেউ কেউ তাতে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে। এই লোকগুলোই প্রশ্ন তুলবে। ওরা বলেই যাবে, এই আগ্রাসনের দরকার নেই। এগুলো শুধুই এই লোকগুলোর বক্তব্য এবং এদের বক্তব্য কোনও জিনিসকে ঠিক বা ভুল করে দেয় না।

তুলনা: পন্টিংয়ের আগ্রাসন মনে করাচ্ছেন বিরাট। —ফাইল চিত্র।

প্র: স্বপ্ন কী বিরাট?

বিরাট: স্বপ্ন পাল্টাতে থাকে। আমার তো সে-রকমই মনে হয়। এই মুহূর্তে যদি জিজ্ঞেস করেন, স্বপ্ন একটাই। জীবনে সুখী হওয়া। প্রত্যেকটা দিন সুখে কাটানোটাই লক্ষ্য। দশ বছর আগে কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করত এখানে ভারত অধিনায়ক হিসেবে বসে থাকতে পারি কি না, বলতাম, নো চান্স। দশ বছর আগে যদি কেউ বলত আমি দেশের হয়ে এই পরিমাণ রান করব, সেঞ্চুরি করব, অলৌকিক বলে উড়িয়ে দিতাম। সেই কারণেই এখন স্বপ্ন হচ্ছে জীবনের প্রত্যেকটা দিন সুখে কাটানো। জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকো, মাতামাতিতে ভেসে যেও না, খ্যাতি থেকে দূরে থাকো, অন্যদের সাহায্য করতে থাকো এবং আরও বৃহত্তর লক্ষ্যের জন্য পরিশ্রম করে যাও। দশ বছর আগে আমি জানতামই না, কখনও ভারতের হয়ে খেলব কি না। আজ দেশের ক্যাপ্টেন হিসেবে এখানে বসে আছি। এখনও পর্যন্ত জীবন দারুণ কেটেছে। তাই কৃতজ্ঞ থেকে দায়িত্ব পালন করে যেতে চাই। অধিনায়ক থাকি বা না থাকি, নিজের কাজ করে যেতে চাই। পরিশ্রম করে যেতে চাই। সুখী থাকতে চাই, ভাল মানুষ হতে চাই।

প্র: অনেক ক্রিকেট রয়েছে সামনে। বিদেশের মাঠে বেশির ভাগ ম্যাচ খেলতে হবে। আগামী এক বছর নিয়ে অধিনায়কের পরিকল্পনা কী?

বিরাট: পরিকল্পনা একটাই। যেখানেই খেলি, নিজেদের সেরাটা দেওয়া। ১২০ শতাংশ দেওয়া। আর সেটা করা সম্ভব হবে যদি নিজেদের সেরা ফিটনেসে আমরা পৌঁছতে পারি। আমাদের সবচেয়ে ফিট হতে হবে। মাঠে ক্রিকেটার শুধু নয়, আমরা অ্যাথলিট চাইছি। না হলে লড়াই করা কঠিন হবে। স্কিল একটা পর্যায় পর্যন্ত আপনাকে দেখবে, তার পর কিন্তু ফিটনেস। এখনকার ক্রিকেট বিশ্বে ফিট না হলে পাল্লা দেওয়া কঠিন। পরের দু’বছর আমাদের জীবনের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হতে যাচ্ছে— এ-ভাবে আমরা ভাবছি না। বিদেশে অনেক সিরিজ রয়েছে, সে-ভাবেও দেখছি না। আমরা প্রত্যেকটা ম্যাচকে ম্যাচ হিসেবে দেখছি। দেশে না বিদেশে— সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ম্যাচ মানে ম্যাচ। আমরা এখন জানি টেস্ট ম্যাচ কী ভাবে জিততে হয়। সেটাকে মাথায় রেখে নিজেদের সবচেয়ে ভালভাবে তৈরি রাখতে হবে।

(শেষ)

Cricket Virat Kohli Ricky Ponting interview Team India বিরাট কোহালি
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy