Advertisement
E-Paper

স্বপ্ন তৈরির কারখানায় ধ্বংস স্বপ্ন

ব্রাজিলে একটা প্রবাদ আছে। প্রত্যেকেই জন্ম নেয় ফ্ল্যামেঙ্গোর ভক্ত হিসেবে। তার পর বড় হয়ে তাদের কেউ কেউ অন্য দলের অনুরাগী হয়ে উঠতে পারে।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:৩৫
প্রার্থনা: মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডে মৃত ফুটবলারদের শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ফ্ল্যামেঙ্গো ক্লাবের গেটে সমর্থকরা। এএফপি

প্রার্থনা: মর্মান্তিক অগ্নিকাণ্ডে মৃত ফুটবলারদের শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ফ্ল্যামেঙ্গো ক্লাবের গেটে সমর্থকরা। এএফপি

ব্রাজিলে একটা প্রবাদ আছে। প্রত্যেকেই জন্ম নেয় ফ্ল্যামেঙ্গোর ভক্ত হিসেবে। তার পর বড় হয়ে তাদের কেউ কেউ অন্য দলের অনুরাগী হয়ে উঠতে পারে। বহুল প্রচলিত এই প্রবাদ থেকেই বুঝে নিতে সমস্যা হয় না যে, ব্রাজিলের মতো ফুটবল-পাগল দেশের হৃৎপিণ্ড এই ক্লাব। যেখানে বড় হয়েছে জিকো, রোনাল্ডিনহোদের মতো প্রতিভা। শুক্রবার যেখানে আগুন লেগে দশ খুদে ফুটবলারের মৃত্যুর খবরে গোটা দেশে শোকের আবহ ছড়িয়ে পড়েছে।

অথচ যাত্রার শুরুতে ফুটবল ছিল না তাদের কর্মসূচিতে। ১৮৯৫ সালে ফ্ল্যামেঙ্গোর জন্ম রোয়িং ক্লাব হিসেবে। কয়েক বছর পরে ফুটবল চালু করলেও তা সীমাবদ্ধ রেখে দিয়েছিল উচ্চবিত্তদের মধ্যে। ১৯৩০ থেকে ব্রাজিলের সমাজ ও সংস্কৃতি পাল্টাতে শুরু করল। সাম্বা শিল্পীরা জাতীয় নায়ক হয়ে উঠছেন তখন। ফ্ল্যামেঙ্গো কর্তারা বুঝলেন যে, সময় পাল্টাচ্ছে ব্রাজিলে। তাঁরাও তাই বুদ্ধি করে পরিবর্তন আনলেন। উচ্চবিত্তদের ক্লাব থেকে তাঁরা ফ্ল্যামেঙ্গোকে করে দিলেন ব্রাজিলের সর্বসাধারণের ফুটবল পাঠশালা। তিন জন কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলারকে সই করিয়ে জনতার ক্লাব হিসেবে পথ চলা শুরু করল ফ্ল্যামেঙ্গো।

সেই যে গোটা ব্রাজিল জুড়ে জন্ম নিল একটি ক্লাবকে ঘিরে আবেগের খরস্রোত, তা আজও চলছে। দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তে রেডিয়ো সম্প্রচার করা শুরু করল ফ্ল্যামেঙ্গোর ম্যাচ। যত এগোল সময়, জনতার জীবনের সঙ্গে মিশে যেতে থাকল একটি ফুটবল ক্লাব। এখনও ব্রাজিলে রিয়ো দে জেনেইরো থেকে অনেক মাইল দূরের মাঠও ভর্তি হয়ে যায় ফ্ল্যামেঙ্গো খেলতে আসছে শুনলে। ব্রাজিলের ফুটবল ভক্তদের মধ্যে খুব পরিচিত স্লোগান হচ্ছে— যা ঘটে ফ্ল্যামেঙ্গোতে, ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। সেই কারণেই শুক্রবার ক্লাবের ডরমিটরিতে আগুন লেগে দশ খুদে ফুটবলারের মৃত্যুর দুঃসংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পরে দ্রুতই তা জাতীয় বিপর্যয়ের আকার নিয়ে ফেলে।

নীতি পাল্টে উচ্চবিত্তদের ক্লাব থেকে যে দিন ফ্ল্যামেঙ্গোকে জনতার সম্পদ করে দেওয়া হল, সে দিন থেকেই তৈরি হচ্ছে জাতীয় আবেগ। ব্রাজিলের শ্রমিক শ্রেণি এবং কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতিনিধিত্বের কারণেই ক্লাবকে বলা হয় ‘উরুবু’। অর্থাৎ শকুন। ফ্ল্যামেঙ্গোর ট্রেনিং সেন্টার, যেখানকার ডরমিটরির ভিতরে শুক্রবার অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গিয়েছে দশ কিশোর ফুটবলার, তাকে বলা হয় ‘নিনো দু উরুবু’। অর্থাৎ ‘ভালচার্স নেস্ট’। বাংলায় ‘শকুনের বাসা’।

বর্ণবিদ্বেষের প্রতি কটাক্ষ করেই এমন বলা হয় সম্ভবত। কোথায় একটা আত্মগর্ব কাজ করে যেন ব্রাজিলীয় জনতার মধ্যে। তুমি ফ্ল্যামেঙ্গো মানে তুমি ব্রাজিলীয়। তুমি সেই নিপীড়িত, সেই শাসিত— যে এক দিন দুনিয়া জয় করে উদাহরণ হবে। ব্রাজিলীয় ফুটবল সাম্রাজ্যের যতই পতন ঘটে থাকুক, ফ্ল্যামেঙ্গোর স্লোগানে কোনও তারতম্য ঘটেনি। তারা এখনও সগর্ব বলে চলে, ‘ব্রাজিলের ফুটবল তারকা তৈরি হয় আমাদের ঘরে’। পেপ গুয়ার্দিওলা থেকে শুরু করে জোসে মোরিনহো, আর্সেন ওয়েঙ্গার থেকে য়ুর্গেন ক্লপ— যে কোনও বিশ্বসেরা কোচের সব চেয়ে বেশি ‘স্পটার’ এখনও ছড়িয়ে থাকে ব্রাজিলের মাঠে। কিশোর বয়স থেকেই প্রতিভা তুলে আনার জন্য। দেখা যাবে সেই সব প্রতিভার সিংহভাগই হয়তো ফ্ল্যামেঙ্গোয় ফোটা ফুল। সাম্প্রতিককালের সব চেয়ে বড় উদাহরণ ভিনিসিয়াস জুনিয়র। যাঁকে রেকর্ড অর্থে তুলে নিয়ে গেল রিয়াল মাদ্রিদ। তিনিও ফ্ল্যামেঙ্গোর কারখানায় তৈরি হয়েছেন। নিজের ক্লাবে আগুনের খবরে যিনি মর্মাহত।

ফ্ল্যামেঙ্গোর স্বর্ণযুগ জিকো খেলার সময়। ক্লাবের সর্বকালের সেরা তারকা মানা হয় তাঁকেই। সত্তর এবং আশির দশকে জিকোর নেতৃত্বে ক্লাবের আন্তর্জাতিক পরিচিতি পাওয়া শুরু। ১৯৮১-তে জাপানে ইউরোপ এবং দক্ষিণ আমেরিকার চ্যাম্পিয়নদের মুখোমুখি হওয়ার ম্যাচে লিভারপুলকে হারায় তারা। ক্লাবের ইতিহাসে যা সব চেয়ে উজ্জ্বল দিনগুলোর একটা হিসেবে থেকে গিয়েছে। এর পরেও যদিও আর্থিক সমস্যার কারণে বিশ্ব মঞ্চে কোনও বার্সেলোনা বা রিয়াল মাদ্রিদ বা ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড হয়ে উঠতে পারেনি ফ্ল্যামেঙ্গো। ১৯৯০-এর শুরুর দিকে এমনই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে তারা যাচ্ছিল যে, এক সোনার ছেলেকে অসহায়ের মতো ক্লাব থেকে বেরিয়ে যেতে দিল। তাঁর নাম? বড় রোনাল্ডো! পরে যিনি দেশকে বিশ্বকাপও উপহার দিলেন।

কিন্তু পুরনো সমস্যা এবং বাধাবিঘ্নকে সরিয়ে সম্প্রতি যেন ব্রাজিলের সব চেয়ে বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় ফুটবল ক্লাব আবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। নতুন করে প্রচুর টাকার লগ্নি করা হয়েছিল ‘নিনো দু উরুবু’ ট্রেনিং সেন্টারে। যেখানে ক্লাবের প্রথম দলের অনুশীলনের পাশাপাশি ভবিষ্যতের তারকা তৈরির কারখানা ফের ঝলমলিয়ে উঠছিল। অ্যাকাডেমি থেকে বেশ কিছু উজ্জ্বল শিক্ষার্থীও বেরোতে দেখা যাচ্ছিল। তার মধ্যে এক জন লুকাস পাকেত্তা। যিনি এ সি মিলানে ঝড় তুলতে শুরু করেছেন। অন্য জন ভিনিসিয়াস জুনিয়রকে ইতিমধ্যেই রিয়াল মাদ্রিদে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর যোগ্য বিকল্প বলা হচ্ছে। দু’জনেই ফ্ল্যামেঙ্গোর ফুটবল কারখানার ফসল এবং শুক্রবার যেখানে বিধ্বংসী আগুন কেড়ে নিল দশটি কিশোর প্রাণ, সেই ডরমিটরি তাঁদের খুবই পরিচিত।

কত দিন, কত সময় তাঁরা কাটিয়েছেন এই ট্রেনিং সেন্টারে! পাকেত্তা যেমন। ডরমিটরি সংলগ্ন সেই ব্রিজ কী ভাবে ভুলবেন? যে ব্রিজের উপর দিয়ে তাঁর মা হাঁটিয়ে নিয়ে এসে রোজ মনে করিয়ে দিতেন, ‘‘আমি এত দূর তোমাকে নিয়ে এসেছি। বাকি পথটা কিন্তু তোমাকে পেরোতে হবে।’’ কে জানত নির্মম নিয়তি অপেক্ষা করে আছে সেই ডরমিটরি আর ব্রিজকে ধ্ব‌ংসাবশেষে পরিণত করার জন্য!

জীবন ভাঙা-গড়ার খেলার পৃথিবীতে কেউ নিশ্চয়তা দিতে পারবে না যে, শুক্রবারের আগুনে মৃত দশ কিশোর বড় হয়ে দারুণ নাম করতই। বরং এটাই সত্যি যে, অ্যাকাডেমি থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়ে বেরোবে হাতে গোনা কয়েক জনই। অনেকেই চলার পথে হারিয়ে যায়। তবু ওই দশ জনের মধ্যে অনেকে আশায় ছিল ১৫ বছর বয়সি গোলকিপার ক্রিশ্চিয়ান এসমারিয়োকে নিয়ে। ইতিমধ্যেই তাকে ব্রাজিলের অনূর্ধ্ব-১৭ দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ডাকা হয়েছিল। ইউরোপের স্পটারদের কৌতূহলী নজর ছিল

তার দিকে।

স্বপ্ন নিয়ে রোজ রাতে শুতে যাওয়ার অধিকার ছিল প্রতিভাবান এসমারিয়োর। শুক্রবারও নিশ্চয়ই ঘুমের মধ্যে ব্রাজিলের উজ্জ্বল সেই জার্সি গায়ে হলুদ পাখি হয়ে ফুটবল আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছিল সে। জানতেও পারেনি লেলিহান অগ্নিশিখা কখন তার বালিশে হানা দিয়েছে!

Football Death Flamengo Footballer Fire Chicago Fire Soccer Club
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy