বছর সাতেক আগের কথা। ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ভারতের ঠিক এক ধাপ উপরে ছিল উজ়বেকিস্তান। ভারতের মতোই সে দেশের ফুটবলও অন্তর্দ্বন্দ্বে দীর্ণ ছিল। মাঝের সাত বছর সব বদলে দিয়েছে। উজ়বেকিস্তান শুধু র্যাঙ্কিংয়ে তরতর করে উপরের দিকেই ওঠেনি, কিছু দিন আগে প্রথম বার ফুটবল বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতাও অর্জন করে নিয়েছে। ছ’বছর আগে ৯৯তম স্থানে থাকা জর্ডনও পরের বছর বিশ্বকাপ খেলবে। আর ভারত? নামতে নামতে তারা এখন ১২৭-এ। তাইল্যান্ডের মতো অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশের কাছেও হারতে হয়েছে। মঙ্গলবার হংকংয়ের কাছে জঘন্য ফুটবল খেলে হারতে হয়েছে। এশিয়ান কাপে খেলাও এখন দূর গ্রহের মতো দেখাচ্ছে।
গত একটা বছর বাংলার ফুটবলের জন্য তুলনামূলক ভাল গিয়েছে। মোহনবাগান যেমন আইএসএল-এর লিগ-শিল্ড এবং কাপ জিতেছে, তেমন বাংলা জিতেছে সন্তোষ ট্রফি। ইস্টবেঙ্গল জিতেছে মহিলাদের আই লিগ। বাংলার ফুটবলের তথাকথিত ‘সুসময়’ হলেও ভারতীয় ফুটবল নিয়ে সাধারণ সমর্থক থেকে বিশেষজ্ঞদের আশা ক্রমশ কমছে। কয়েক বছর আগেও যে উদ্দীপনা দেখা যেত, এখন আর তা নেই। জাতীয় দলের খেলা নিয়েও উৎসাহ নেই কারও। উত্তর-পূর্বের রাজ্যের মানুষেরা ফুটবলপাগল বলে খ্যাত। সেখানেও ভারতের ম্যাচ দেখতে এসেছিলেন মাত্র কয়েক হাজার!
গত কয়েক বছর ধরে এই অধঃপতন চলছে। কোচের পর কোচ আসছেন। কিন্তু সকলেই ব্যর্থ। যত রমরমা আইএসএল-এর। কিন্তু সেখান থেকে কোনও ফুটবলার উঠে আসছেন না, যিনি ভবিষ্যতে স্বপ্ন দেখাতে পারেন। সুনীল ছেত্রীর মতো চল্লিশের কোঠা ছুঁয়ে ফেলা ফুটবলারকে জাতীয় দলের হয়ে গোল করার জন্য অবসর ভেঙে ফিরতে হচ্ছে। বিস্ময়কর! অধঃপতনের কারণ অবশ্য একাধিক।
তৃণমূল স্তরে ফুটবলার খোঁজায় ব্যর্থতা এবং দুর্বল পরিকাঠামো
ফুটবলবিশ্বের সফল দেশগুলির সাফল্যের নেপথ্যে কারণ খুঁজতে গেলে একটি জিনিস অবধারিত— শক্তিশালী তৃণমূল স্তর। অর্থাৎ, খুব ছোট বয়স থেকে ফুটবলার তুলে আনা এবং তাদের দেখাশোনার কাজ। এখানেই সবচেয়ে পিছিয়ে ভারত। এ দেশের ফুটবলে না আছে তৃণমূল স্তর থেকে ফুটবলার তুলে আনার উৎসাহ, না আছে প্রতিভা খোঁজার জন্য ‘স্কাউট’। না আছে ভাল মানের অ্যাকাডেমি, না আছে উন্নত মানের কোচিং। কোনও খুদে শিক্ষার্থী বড় ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও সঠিক পরিকাঠামো এবং যন্ত্রপাতির অভাবে তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। ইদানীং আইএসএল-এর বিভিন্ন দল খুব মন দিয়ে অ্যাকাডেমির কাজ করছে। পঞ্জাব, ওড়িশা, মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল যুব ফুটবলের দিকে বেশি করে নজর দিচ্ছে। কাজ করছে রিলায়্যান্সও। ফেডারেশনের এলিট অ্যাকাডেমিগুলিও উদ্যোগ নিচ্ছে ভাল কিছু করার। তা সত্ত্বেও সামগ্রিক চিত্র খুব ভাল নয়। ঠিকঠাক কাজ হলেও ফল পেতে অনেক সময় লাগবে।
আরও পড়ুন:
ঘরোয়া লিগে লড়াই নেই
আইএসএল-এ কোটি কোটি টাকা ওড়ে। সাধারণ মানের ফুটবলারেরাও বিরাট বেতন পান। তবে তাতে ভারতীয় ফুটবলের কোনও উন্নতি হয় না। কারণ, বেশির ভাগ দলেই সাফল্যের নেপথ্যে বড় ভূমিকা থাকে বিদেশি ফুটবলারদের। বেশি বেতন তাঁরাই পান। বিদেশি নির্ভরতার কারণে দেশীয় ফুটবলারেরা নিজেদের প্রমাণ করার যথেষ্ট সুযোগও পান না। দ্বিতীয় সারির প্রতিযোগিতা আই লিগে তবু কিছু দল রয়েছে, যাদের অর্থ কম থাকায় তারা দেশীয় ফুটবলার খেলানোর চেষ্টা করে। সেখানে খুঁজলে প্রতিভাবান ফুটবলার পাওয়া গেলেও যেতে পারে। তবে সে কাজ করার কেউ নেই। আইএসএল-এ এখনও অবনমন চালু না হওয়ায় খেলোয়াড়দের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক মানসিকতার অভাব রয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে গেলে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন ভারতীয় ফুটবলারেরা।

সুনীল ছেত্রীর (মাঝে) সঙ্গে দুই সতীর্থ রাহুল ভেকে (বাঁ দিকে) এবং ফারুখ চৌধরি। —ফাইল চিত্র।
ফেলো কড়ি, মাখো তেল
ভারতের ঘরোয়া লিগ চলে ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি মডেলে। যেখানে উত্তরণ-অবনমনের (প্রোমোশন-রেলিগেশন) কোনও ব্যাপার নেই। গোটা বিশ্বের ফুটবল যে পদ্ধতিতে চলে, ভারতে তার উল্টো! ফলে ডেম্পো, চার্চিল ব্রাদার্সের মতো ভারতীয় ফুটবলের ঐতিহ্যশালী দলগুলো এখনও প্রথম সারির আইএসএল-এ খেলতে পারেনি। এখানে দুটোই বিকল্প— হয় আই লিগ জিতে এসো, নয় টাকা দিয়ে খেলো। মিনার্ভা অ্যাকাডেমির কর্ণধার রঞ্জিত বজাজ ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছেন, “১০০ কোটি টাকা খরচ করব, সব ট্রফি জিতব। তার পরেও আইএসএল-এ খেলতে পারব না! তা হলে টাকা নষ্ট করে লাভ কী?” আইএসএল ক্লাবগুলিকে প্রতি বছর ‘ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি ফি’ বাবদ ১২-১৬ কোটি টাকা দিতে হয়। বদলে তারা লিগের লভ্যাংশ পায়। আই লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে আইএসএল-এ যোগ্যতা অর্জন করলে সেই ‘ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি ফি’ দিতে হয় না। তবে লভ্যাংশও পাওয়া যায় না। ২০২৩ সালে পঞ্জাব এফসি আই লিগ থেকে আইএসএল-এ আসার সময় ‘ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি ফি’ দিয়েছিল। ফলে তারা লভ্যাংশও পেয়েছে। ২০২৪-এ মহমেডান ‘ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি ফি’ দেয়নি, লভ্যাংশও পায়নি। দিন দিন খেলোয়াড়দের বেতন বাড়ছে। ক্লাব চালাতেও প্রচুর খরচ। লাভ না থাকলে দীর্ঘ দিন ক্লাব চালানো মুশকিল। এফসি পুণে সিটি, দিল্লি ডায়নামোজ়ের মতো ক্লাব উঠে গিয়েছে। হাতবদল হয়েছে হায়দরাবাদ এফসি-রও।
ইউরোপে বিষয়টা আলাদা। যেমন, প্রিমিয়ার লিগে উঠে লিড্স ইউনাইটেড আয় করেছে ভারতীয় মুদ্রায় ৫০০ কোটি টাকা। শুধু চ্যাম্পিয়ন্স লিগের যোগ্যতা অর্জন করলেই ১৭০ কোটি টাকা আয় করা যায়। ডেম্পোর সিইও প্রদ্যুম্ন রেড্ডি বলছেন, “ইংল্যান্ডে প্রিমিয়ার লিগে সবার শেষে থাকা দলও ১০০০ কোটি টাকা পায় সম্প্রচার এবং বোনাস থেকে। ওই অর্থ পরিকাঠামো, খেলোয়াড় এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার জন্য খরচ করা যায়।” ভারতে সে সব নেই। আইএসএল-এর লাভ আসে স্পনসরশিপ, সম্প্রচার স্বত্ব এবং ম্যাচের দিন টিকিট বিক্রি থেকে। কিন্তু পারফরম্যান্সের জন্য আলাদা অর্থ না থাকায় কোনও দলই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে না।
খারাপ কোচ, ঘন ঘন কোচ বদলের নেতিবাচক প্রভাব
গত দেড়-দু’দশক ধরে ভারতীয় ফুটবল পুরোপুরি বিদেশি কোচের উপর নির্ভরশীল। দেশীয় কোচেদের মান দিন দিন খারাপ হয়েছে। আন্তর্জাতিক ফুটবলের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য ভারতীয় কোচেদের কৌশল, তথ্যনির্ভর অনুশীলন এবং প্রতিটি ফুটবলার ধরে ধরে তার দিকে আলাদা নজর দেওয়া দেখা যাচ্ছে না। অনেকে বড়াই করে বলেন, দেশীয় কোচেদের অমুক ডিগ্রি, তমুক ডিগ্রি রয়েছে। কিন্তু আধুনিক ফুটবলে মস্তিষ্কের পাশাপাশি এখন যে ভাবে নিত্যনতুন প্রযুক্তির আমদানি হচ্ছে, তার সঙ্গে যে তাঁরা পরিচিত নন, সেটা মেনে নিলেই ভাল। ডিগ্রির বড়াই করা কোচেরা বরং শিক্ষা নিতে পারেন আইপিএল-এর দলগুলির থেকে। দেখতে পারেন সেখানে কী ভাবে দলের কৌশল ঠিক করার জন্য সঠিক প্রযুক্তি এবং ব্যক্তিবিশেষের উপর নির্ভর করা হয়। এ ছাড়াও, খারাপ ফল হলেই কোচ বদলের রোগ ভারতীয় ফুটবলকে আরও তলানিতে নিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নেওয়া এক ফুটবলার আনন্দবাজার ডট কমকে বলেছেন, “আমি খেলার সময় বব হাউটন ছিল। তার পর উইম কোভারমার্স এসেছিল। সেখান থেকে স্টিফেন কনস্ট্যানটাইন, ইগর স্তিমাচ ঘুরে এখন মানোলো মার্কেজ়। এত ঘন ঘন কোচ বদলালে খেলোয়াড়েরা মানিয়ে নেবে কী করে? যে কোচই আসুন, তাঁর নিজস্ব দর্শন থাকবে। যতই কঠিন হোক সেই দর্শন, ফুটবলারদের তার সঙ্গে মানিয়ে নিতেই হবে। একটা সুনির্দিষ্ট মডেল তৈরি না হলে মুশকিল।”

হংকংয়ের বিরুদ্ধে মঙ্গলবারের ম্যাচে ভারতের ফুটবলার লালিয়ানজুয়ালা ছাংতে। ছবি: ফেসবুক।
টেকনিক্যাল দক্ষতা নেই, রয়েছে শারীরিক অক্ষমতা
ভারতে ফুটবলারদের এত দেরিতে তুলে আনা হয় যে, দেশের হয়ে সুযোগ পেতে পেতে অনেক সময় চলে যায়। শেষ কবে ভারতীয় দলে ২০ বছরের কমবয়সি ফুটবলারের অভিষেক হয়েছে, তার উত্তর চট করে দেওয়া যাবে না। ফুটবলশাস্ত্র বলে, অন্তত ছ’বছর বয়স থেকে কোচিং শুরু হওয়া উচিত। শুধু খেলাধুলো নয়, সেই খুদেদের সচেতন করা উচিত ক্রীড়াবিজ্ঞান, পুষ্টি এবং ফিটনেস নিয়েও। উঠতি ফুটবলারেরা কী ভাবে নিজেদের পেশি শক্তিশালী করতে পারে, দেহের কোথায় জোর বেশি দরকার, কী ভাবে শারীরিক জোরে বাকিদের টেক্কা দেওয়া যাবে— এ সবই শেখাতে হবে ছোটবেলা থেকে। ভারতে বেশির ভাগ ফুটবলার আসেন দরিদ্র পরিবার থেকে। তাঁদের জন্য সবচেয়ে আগে প্রয়োজন সঠিক পুষ্টি। আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকার দেশগুলির খেলোয়াড়েরাও দরিদ্র পরিবার থেকে আসেন। কিন্তু জিনগত ভাবে তাঁদের পেশির গঠন শক্তিশালী। যা ভারতে হয় না। আন্তর্জাতিক স্তরে টিকে থাকতে গেলে শারীরিক সক্ষমতা দরকার। ফুটবলে ক্রীড়াবিজ্ঞানের গুরুত্ব এখানেই। প্রাক্তন ফুটবলার মেহতাব হোসেনের কথায়, “আমাদের অনেক ফুটবলারের মধ্যে টেকনিক রয়েছে। কিন্তু শারীরিক অক্ষমতার জন্য তারা মার খেয়ে যাচ্ছে। আবার শারীরিক সক্ষমতা থাকলেও অনেকের টেকনিক নেই। এই সামঞ্জস্যটা দরকার। দুটো এক জায়গায় না এলে উন্নতি হবে না। আপাতত আশার আলো দেখছি না।”
বিদেশে খেলতে যাওয়ায় অনীহা
এশিয়ায় জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরানের মতো শক্তিশালী দেশগুলি নিয়মিত নিজের দেশের ফুটবলারদের ইউরোপে খেলতে পাঠায়। ইউরোপের ক্লাবে তৃতীয় সারিতে খেলেও যে উপকার হয়, এশিয়ার ক্লাবে প্রথম সারিতে তা হয় না। এই মনোভাব ভারতে নেই। এখানে দেশের লিগে এত টাকা, যে বিদেশে খেলতে যাওয়ার আগ্রহ দেখায় না কেউ। বিদেশে টাকা কম, থাকা-খাওয়ার খরচ বেশি হলেও যে শিক্ষা পাওয়া যায় তা ভারত কেন, এশিয়ার সেরা দেশে খেলেও পাওয়া যাবে না। এত কিছু জানা সত্ত্বেও গুরপ্রীত সিংহ সান্ধুর মতো গোলকিপার নরওয়ের প্রথম সারির ক্লাব স্টেবায়েকে খেলেও ভারতে ফিরে আসেন বেশি অর্থের জন্য। মিনার্ভা অ্যাকাডেমির কর্ণধার বজাজ বলছিলেন, “যে দিন ভারতের অন্তত ১০ জন খেলোয়াড় বিদেশে খেলবে, সে দিন আমরা বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন দেখতে পারি। কিন্তু ওরা বিদেশে যাবে না। কারণ, এখানে ১০০ গুণ বেশি টাকা পাচ্ছে।”
মেন্টাল কন্ডিশনিং এবং চাপ সামলানোর দক্ষতা
ফিটনেস এবং টেকনিকের পাশাপাশি ফুটবলে মানসিক জোরও জরুরি। আধুনিক ফুটবলে শুধু দক্ষতা থাকলে হয় না। ঠান্ডা মাথা, বুদ্ধি এবং মানসিক কাঠিন্য দরকার। ভারতের ফুটবলারদের মধ্যে মানসিক কাঠিন্যের অভাব। চাপের মুখে তাঁরা ভেঙে পড়েন। এশিয়ান কাপের যোগ্যতা অর্জন পর্ব বা সাফ ফাইনালের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। জাতীয় দলে সর্ব ক্ষণের ক্রীড়া মনোবিদ এবং পারফরম্যান্স কোচ নিয়োগ না করলে এই খামতি যাবে না। নিয়মিত ব্যবধানে মনোবিদের কাছে গিয়ে নিজেদের মানসিক অবস্থার কথা জানাতে হবে ফুটবলারদের। যতই দক্ষতা এবং টেকনিক থাকুক, মানসিকতা সঠিক না হলে সফল হওয়া সম্ভব নয়।
অর্থহীন ফ্রেন্ডলি ম্যাচ, আন্তর্জাতিক স্তর সম্পর্কে অজ্ঞতা
গত কয়েক বছর ভারতীয় দল যে সব দেশের বিরুদ্ধে খেলেছে, তারা হয় ভারতের থেকে ক্রমতালিকায় সামান্য উপরে বা নীচে। এতে কোনও দিন বড় মাপের প্রতিযোগিতায় খেলার জন্য তৈরি হওয়া যায় না। র্যাঙ্কিংয়ে যত উপরের দিকে থাকা দলের বিরুদ্ধে ভারত খেলবে, তত ভাল। খেলতে হবে প্রথম সারির প্রতিযোগিতায়। দরকারে বিদেশে শিবির করতে হবে। তাতে গতি, টেকনিক এবং পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াও শেখা যাবে। ভাল দলের বিরুদ্ধে খেলা জরুরি। ২০২৩ সাল থেকে ভারত ধারাবাহিক ভাবে ভাল খেলতে পারছে না। ২০২৪ সালে একটিও ম্যাচ জিততে পারেনি। সাম্প্রতিক ম্যাচগুলো দেখে মনে হয়েছে, না আছে টেকনিক্যাল দক্ষতা, না আছে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া। ফুটবলাররা কেউ নিজেদের ভূমিকার কথা জানেন না। মঙ্গলবার যে হংকংয়ের বিরুদ্ধে ভারত খেলল, তারা কিছু দিন আগে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে। আর ভারত প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছে বাংলার রাজ্য দল এবং উত্তর ২৪ পরগনা জেলা দলের সঙ্গে!
ফেডারেশনের অপেশাদারিত্ব
ষাট বা সত্তরের দশকে এশিয়া দাপাত ভারতীয় ফুটবল। তার পর ক্রমশ পিছিয়ে পড়েছে তারা। যার মূল কারণ অপেশাদারিত্ব। একের পর এক ‘ভিশন’, ‘টার্গেট’ প্রকল্প চালু হয়েছে। কোনওটিই বাস্তবায়িত হয়নি। ফেডারেশনের কাজকর্মে পেশাদারিত্ব দেখা যায়নি। ফুটবলের বাণিজ্যিকীকরণ কী ভাবে করতে হয়, সেটাই শিখে উঠতে পারেনি তারা। বিভিন্ন পদে থাকা কর্তা, বকলমে রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার লড়াই, সঙ্কীর্ণ ভাবনাচিন্তা, দুর্নীতিতে শেষ হয়ে গিয়েছে ফেডারেশনের কাঠামো। এখন ফেডারেশনের হাতে টাকা বা সামান্য হলেও পরিকাঠামো রয়েছে। জাপান, কোরিয়ার মতো দেশ রয়েছে উদাহরণ হিসাবে। কিন্তু ফেডারেশন কর্তাদের শেখার কোনও ইচ্ছা থাকলে তো! বর্তমান ফেডারেশন সভাপতি কল্যাণ চৌবের আমলে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তাতে কোনও দিক থেকেই ভারতীয় ফুটবলের লাভ হয়নি। বছর দুয়েক আগে আচমকা সন্তোষ ট্রফির মতো প্রতিযোগিতার শেষ পর্ব খেলানো হয়েছে সৌদি আরবে। তাতে ফুটবলার এবং কিছু কর্তার বিদেশভ্রমণ হয়েছে শুধু। সভাপতি হওয়ার পর কল্যাণ বিভিন্ন দেশে ঘুরে সে দেশের ফুটবল সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করেছেন। তার কোনটির কী অবস্থা, সে সম্পর্কে কোনও তথ্য জানানো হয়নি।

ফেডারেশন সভাপতি কল্যাণ চৌবে। —ফাইল চিত্র।
কল্যাণ আনন্দবাজার ডট কমকে বললেন, ‘‘যা করার জুনিয়র স্তরে করতে হবে। অনূর্ধ্ব ১৭ এবং অনূর্ধ্ব ২০ পর্যায়ে উন্নতি করতে না পারলে কিছু হবে না। শুধু সিনিয়র দল নিয়ে কাজ করে ভারতীয় ফুটবলের উন্নতি ঘটানো সম্ভব নয়।’’ কিন্তু সিনিয়র স্তর হোক বা জুনিয়র, উন্নতির কাজটা তো ফেডারেশনকেই করতে হবে। কল্যাণের জবাব, ‘‘ভুবনেশ্বরে ফিফা অ্যাকাডেমি করেছি আমরা। খুব শীঘ্রই এ রকম আরও একটা অ্যাকাডেমি তৈরি হবে। আরও একটা কথা বলতে চাই। অন্য পজিশনে উন্নতি হলেও আমাদের দেশে ভাল স্ট্রাইকার নেই এখনও। সহজ কথা হল, জিততে গেলে তো গোল করতে হবে। তার জন্য ভাল স্ট্রাইকার দরকার। ক্লাব স্তরের সর্বোচ্চ দুটো প্রতিযোগিতা যদি দেখি, সেখানে ক’জন ভারতীয় স্ট্রাইকার খেলে? এই ছবিটা বদলানো দরকার।’’
শুধু আশায় বাঁচবে চাষা?
এক সময় এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে টক্কর দেওয়া ভারতের ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ১২৭-এ নেমে যাওয়ার অর্থ শুধু পতন নয়। বোঝা যাচ্ছে, দেশের ফুটবল কাঠামোটাই দুর্বল। আগে সাধারণ জিনিসগুলো ঠিক করার দিকে নজর দিতে হবে। ফেডারেশন, ক্লাব, সরকার এবং অন্যান্য পক্ষকে একসঙ্গে এগিয়ে এসে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। তৃণমূল স্তরের উন্নতি, কোচিংয়ের উন্নতি, ঘরোয়া লিগের মান বাড়ানো, মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং বিদেশে খেলার সুযোগ করে দেওয়া এর মধ্যে অন্যতম। অনেকেই বলেন, ভারতীয় ফুটবলে প্রতিভার অভাব নেই। শুধু গঠন এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে গলদ রয়েছে। সেগুলো ঠিক করলে অনেকাংশে সুরাহা মিলবে।