Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
SC East Bengal

ISl 2021-22: ঘুড়ির সুতো দিয়ে বুট সারিয়ে হীরার দ্যুতি

লড়াই অবশ্য ছোটবেলা থেকেই করছেন হীরা। তিন দিদি ও এক ভাই রয়েছে লাল-হলুদ ডিফেন্ডারের।

ভরসা: এ ভাবেই বারবার চেন্নাইয়িনের আক্রমণ রুখেছেন হীরা।

ভরসা: এ ভাবেই বারবার চেন্নাইয়িনের আক্রমণ রুখেছেন হীরা। ছবি টুইটার।

শুভজিৎ মজুমদার
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২১ ০৯:২১
Share: Save:

ভো কাট্টা...শব্দটা কানে এলেই বছর সতেরোর ছেলেটার দৌড় শুরু হত আকাশের দিকে তাকিয়ে। ঘুড়ি ধরতে নয়। মাঞ্জা দেওয়া সুতো যে ভাবে হোক, সংগ্রহ করতেই হবে। ফুটবল বুটটা ছিঁড়ে গিয়েছে। চর্মকারের কাছ নিয়ে গিয়ে সেলাই করার টাকা কোথায় পাবে সে? ভরসা তাই ঘুড়ির মাঞ্জা দেওয়া সুতোই। সে দিনের সেই কিশোরই এখন এসসি ইস্টবেঙ্গল রক্ষণের প্রধান ভরসা হীরা মণ্ডল!

চেন্নাইয়িন এফসিকে আটকে হারের হ্যাটট্রিকের লজ্জা থেকে শুধু লাল-হলুদ সমর্থকদের রক্ষা করেননি হীরা, নিজেকেও প্রমাণ করেছেন। বলছিলেন, ‘‘ওড়িশা ম্যাচে আমার ভুলেই একটা গোল হয়েছিল। তাই চেন্নাইয়িনের বিরুদ্ধে শুরুতেই কড়া ট্যাকল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যাতে ওদের ফুটবলারদের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরে যায়। আমি কখনও লড়াই করতে ভয় পাই না।’’

লড়াই অবশ্য ছোটবেলা থেকেই করছেন হীরা। তিন দিদি ও এক ভাই রয়েছে লাল-হলুদ ডিফেন্ডারের। হীরার বাবা অশোক মণ্ডল রিক্সা চালাতেন। মা বাসন্তী মণ্ডল ও এক দিদি পরিচারিকার কাজ করতেন। তাতেও এত বড় সংসারের অভাব দূর হত না। হীরার বাবাকে বাধ্য হয়ে রিক্সা চালানোর পাশাপাশি অন্যান্য কাজও করতে হত। মা-ও রাতে আয়ার কাজ করতেন। প্রতিশ্রুতিমান ফুটবলার হিসাবে তত দিনে বেশ নামডাক হয়েছে তাঁর। হঠাৎ করেই সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। প্রয়াত হলেন বাবা। অর্ধেক দিনই খাওয়াই জুটত না হীরাদের।

শনিবার বিকেলে গোয়া থেকে আনন্দবাজারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হীরা বলছিলেন, ‘‘আমার বয়স তখন ১৭। হাওড়া ভেটারেন্স ক্লাবের হয়ে দুর্গাপুরে একটা টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়েছিলাম। এখনও মনে আছে, সে দিনটা ছিল রবিবার। মোহনবাগান-সেল অ্যাকাডেমিকে হারিয়ে আমরা চ্যাম্পিয়ন হই। বাড়ি ফেরার জন্য যখন তৈরি হচ্ছি, মা ফোন করে জানালেন, হঠাৎ করেই বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। জিজ্ঞেস করলেন, আমি কবে বাড়ি ফিরব? যোগ করলেন, ‘‘ভোররাতে বাড়ি ফিরে বাবাকে নিয়ে প্রথমে চন্দননগরের হাসপাতালে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওরা ফিরিয়ে দেয়। তার পরে চুঁচুড়ার হাসপাতালে ভর্তি করাই। দুপুরে বৈদ্যবাটি গিয়েছিলাম বাবার চিকিৎসার জন্য টাকা জোগাড় করতে। তিনটে নাগাদ হাসপাতালে ফিরে দেখলাম সব শেষ। ধরেই নিয়েছিলাম, আমার আর ফুটবলার হওয়া হবে না।’’ তার পরে? হীরা বলেন, ‘‘পাশে দাঁড়িয়েছিলেন হীরালাল দাস ও শৈশবের কোচ দুষ্টুদা (অরূপ ভট্টাচার্য)। ওঁরাই উজ্জীবিত করেছিলেন। প্রচুর সাহায্য করতেন।’’

শুরু হল হীরার জীবনে নতুন সংগ্রাম। অর্থের বিনিময়ে (খেপ) নানা প্রতিযোগিতায় খেলে বেড়ানো। বলছিলেন, ‘‘খেপ খেলা ছাড়া তো কোনও উপায় ছিল না। মা ও দিদির রোজগারে সংসার চলত না। খেতাম শুধু পান্তা ভাত। বুট সেলাই করার টাকাও ছিল না। ঘুড়ির সুতো দিয়ে নিজেই সেলাই করতাম।’’ শুক্রবার রাতে ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার মাকেই উৎসর্গ করেছেন হীরা। তাঁর বাঁ হাতে মায়ের মুখ ট্যাটু করা রয়েছে। বলছিলেন, ‘‘মায়ের জন্যই তো আমি ফুটবলার হয়েছি। এ ছাড়া দুষ্টুদা, মনোজিৎ (দাস) স্যর, তরুণ (দে) স্যরের অবদানও ভুলতে পারব না।’’

কেন? হীরা বললেন, ‘‘হাওড়া সহযাত্রীর হয়ে অনূর্ধ্ব-১৭ প্রতিযোগিতায় খেলতে চণ্ডীগড় যাওয়ার আগে বাংলার যুব দলের বিরুদ্ধে ম্যাচ খেলেছিলাম। বাংলার কোচ ছিলেন তরুণ স্যর। পাশাপাশি ইস্টবেঙ্গলের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের দায়িত্বেও তিনি ছিলেন। তরুণ স্যরই আমাকে লাল-হলুদে সই করান।’’

লাল-হলুদ রক্ষণের অন্যতম ভরসা হীরা অবশ্য ফুটবল জীবন শুরু করেছিলেন বিবেকানন্দ স্পোর্টিং ক্লাবের গোলরক্ষক হিসাবে। কিন্তু শারীরিক বৃদ্ধি ঠিক মতো না হওয়ায় কোচের পরামর্শে রক্ষণে খেলতে শুরু করেন। ইস্টবেঙ্গলের যুব দলে বছর দু’য়েক খেলে পোর্ট ট্রাস্টে যোগ দেন হীরা। এফসিআইয়ের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত গোল করে নজর কেড়ে নিয়েছিলেন সন্তোষ ট্রফিতে বাংলা দলের তখনকার কোচ অলোক মুখোপাধ্যায়ের। যদিও প্রাথমিক পর্বের ম্যাচের আগে বাদ পড়েন। বারাণসীতে মূল পর্ব খেলতে যাওয়ার আগে ফের ডাক পান তিনি। আর তাঁকে বাইরে বসে থাকতে হয়নি।

সন্তোষ ট্রফি খেলে ফেরার পরে একের পর এক চোট ফের অনিশ্চিত করে তুলেছিল হীরার ভবিষ্যৎ। কিন্তু হার মানেননি লাল-হলুদ ডিফেন্ডার। এমনকী, কয়েক বছর আগে চুক্তি করা সত্ত্বেও ইস্টবেঙ্গলের কোচ আলেসান্দ্রো মেনেন্দেস গার্সিয়া তাঁকে দলে না রাখায় ভেঙে পড়েননি। ফিনিক্স পাখির মতোই বারবার
ফিরে এসেছেন।

লাল-হলুদকে জয়ের সরণিতে ফেরাতে মরিয়া হীরা এখন স্বপ্ন দেখছেন জাতীয় দলে খেলার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

SC East Bengal ISL 2021-22
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE