E-Paper

জাতীয় দলের হয়ে ট্রফি জেতাই এখন লক্ষ্য ধীবর কন্যা রিম্পার

মেয়েদের সিনিয়র জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে পুরো প্রতিযোগিতা জুড়েই অবদান রেখেছেন রিম্পা। শুধু গোল করাই নয়, সেই সঙ্গে রয়েছে সতীর্থকে একদম মাপা ক্রস বাড়ানো। যা থেকে লক্ষ‌্যভেদ করেছেন সঙ্গীতা বাসফোর, সুলঞ্জনা রাউলরা।

সুতীর্থ দাস

শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২৫ ০৭:৫৫
নজরে: গ্রামের মেয়েদের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন রিম্পা।

নজরে: গ্রামের মেয়েদের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন রিম্পা। —ফাইল চিত্র।

নদীয়ার হাসপুকুর গ্রামে গেলে এখনও চোখে পড়বে অনেক মেয়ে ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফুটবল নিয়ে দাপাদাপি করছে। অথচ দশ বছর আগেও কিন্তু হাসপুকুরের ছবিটা এরকম ছিল না। মেয়েরা ফুটবল খেলবে! তাও আবার ছেলেদের সঙ্গে! গ্রামবাসীদের রোষানলে পড়া ছিল সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু এখন তাঁরা জানেন, ওই পায়ে বল নিয়ে দৌড়নো মেয়েদের মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে রয়েছে ভবিষ্যতের রিম্পা হালদার।

মেয়েদের সিনিয়র জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে পুরো প্রতিযোগিতা জুড়েই অবদান রেখেছেন রিম্পা। শুধু গোল করাই নয়, সেই সঙ্গে রয়েছে সতীর্থকে একদম মাপা ক্রস বাড়ানো। যা থেকে লক্ষ‌্যভেদ করেছেন সঙ্গীতা বাসফোর, সুলঞ্জনা রাউলরা। বাংলার জার্সিতে প্রতিযোগিতায় গোলসংখ‌্যার বিচারে সুলঞ্জনা রাউলের পরেই নাম রয়েছে রিম্পার (৭ গোল)। রয়েছে পাঁচটি গোলে সহায়তাও। রিম্পার প্রধান অস্ত্র দু’প্রান্ত দিয়ে চোরাগতিতে দৌড়। তাঁকে আটকাতে গিয়ে ডিফেন্ডারদের বারবার নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে।

এই দৌড়ের রহস্য জানার জন্যা কয়েক বছর আগে পিছিয়ে যেতে হবে। কোচ অভীক বিশ্বাসের কাছে এসেছিলেন অ‌্যাথলিট হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। ১০০ মিটার, ২০০ মিটার দৌড়ে বারবার পিছনে ফেলে দিতেন বাকিদের। দৌড়ে অনেক পুরস্কারও পেয়েছেন। চোরা গতি দেখে অভীকই তাঁকে কেরিয়ার হিসেবে ফুটবল বেছে নিতে বলেন। পাশাপাশি পেশির শক্তি বাড়ানোর জন‌্য জ‌্যাভলিন থ্রো-ও করতেন রিম্পা। অভীকের পরামর্শ পাওয়ার পরে চামড়ার গোলকই রিম্পার ধ্যানজ্ঞান।

তবে এত সহজে কিন্তু সবকিছু হয়ে যায়নি। সংগ্রামের মঞ্চে রিম্পার প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল কিন্তু তাঁর গ্রামবাসীরাই। মেয়ে হয়ে ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলবে, শুনে অনেকেই ভুরু কুঁচকেছিলেন। সেই সব দিনের কথা মনে করে রিম্পা ফোনে আনন্দবাজারকে বললেন, “গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়েছিল। অনুশীলন সেরে একটু রাত করে বাড়ি ফিরলেই অশ্লীল কটূক্তি উড়ে আসত। অপেক্ষা করেছি জবাব দেওয়ার।” সেই জবাব কি দেওয়া গেল? তাঁর উত্তর, “ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কাছে আমি এখন আদর্শ। অথচ একটা সময় তাদের বাবা-মা-রাই আমাকে অনেক কড়া কথা বলেছে। এর থেকে বড় পুরস্কার আর কিছু নেই।”

সারা প্রতিযোগিতায় ভাল খেলেও মণিপুরের বিরুদ্ধে হার এখনও তাঁকে কষ্ট দেয়। জাতীয় শিবিরে যাওয়ার আগে তিনি বললেন, “ওই একটি ম‌্যাচ নিয়ে এখনও আফশোস রয়েছে। অনেক সান্ত্বনা পেয়েছি। কিন্তু সেই জ্বালা এখনও জুড়োয়নি।”

গতির সঙ্গে পায়ের কাজ থাকায় অল্প দিনের মধ‌্যে রিম্পা নজরে পড়ে যান। কোচ অভীক বিশ্বাসের চোখ রত্ন চিনতে ভুল করেনি। নিজের পয়সায় নানা ক্লাবে তিনি রিম্পাকে নিয়ে যেতেন। কারণ রিম্পার বাবা শ্রীবাস হালদারের একার পক্ষে মেয়ের খরচ চালানো সম্ভব ছিল না। মাছ ধরে কতই বা উপার্জন হয়! রিম্পার মা বাসন্তী হালদারও খেতে দিনমজুরের কাজ করেন। ২০১৯ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে কলকাতায় আসেন রিম্পা। কলকাতা পুলিশের হয়ে কলকাতা লিগে হাতেখড়ি হয়। পরে খেলেছেন ইস্টবেঙ্গলেও। ২০২৪ সালে মেয়েদের সাফ চ‌্যাম্পিয়নশিপে সিনিয়র দলের জার্সিতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিষেক ঘটে রিম্পার।

তাঁর নিজের কী স্বপ্ন? ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর একনিষ্ঠ ভক্ত রিম্পার কথায়, “আমাকে মানুষ করার জন্য বাবা-মাকে অনেক কষ্ট, অপমান সহ্য করতে হয়েছে। এমনকি বাবা ধার করে আমার ফুটবল খেলার খরচ চালিয়েছে। সেই পাওনাদাররা পরে বাড়িতে এসে বাবাকে বিদ্রুপ পর্যন্ত করেছে।” দূরে ফেলে আসা কষ্টের কথা বলতে গিয়ে চোখের জল আর বাঁধ মানল না। কাঁপা কাঁপা গলায় রিম্পা উত্তর দিলেন, “শুধু বাংলা নয়, ভারতীয় দলের নিয়মিত সদস‌্য হয়ে উঠতে চাই। জাতীয় দলের জার্সিতে অবদান রেখে ট্রফি জয়ই লক্ষ‌্য।”

কাঁটা বিছনো পথ অতিক্রম করে রিম্পাই এখন হাসপুকুরের পথপ্রদর্শক!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

footballer Indian players

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy