পিছিয়ে পড়েও গ্রিজম্যানের জোড়া গোলে আয়ারল্যান্ডকে হারিয়ে ইউরোর শেষ আটে ফ্রান্স। কুর্নিশ পায়েতের। ছবি: এএফপি
শহরের মেট্রোকে যে এত সুন্দর বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়, কে জানত!
আইফেল টাওয়ারের কাছাকাছি একটা নয়, তিন-তিনটে স্টেশন। বির হাকেম। ট্রোকাডেরো। এবং প্যাসি। তিনটের যে কোনও একটায় উঠে লাইন বদলে-বদলে প্যারিসের যে কোনও দিকে ছুটে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু মেট্রোয় এত দাপাদাপি চললে লোকে উঠবেও বা কী ভাবে, নামাও বা কোন জাদুমন্ত্রে সম্ভব?
সন্ধে সাড়ে পাঁচটা নাগাদ তিনটে মেট্রো স্টেশন থেকে অন্তত তিন হাজার লোক উঠল! প্যারিসে অবশ্য সাড়ে পাঁচটা মানে নামেই সন্ধে। সূর্যের আলো এখানে চড়া রোদ ছড়িয়ে রাখে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত। কোনও কলকাতাবাসীর তা শুনে যদি একটু-আধটু বিস্ময় লাগে, তা হলে মেট্রোয় পরপর যা যা ঘটে গেল সে সব চর্মচক্ষে দেখলে চোয়ালের অবস্থা কী দাঁড়াত? কলকাতাবাসী প্রথমে স্কুলে যায়, সাইকেল শেখে, তার পর মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল দেখে। কিন্তু এ জিনিস ফুটবল-প্রিয় কলকাতা ইহজন্মে মেট্রোয় উঠে করেছে কখনও?
কী বললেন, নাচ? গান? না, না। নাচ বা গান দিয়ে ব্যাপারটার সমাপ্তি ঘটিয়ে ফেললে অন্যায় নয়, গর্হিত অপরাধ হবে। দরজার ঠিক উপরে পরপর স্টেশনের নাম কলকাতা মেট্রোয় লেখা থাকে যেমন, প্যারিসেও থাকে। তা দেখা গেল, সেখানে একটার পর একটা থাপ্পড় পড়ছে! ‘আলে লে ব্ল্যুজ’ গাইতে গাইতে অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ একটু বেশি হয় বোধহয়, গলার সঙ্গে হাতের তালের প্রয়োজন হয়। অতএব, মারো দরজায়, তোলো আওয়াজ। একটা সময় জনা তিরিশেক যুবক কামরায় এত জোর লাফাচ্ছিলেন যে, দাপাদাপির চোটে মনে হবে, মেট্রোয় উঠে মারাত্মক এয়ার টার্বুলেন্সে পড়লাম বুঝি! এত দুলুনি, এত থরথর কাঁপুনি।
একজনকে দেখা গেল হাতের মোবাইলে নিজেরই গাওয়া একটা গানের ভিডিও দেখছেন, দেখে-টেখে বন্ধুবান্ধবদের সামনে তার লাইভ শো উপহার দিচ্ছেন। গায়ে গর্বের ফ্রান্স পতাকার লাল-নীল-সাদা, গালেও তাই। মাথার কোঁকড়া-কোঁকড়া নকল চুলেও লাল-সাদা-নীল। আর এক যুবক তো সোজা সিটের উপর উঠে নাচতে শুরু করে দিল! সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার, সমর্থনের এ হেন গণ-অভ্যুত্থানে কোনও পরিচয়ের পাসপোর্ট প্রয়োজন পড়ছে না। তুমি চেনা হলে ভাল, নইলে আরও ভাল। কামরার দরজা ঠেলে ঢোকো, ঢুকে নাচতে শুরু করে দাও। তুমি এখন ফ্রান্সে, ওটাই তোমার একমাত্র পরিচয়।
পাঠ্যপুস্তক থেকে বিভিন্ন মিডিয়া, সর্বত্র শোনা যায় ফরাসিরা একটু নরমসরম। নিপাট ভদ্রলোক, ঝুটঝামেলা পছন্দ করে না, প্রকৃতিগত ভাবে শান্তিপ্রিয়। ‘ছবির দেশে, কবিতার দেশে’ বইয়ে প্রথম বার ফ্রান্স দেখার পর প্রয়াত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও কথাটা লিখেছিলেন। লিখেছিলেন যে, ফরাসিরা স্বভাবগত শান্ত বলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যাডলফ হিটলারের সঙ্গে রক্তারক্তিতে যায়নি। জার্মান স্বৈরাচারী প্যারিস আক্রমণ করার আগেই আত্মসমর্পণ করে দিয়েছিল। কিন্তু রবিবাসরীয় ফ্রান্সের যে মুহুর্মুহু জঙ্গি মনোভাবের পরিচয় পাওয়া গেল, তা তিন ঘণ্টা ধরে দেখলে মনে প্রশ্ন জাগবে যে, ফ্রান্স কি তা হলে পাল্টে গেল? রেনোয়া, গঁগ্যা, মোনের দেশের বর্তমান প্রজন্ম কি তা হলে পুরনো ভাবমূর্তির ওভারকোট নামিয়ে রাখল? বর্তমান প্রজন্মের ফ্রান্স তো যুদ্ধ-বিগ্রহের মেজাজে সময়-সময় হিটলারকে লজ্জায় ফেলে দেবে!
আঁতোয়া গ্রিজম্যানের দু’টো গোলের আগে আইফেল টাওয়ার ফ্যান জোন চত্বরে কী ঘটছিল, পরে লিখছি। ধুনুচির মতো কোনও একটা বস্তু থেকে লাল-নীল ধোঁয়ায় প্যারিস আকাশের তুলো-মেঘ তখন ঢাকা পড়ছিল, কিন্তু সে সব আপাতত থাক। গ্রিজম্যানের গোল দু’টোর আগে বরং কী ঘটছিল সেটা জানা, উত্তেজনার শিরশিরানি ধরার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন।
রবিবারের প্যারিস।
প্যারিসে এক-আধটা নয়, বেশ কয়েকটা ফুটবল ফ্যান জোন আছে। সাঁ দেনি। পার্ক দে প্রিন্সেসের কাছে। আর একটা আইফেল টাওয়ারের গায়ে। তিনটের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দর্শক ধরে আইফেল টাওয়ারেরটায়। সংখ্যাটা শুনলে চমকে উঠতে হয়— বিরানব্বই হাজার! অধুনা ইডেন দর্শকাসনের প্রায় দেড়গুণ, অতীতের ইডেনের চেয়েও কিছু বেশি। এত বিশাল, এত দৈত্যাকৃতির বলে সাধারণত আইফেল টাওয়ার ফ্যান জোন একটু ফাঁকা-ফাঁকা থাকে। কিন্তু রবিবার সেখানে যাওয়ামাত্র বোঝা গেল, কপালে দুঃখ আছে।
সাঁ দে মার্স দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে হাজার-হাজার লোক। পুরো হিসেব ধরলে প্রায় লক্ষাধিক। কালো উর্দিধারীরা দেখা গেল মজার এক উপায় বার করেছেন। তিনটে গেট। প্রত্যেকটার কাছে গেলে জনস্রোতকে ঘুরিয়ে অন্য গেটে যেতে বলা হচ্ছে! কিন্তু এমন ভ্রমাত্মক ব্যবস্থায় বাঁচা যায় না, যায়ওনি। একটা গেটে গিয়ে দেখা গেল, পাঁচ-সাতশো লোক দাঁড়িয়ে পড়ে ফরাসিতে তীব্র ধিক্কার দিয়ে চলেছে। করুণ থেকে করুণতর অবস্থায় পুলিশ অফিসার মাইক নিয়ে কী যে ঘোষণা করছিলেন, প্রথমে বোঝা যায়নি। একটু পর গেল। যখন একটা নোটিশ-বোর্ড টাঙিয়ে দিতে হল— ফ্যান জোন কমপ্লিটলি ফুল। আর ঢোকা যাবে না।
আর যায় কোথায়? উন্মত্ত জনতাকে মুহূর্তের মধ্যে দেখা গেল বিয়ারের ক্যান থেকে জলের বোতল, সব পুলিশের দিকে ছুড়ে মারতে! ভাগ্যিস ফ্রান্সের রাস্তা-ঘাটে ইঁট পড়ে থাকে না। থাকলে বোধহয় সেটাও জুটত। আসলে ততক্ষণে ফ্রান্স এক গোল হজম করে ফেলেছে। মেজাজ এমনিই খারাপ। তার মধ্যে চোঙা ফুঁকে পুলিশের নাটুকেপনা কার সহ্য হয়?
ফরাসি পুলিশ আলাদা করে ধন্যবাদ দিতে পারে গ্রিজম্যানকে। ইউরোয় ফ্রান্সকে তিনি শুধু বাঁচিয়ে গেলেন না, ফ্রান্স পুলিশকেও বাঁচিয়ে দিলেন। দিদিয়ের দেশঁর টিম আজ হেরে গেলে রাস্তার অবস্থা কী দাঁড়াত, কে জানে। অতি কষ্টে ফ্যান জোনে ঢোকার পর তিন বাঙালিকে পাওয়া গেল, যাঁরা ধরেই নিয়েছেন ফ্রান্স আর পারবে না। ঠিকই পড়েছেন, বাঙালি। বাংলাদেশের এঁরা, প্যারিসে খাবারের দোকানের কর্মচারী। ফ্রান্সে থাকতে থাকতে ফরাসি ফুটবলের প্রতি প্রেম, আর তা এখন এতটাই যে দেখে মুগ্ধ হতে হয়। দ্বিতীয়ার্ধের পাঁচ মিনিটের মধ্যে এঁদের ‘গ্রিজম্যান দিছে, গ্রিজম্যান দিছে’ বলতে বলতে লে ব্ল্যুজ সমুদ্রে মিশে যেতে দেখা গেল।
ফ্রান্স সাত নম্বর এত দিন দিমিত্রি পায়েতের ছায়ায় ঢাকা পড়ে ছিলেন। কেন তিনি দিয়েগো সিমিওয়েনের অতীব পছন্দের, আজ বোঝা গেল। তাঁর পা আর মাথা না থাকলে তো রবিবার জেতে না ফ্রান্স। ফুটফুটে চেহারার ফরাসি শুধু তো জেতালেন না, মায়াবী উন্মাদনার কিছু স্বর্ণমুহূর্তও সৃষ্টি করে গেলেন। গোল দু’টোর পর এক বেঁটেখাটো চেহারাকে দেখা গেল, ফরাসি তরুণীর গলা জড়িয়ে নাচতে। কাছে গিয়ে বোঝা গেল, ফরাসি রক্ত তাঁর শরীরে নেই। তিনি জাপানি বা কোরীয়। কঙ্গোর একজনকে পাওয়া গেল, যিনি একটার পর একটা সিগারেট ফুঁকে চলেছেন। ফ্রান্স তো জিতছে, তা হলে কীসের টেনশন? চটজলদি জবাব এল, “টেনশন, হোয়াট টেনশন? দিস ইজ পিওর এনজয়মেন্ট!” আর ফেরার সময় রাস্তায় যে দৃশ্য চোখে পড়ল, আজীবন মনে থাকা উচিত।
ফ্রান্স পতাকা নিয়ে সদর্পে হাঁটছে একটা টিম, যার প্লেয়ারদের জার্সির নামগুলো খুব চেনা। কোমান, পোগবা, মাতুইদি, জিদান! প্লেয়ার নন, সমর্থক সব। কণ্ঠস্বরের সর্বশক্তি দিয়ে যাঁরা একটা লাইনে চতুর্দিক কাঁপিয়ে দিচ্ছেন।
আন, দিউ, ত্রয়, গ্রিজম্যান, গ্রিজম্যান।
ফরাসি বোধগম্য হয় না। কিন্তু গুগল ট্রান্সলেটর মুহূর্তে বলে দেয়।
ওয়ান, টু, থ্রি, গ্রিজম্যান, গ্রিজম্যান!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy