Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

ট্রফির সঙ্গে সন্ত্রাসের যুদ্ধও জিততে চাইছে ফরাসিরা

অপেক্ষা আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার! তার পরেই কবিতার দেশে শুরু হবে ইউরো কাপ। কিন্তু ইউরোপের এই ফুটবল উৎসব পণ্ড করার লক্ষ্যে সন্ত্রাসের রক্তচক্ষু যে রয়েছেই!

নিরাপত্তার বজ্রআঁটুনি। তল্লাশি চলছে আইফেল টাওয়ারের সামনে। -এএফপি

নিরাপত্তার বজ্রআঁটুনি। তল্লাশি চলছে আইফেল টাওয়ারের সামনে। -এএফপি

প্যারিস
শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৬ ০৪:১৫
Share: Save:

অপেক্ষা আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার! তার পরেই কবিতার দেশে শুরু হবে ইউরো কাপ। কিন্তু ইউরোপের এই ফুটবল উৎসব পণ্ড করার লক্ষ্যে সন্ত্রাসের রক্তচক্ষু যে রয়েছেই!

যার আনাগোনা শুরু গত বছর থেকেই। প্রথমে শার্লি এবদো। তার পর বাতা ক্লঁ— গোটা প্যারিস জুড়ে ধারাবাহিক বিস্ফোরণ। তার পরেই ধেয়ে এসেছে সন্ত্রাসবাদী শক্তিগুলোর হুমকি— ইউরো কাপেও বইবে রক্তস্রোত!

গত নভেম্বরের সেই ধারাবাহিক বিস্ফোরণের ঘটনার পর গত ছ’মাসে সিন নদীর উপর দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। কিন্তু তাতেও বন্ধ হয়নি সন্ত্রাসের হুমকি। ইউরোর কাপ যুদ্ধে ফরাসিদের কাছে তাই চ্যালেঞ্জ দু’টো—এক) স্পেন, জার্মানি, বেলজিয়ামের মতো ফুটবল দৈত্যদের পিছনে ফেলে দীর্ঘ ১৬ বছর পর ইউরোপ জয়। দুই) আঁটসাঁট নিরাপত্তা বজায় রেখে আইফেল টাওয়ারের উপর এসে ভিড় করা সন্ত্রাসের কালো মেঘ সরিয়ে নিরাপত্তা-ব্যবস্থার নতুন নজির স্থাপন করা। কারণ এর সঙ্গেই সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সত্তর লক্ষ ফুটবল দর্শকের নিরাপত্তা।

প্যারিসের সন্ত্রাস প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ জাঁ চার্লস ব্রিশার্ডের গলায় তাই রীতিমতো চ্যালেঞ্জের সুর, ‘‘হুমকির শেষ নেই। কিন্তু সেটা রুখে দেওয়াই আপাতত চ্যালেঞ্জ ফরাসিদের কাছে।’’ দেশের দশটি স্টেডিয়ামে ৫১ টি ম্যাচে ফুটবলার এবং দর্শকদের জীবন সুরক্ষিত করতে নব্বই হাজার অতিরিক্ত পুলিশ এবং সেনা মোতায়েন করা হয়েছে গোটা ফ্রান্স জুড়ে। যাতে কোনও ভাবেই বম্ব, মারণ গ্যাস বা বন্দুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে না পড়তে পারে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর সদস্যরা। প্রতিরোধের জন্য বেশ কিছু ম্যাচে ফ্যান জোন ও পাবগুলো বন্ধ রাখা হবে। যার মহড়া হল বৃহস্পতিবারেও। আর তার জোশেই বোধহয় ফরাসি প্রধানমন্ত্রী বলে ফেলেছেন, ‘‘এ বার দেখিয়ে দেওয়ার পালা সন্ত্রাসকে দূরে সরিয়ে স্বাভাবিক জীবন চেনা ছন্দেই এগিয়ে চলেছে। গোটা ফ্রান্স তৈরি। সন্ত্রাসবাদীদের ঘৃণ্য হুমকি এ বার কার্যকর হওয়া কঠিন। খুব-ই কঠিন।’’

গত কয়েক মাস ধরে মার্কিন ও ব্রিটিশ গোয়েন্দা দফতর এমনকী বেলজিয়ামও ইউরোর সময় ফ্রান্সে সন্ত্রাসবাদী হানার আগাম বিপদ-বার্তা দিয়ে রেখেছে। এরই মধ্যে গত সপ্তাহে ইউক্রেনে অস্ত্র ঠাসা গাড়ি সমেত এক ফরাসিকে সেখানকার পুলিশ গ্রেফতারের পর আতঙ্ক কমার বদলে ছড়িয়েছে বেশি।

তা সত্ত্বেও ইউরোপের ফুটবল যুদ্ধ শুরুর চব্বিশ ঘণ্টা আগে কবিতার দেশ ফ্রান্স যেন রাতারাতি ফুটবলের দখলে চলে গিয়েছে। আইফেল টাওয়ারের উপর এখন ঝুলছে সাদা-কমলা ফুটবল। আর তা নিয়েই মাতোয়ারা ফরাসি ফুটবল জনতা। আর তা হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ গত বত্রিশ বছরে আয়োজক ফ্রান্স মানেই তো ফুটবলের সেই ট্রফি ফরাসি অধিনায়ক তুলে দিয়েছেন দেশের প্রেসিডেন্টের হাতে। ১৯৮৪ তে পাঁচ ম্যাচে ন’গোল করে প্লাতিনির ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ দেশকে জেতানো। আর ১৯৯৮-এ জিদানের সেই ব্রাজিলকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জয়ের ছবি। কিন্তু সে তো গত সহস্রাব্দের। এই সহস্রাব্দে কি তার পুনরাবৃত্তি হবে? ষোলো বছর আগের জিদান-ত্রেজেগুয়ে হয়ে নাচতে পারবেন পোগবা-হুগো লরিসরা?

ফ্ল্যাশব্যাকে ভেসে উঠছে ফুটবলের বড় আসরে ফরাসি শিবিরের উত্তেজনার চোরাস্রোতের গল্পও। যার জেরে কখনও বিশ্বকাপের শিবির থেকে নিকোলাস আনেলকার ছেড়ে যাওয়া কখনও বা চার বছর আগের ইউরোর মতো সামির নাসরির সাংবাদিকের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে তিন ম্যাচ নির্বাসনে চলে যাওয়া। এ বার আবার চলে এসেছে ‘সেক্স টেপ’ বিতর্ক। যার জেরে বাদ গিয়েছেন ফরাসিদের অন্যতম হার্টথ্রব করিম বেঞ্জিমা। রিয়াল মাদ্রিদের এই তারকা আবার বাদ গিয়ে তোপ দেগেছেন কোচ দিদিয়ের দেঁশ-র দিকে। আলজিরিয়া জাত বেঞ্জিমার অভিযোগ আবার বর্ণবিদ্বেষের। তাঁর কথায়, ‘‘ফ্রান্সের বর্ণবিদ্বেষের কাছে মাথা নুইয়েছেন কোচ।’’ কিন্তু সে সব বিতর্ক উড়িয়ে ফরাসি কোচ আপাতত ব্যস্ত প্রথম ম্যাচে রোমানিয়াকে হারানোর ঘুঁটি সাজাতে। কিন্তু তাঁর কপালেও যে ভাঁজ নেই তা বলা যাচ্ছে না। কারণ, বেঞ্জিমার সঙ্গেই দেশঁ পাবেন না হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটে কাবু রাফায়েল ভারানেকে। টিম থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন বার্সেলোনার জেরেমি ম্যাথিউ। ডোপিংয়ের দায়ে নির্বাসিত লিভারপুলের মামাদৌ সাখো। এই এত নেই-এর মধ্যেই জিরুঁ, পোগবা, গ্রিজম্যান, মার্শালদের নিয়েই ইউরো জয়ের স্বপ্ন দেখছেন ফরাসি কোচ। যেখানে গতি আর তারুণ্যকেই প্রাধান্য দিয়েছেন তিনি। প্রথম ম্যাচ খেলতে নামার চব্বিশ ঘণ্টা আগে বলছেন, ‘‘দল ঘোষণা হওয়ার পর থেকে যা হচ্ছে দুঃস্বপ্নেও তা কল্পনা করা যায় না।’’ সঙ্গে এটাও বলতে ভুলছেন না, ‘‘ঘরের মাঠে খেলা। এটা যেমন চাপ তেমনই একটা পজিটিভ ফ্যাক্টরও।’’

কোচের সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন ফুটবলাররাও। ম্যাঞ্চেস্টার সিটির বাকারি সাগনা বলছেন, ‘‘আমরা তৈরি। যতই চাপ থাকুক না কেন তাতে মাথা ঘামাতে রাজি নই। খোলা মনে মাঠে নেমে খেলতেই মুখিয়ে গোটা টিম।’’

উল্টো দিকে রোমানিয়ার কোচ লর্ডানেস্কুর টিমের ইউএসপি দুর্ভেদ্য রক্ষণ। গত দশ ম্যাচে মাত্র দু’গোল হজম করেছে তাঁর টিম। গত মার্চে স্পেনকে ০-০ রুখে দিয়ে এসেছে তাঁর ছেলেরা। হাজি বা আদ্রিয়ান মুতুদের মতো কেউ না থাকলেও ফ্রান্সকে প্রথম ম্যাচেই জোর ঝ়কা দিতে তৈরি রোমানিয়ানরা।

তবে কবিতার দেশ মনে রাখছে, গত বছরের সেই কুখ্যাত ১৩ নভেম্বরের রাত। প্যারিসে ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ঘটানোর আগে ফ্রান্স-জার্মানির ম্যাচে দর্শকদের নিশানা বানাতে গিয়েও ব্যর্থ হয় সন্ত্রাসবাদীরা। আর যে সন্ত্রাসের সামনে মাথা না নুইয়ে ২-০ ম্যাচ জিতেছিলেন ফরাসিরা। ইউরো শুরুর প্রাক্কালে ফরাসি ফুটবল জনতা সন্ত্রাসের বিষ-বাষ্পকে সরিয়ে রাখছে ঠিক এই স্পিরিটে ভর করেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

terror France Euro Cup 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE