প্রশ্ন: উরির মৃত জওয়ানদের কী করলে যথার্থ সম্মান জানানো হবে বলে আপনি মনে করেন?
গম্ভীর: প্রথম কাজ হবে জওয়ানদের কোনও মতেই অসম্মান না করা। এরা কেউ মারা গেলেই আমি দেখি সরকার থেকে একটা পাঁচ কী দশ লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষণা হয়। এর চেয়ে অসম্মানজনক আর কিছু হতে পারে না। তার মানে কি দাঁড়াল যে, আমরা মনে করছি একজন জওয়ানের মৃত্যুর দাম মাত্র পাঁচ লাখ টাকা?
প্র: আপনার মতে তা হলে কী করা উচিত?
গম্ভীর: পরিবারের কারও চাকরির ব্যবস্থা করা উচিত। বা যদি কমবয়সী ছেলেমেয়ে থাকে, তাদের পড়াশোনার পুরো ব্যবস্থা করা উচিত। ওই পাঁচ কী দশ লাখ টাকায় একটা পরিবারের কত দিন চলতে পারে? একটা পাকা চাকরি বা দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা হলে অন্তত একটা সুরাহা হয়।
প্র: উরির পর আপনার একটা টুইট নিয়ে ক্রিকেটমহলে বেশ শোরগোল পড়ল। জানেন?
গম্ভীর: না কোনটা (খুব বিস্মিত)?
প্র: যেখানে আপনি লিখেছেন বায়োপিক যদি হতে হয় কোনও ক্রিকেটার নয়, জওয়ানদের ওপর হওয়া উচিত। লোকে বলছে ধোনিকে আপনি পছন্দ করেন না। আর ধোনির বায়োপিক এই শুক্রবার রিলিজ হবে মাথায় রেখেই ওটা লিখেছেন।
গম্ভীর: কে কী ভাবল, কে কী বলল, তাতে আমার কিছু আসে-যায় না। আমি এটা মনে করি এবং দরকার হলে ছাদের ওপর থেকে চিৎকার করে বলব। জাতির জীবনে একজন জওয়ানের কন্ট্রিবিউশন কোনও ক্রিকেটার বা বলিউড স্টারের চেয়ে অনেক বেশি। মনে রাখবেন, একজন ক্রিকেটার বা বলিউড স্টার খাটছে নিজের জন্য, তার পরিবারের জন্য। আর কত টাকা রোজগার করছে। বলুন না কাল থেকে তোমার মাস-মাইনে তিরিশ হাজার টাকা করে দিচ্ছি। দেখুন না কী বলে। সব মুখচোখ শুকিয়ে নিষ্পন্দ হয়ে পড়বে। কোথায় এদের জাতির জন্য কন্ট্রিবিউশন আর কোথায় সেই অনামী লোকটার যে সিয়াচেন সীমান্তে আমার-আপনার জন্য প্রচণ্ড প্রতিকূলতাতেও দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের রক্ষা করছে। কত মাইনে পাচ্ছে? না, হয়তো মাত্র পনেরো-কুড়ি হাজার টাকা। বা তা-ও হয়তো পাচ্ছে না। এরাই আমার হিরো। কোনও ক্রিকেটার নয়।
প্র: সন্দেহ নেই। কিন্তু ক্রিকেটাররাও তো জাতীয় জীবনে উদ্দীপনা সরবরাহ করেন।
গম্ভীর: তুলনাই হয় না। জওয়ান ছেড়ে দিন। মানুষের জীবনে একজন আবদুল কালাম বা মাদার টেরিজার যা কন্ট্রিবিউশন, একজন ক্রিকেটারের কি আছে? বায়োপিক যদি করতে হয়, ওঁদের ওপর হোক। স্বাগত জানাব।
প্র: পাকিস্তান ম্যাচের আগে আপনাকে প্রতি বার বেশি উদ্দীপ্ত দেখা যেত। বিশ্বকাপ ফাইনাল জেতার পর সবাই যখন নাচছে-গাইছে, আপনার ৯৭ রানের ইনিংসটা উৎসর্গ করেছিলেন ২৬/১১-এ মৃতদের উদ্দেশে। উরি কাণ্ডের পর কী মনে হচ্ছে?
গম্ভীর: আমি একজন দেশপ্রেমিক মানুষ। আমি জ্বলছি ভেতরে ভেতরে। খালি মনে হচ্ছে মানুষের জীবন কি এতই সস্তা? তা ছাড়া সবচেয়ে মর্মান্তিক কী জানেন? যখন আপনি নিজের দেশে এমন বেঘোরে প্রাণ দিচ্ছেন। যখন নিজের দেশের নিরাপত্তা আপনাকে বাঁচানোর জন্য যথেষ্ট হচ্ছে না। ভারতের একজন নাগরিক হিসেবে আমি ঘোর লজ্জিত এবং অপমানিত! ছি ছি! মানুষের জীবনের কোনও মূল্যই তো থাকল না আমার দেশে।
প্র: জাভেদ মিয়াঁদাদ আমাদের কাগজে শনিবার রাতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, উরির আক্রমণকারীরা মোটেও সীমান্ত পেরিয়ে আসেনি। ভারত নিজেরাই দেখুক এটা কারা করেছে।
গম্ভীর: হোয়াট! লোকগুলো তা হলে এল কোথা থেকে? জাভেদের মস্তিষ্কের আমি কোনও দিনই ভক্ত নই। কিন্তু এ বার দেখছি ও মাথাটাকে আরও উর্বর করে ফেলেছে।
প্র: মিয়াঁদাদ প্রস্তাব দিয়েছেন এই পরিস্থিতিতে শান্তির দূত হিসেবে ক্রিকেটকে ব্যবহার করা হোক। ভারত-পাক দুটো ম্যাচ খেলানো হোক। একটা এ দেশে, একটা ও দেশে।
গম্ভীর: হাস্যকর! না, হাস্যকর বললেও খুব কম বলা হয়! লোকে সীমান্তের ওপার থেকে এসে মেরে যাচ্ছে আর আমরা খেলব ওদের সঙ্গে ক্রিকেট ম্যাচ! বলছে কী!
প্র: মিয়াঁদাদের ফর্মুলা হল, টেনশন কমাতে ম্যাচ খেলা উচিত। কারণ এটা পাকিস্তান সরকার অনুমোদিত উগ্রপন্থা কখনও নয়।
গম্ভীর: ওই লোকটার মতামতকে আমার কোনও দিনই পাত্তা দেওয়ার মতো মনে হয়নি। আর এ যা বলছে সব আজগুবি। সবচেয়ে বড় কথা হল, আমি গৌতম গম্ভীর দেশের একজন সাধারণ নাগরিক জানতেই চাই না ওরা কী ভাবছে? বা কী বলছে? এই মুহূর্তে পাকিস্তান নিয়ে কোনও কথা বলারই প্রয়োজন নেই।
প্র: এই মুহূর্তে তা হলে আপনার মতে কী করণীয়?
গম্ভীর: প্রথম, সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করা। নিশ্চয়ই আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ত্রুটি ছিল, নইলে উরি ঘটে কী করে? আমার মতে শুধু কাশ্মীর নয়, দেশের সব ক’টা সীমান্তের নিরাপত্তা বাড়াও আর নিশ্ছিদ্র করো।
প্র: আপনি কি বদলার পক্ষপাতী? সেই বদলার নাম যদি যুদ্ধ হয়?
গম্ভীর: না যুদ্ধের পক্ষপাতী নই। ওটা আমাদের দেশকে আরও ১৫-২০ বছর পিছিয়ে দেবে। ভারতীয় অর্থনীতি উন্নতিশীল দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগামী। সেই অর্থনীতির ওপর যুদ্ধ না চাপানোই ভাল। তাতে উন্নতিটা থমকে যাবে। তবে একই সঙ্গে শত্রুকে বোঝাতে হবে আমাদের শক্তি আরও বেশি। তার প্রতি কোনও রকম দাক্ষিণ্য দেখানো চলবে না।
প্র: মুম্বইয়ে কর্মরত পাকিস্তানি শিল্পীদের ফিরে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আপনি এটা সমর্থন করেন?
গম্ভীর: হান্ড্রেড পার্সেন্ট করি। এখন যা পরিবেশ দাঁড়িয়েছে তাতে দু’দেশের মিলিত হয়ে গানবাজনা, ক্রিকেট খেলা এগুলোর কোনও দরকার নেই। সবার আগে প্রয়োজন আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা।
প্র: কিন্তু আপনি যে কেকেআর টিমের ক্যাপ্টেন্সি করছেন এত বছর ধরে, তার বোলিং কোচও তো পাকিস্তানি। একই নীতিতে তো তাঁকেও ফিরে যেতে বলা উচিত?
গম্ভীর: ওটা ফ্র্যাঞ্চাইজির সিদ্ধান্ত। আমার কিছু বলার নেই। ওরা যা ঠিক করবে। তবে আমি একটা ব্যাপারে খুব পরিষ্কার। মানুষের জীবন ক্রিকেট খেলা বা গানবাজনার চেয়ে অনেক দামি। আম নাগরিকের মন এখন রক্তাক্ত। এই কালচারাল এক্সচেঞ্জ বা ক্রিকেট কি এত বড় হয়ে গেল যে, একজন জওয়ানের জীবনের আগে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy