Advertisement
E-Paper

কপিলের জন্মদিনে হারিকেন হার্দিক

ম্যাচের ভাগ্য কোন দিকে ঘুরবে, তা নিয়ে দোটানা থাকতে পারে। একটা জিনিস নিয়ে কোনও তর্ক আর নেই যে, নিউল্যান্ডসের আকাশে ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন তারার উদয় ঘটতে দেখা গেল।

সুমিত ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৮ ০৪:২২
বিধ্বংসী: দক্ষিণ আফ্রিকার বোলারদের শাসন করল হার্দিকের ব্যাট। সেঞ্চুরি এল না অল্পের জন্য। শনিবার কেপ টাউনে। ছবি: এএফপি।

বিধ্বংসী: দক্ষিণ আফ্রিকার বোলারদের শাসন করল হার্দিকের ব্যাট। সেঞ্চুরি এল না অল্পের জন্য। শনিবার কেপ টাউনে। ছবি: এএফপি।

শেষ পর্যন্ত বিরাট কোহালির ভারত কেপ টাউন টেস্ট আরও জমিয়ে দিতে পারবে কি না, সময় বলবে।

ম্যাচের দ্বিতীয় দিনের শেষে যা পরিস্থিতি, দক্ষিণ আফ্রিকা সামান্য এগিয়ে। প্রথম ইনিংসে ৭৭ রানে এগিয়ে থাকার পরে দ্বিতীয় ইনিংসে তারা ৬৫-২। সব মিলিয়ে ফ্যাফ ডুপ্লেসি-র দল ১৪২ রানে এগিয়ে। রবিবার সকালে যদি ভারতীয় বোলাররা কয়েকটা উইকেট তুলে নিতে পারেন, ম্যাচের রং পাল্টে যেতে পারে। কেপ টাউনের টেবল মাউন্টেনের মতোই মেঘ-রোদ্দুরের খেলা চলছে টেস্টের বাইশ গজেও।

ম্যাচের ভাগ্য কোন দিকে ঘুরবে, তা নিয়ে দোটানা থাকতে পারে। একটা জিনিস নিয়ে কোনও তর্ক আর নেই যে, নিউল্যান্ডসের আকাশে ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন তারার উদয় ঘটতে দেখা গেল। যে হেতু তাঁর নাম হার্দিক পাণ্ড্য, পুরনো সেই তুলনাটা ফের শুরু হয়ে গিয়েছে। ভারত কি নতুন কপিল দেব পেল? এখনই কপিলের মতো কিংবদন্তি অলরাউন্ডারের পাশে বসাতে যাওয়াটা হটকারিতা। তবে কপিলের জন্মদিনে যে ইনিংস হার্দিক খেলে গেলেন, বিদেশের মাঠে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের অন্যতম সেরা বীরত্বের প্রদর্শনী হয়ে থাকল।

৯৫ বলে ৯৩। অষ্টম উইকেটে ভুবনেশ্বর কুমারের সঙ্গে যোগ করলেন ১৫১ বলে ৯৯ রান। এই রানগুলো সরিয়ে নিলে স্কোরবোর্ডে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের জন্য শুধুই লজ্জা পড়ে থাকে। তাতেও শেষ হল না যে। দলের প্রধান পেসাররা যখন উইকেট তুলতে পারছেন না, তখন শেষ বেলায় দু’টো উইকেটই তুললেন হার্দিক। কপিল অবসর নেওয়ার পরে এমন দাপট আর কোনও অলরাউন্ডার দেখাতে পেরেছেন কি?

আরও পড়ুন: চাপমুক্ত থেকেই সাফল্য পেল

আর স্কোরবোর্ড যেটা ব্যাখ্যা করবে না, তা হচ্ছে, কী রকম ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে ইনিংসটা খেলা হল। একে তো দক্ষিণ আফ্রিকা। যেখানে পঁচিশ বছর ধরে কোনও ভারতীয় দল সিরিজ জেতেনি। গোটা দেশে কোথাও বন্ধুত্বপূর্ণ বাইশ গজ পাওয়া যাবে না। অস্ট্রেলিয়া গেলে তা-ও অ্যাডিলেড আছে, যেখানকার পিচ কিছুটা হলেও ব্যাটিং-সহায়ক। ওয়েস্ট ইন্ডিজে পোর্ট অব স্পেন রয়েছে, যেখানে ভারতের রেকর্ড বরাবর ভাল। দক্ষিণ আফ্রিকা সে রকম কোনও আতিথেয়তার ধার ধারে না। প্রত্যেকটা জায়গাতেই বল পড়ে গোলার মতো ছুটবে, লাফাবে।

পোর্ট এলিজাবেথে কপিল

১৯৯২-এর ২৯ ডিসেম্বর

• রান ১২৯ • বল ১৮০

• বাউন্ডারি ১৪ • ওভারবাউন্ডারি ১

আর কেপ টাউনের প্রথম টেস্টেই চার পেসার নামিয়ে দিয়েছে ফ্যাফ ডুপ্লেসি-র দল। কেউ কেউ রসিকতা করে বলছেন, র্যাফ নামিয়েছেন ফ্যাফ। বিখ্যাত সেই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান পেস ব্যাটারির মতোই যাঁরা কখনও শ্বাস নেওয়ার ফুরসত পর্যন্ত দেবে না ব্যাটসম্যানদের। আর এক-এক জন এক-এক রকম প্যাকেজ নিয়ে উপস্থিত হবেন। সবচেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন কাগিসো রাবাডা। নিয়মিত ভাবে ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার গতিবেগে বল করতে পারেন। দীর্ঘকায় মর্নি মর্কেলের অস্ত্র বাড়তি বাউন্স। ডেল স্টেন ভয়ঙ্কর সুন্দর। যেমন তাঁর বলের গতি, তেমনই সুইং এবং কারিকুরি। দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হওয়ার মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। গোড়ালিতে চোট পাওয়ায় সম্ভবত বাকি সিরিজ থেকে বাইরে চলে যাচ্ছেন।

এখনও শেষ হয়নি। এর পরেও আছেন ভার্নন ফিল্যান্ডার। টি-টোয়েন্টির রমরমায় ক্রিকেটে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা সুইং বোলারদের বিরল প্রতিনিধি তিনি। অফস্টাম্পের উপর একই জায়গায় মেপে মেপে বল করে যেতে পারেন ফিল্যান্ডার। শনিবার সকালে রোহিত শর্মা কী ভাবে অফস্টাম্পের বাইরে কুলকিনারা খুঁজে না পেয়েও বেঁচে গেলেন, এই টেস্টের সেরা রহস্য হয়ে থাকবে। একটা সময় পাঁচ ওভার বল করে পাঁচটাই মেডেন নিয়েছিলেন ফিল্যান্ডার। প্রথম রান দিলেন ষষ্ঠ ওভারে গিয়ে।

বিশ্বের সেরা পেস বোলিং বিভাগ। তাদের বিরুদ্ধে পরীক্ষা দিতে নামা বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং ধনী ব্যাটিং লাইন-আপ। বিদেশের মাটিতে শুরুতেই এসে খড়কুটোর মতো উড়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল। সকালে রোহিত এবং চেতেশ্বর পূজারা ‘ব্লকাথন’ চালু করেছিলেন। এই শব্দটা আদতে দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটেরই আবিষ্কার। কঠিন পরিস্থিতিতে টেস্ট ড্র করার জন্য তাদের ব্যাটসম্যানরা ‘ডেড ব্যাট’ নীতি নেন। ভারতে গিয়ে ঘূর্ণি পিচেও সেটা করেছিলেন। কথাটা ব্লক এবং ম্যারাথন মিলিয়ে তৈরি। অর্থাৎ দীর্ঘ সময় ধরে ক্রিজে পড়ে থেকে শুধু উইকেট আগলে যাও। দেখা গেল হাসিম আমলা-রা ভারতে গিয়ে অশ্বিনদের বিরুদ্ধে যে নীতি নিয়েছিলেন, সেটাই রোহিত-চেতেশ্বর এখানে পেসারদের বিরুদ্ধে নিলেন। প্রথম এক ঘণ্টায় ১৩ ওভারে যোগ হল মাত্র ১৭ রান। কিন্তু অতি রক্ষণাত্মক নীতি নিয়েও লাভ হল না।

ধস নেমে ভারত দ্রুতই আবার ৯২-৭ হয়ে গেল। সেখান থেকে বেপরোয়া ভঙ্গিতে ভারতকে ম্যাচে ফেরাতে শুরু করলেন হার্দিক পাণ্ড্য। তিনি আইপিএল এবং টি-টোয়েন্টি প্রজন্মের আবিষ্কার। মুম্বই ইন্ডিয়ান্স ওপেন ক্যাম্প থেকে স্পট করে আইপিএলের বাজারে ছেড়েছিল। ওপেন ক্যাম্পে স্পট করেছিলেন সৌরভের টিম ইন্ডিয়ার কোচ জন রাইট। তার পর রিকি পন্টিং, সচিন তেন্ডুলকর, কায়রন পোলার্ড-দের হাতে ঘষামাজা হয়ে ধারালো অস্ত্রে পরিণত হন।

ক্রিকেট বিশ্ব শনিবার দেখে নিল, টি-টোয়েন্টি ঘরানার ক্রিকেটার হয়েও টেস্ট ক্রিকেটে সফল হওয়া যায়। হার্দিকের ব্যাটিংয়ে টেস্টের ধ্রুপদী ভঙ্গি নেই, তিনি পপ সঙ্গীতের স্টাইলেই ব্যাট চালিয়ে সফল হলেন। এক্সপ্রেস গতির রাবাডাকে আপারকাট মারা থেকে স্টেন-কে লেগের দিকে সরে গিয়ে কভারের উপর দিয়ে তুলে দেওয়া— দেখে মনে হচ্ছিল সাদা পোশাকে যেন আইপিএল টি-টোয়েন্টি চলছে।

হার্দিক নামার পরে ১২৩ রান তুলেছে ভারত। তার মধ্যে ৯৩ একা তাঁর। অর্থাৎ শেষের দিকে প্রায় ছিয়াত্তর শতাংশ রান এসেছে একা তাঁর ব্যাট থেকে। আগুনের মোকাবিলা করলেন আগুন দিয়ে। মর্কেল-কে মিড-অফের উপর দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করলেন মাত্র ৪৬ বলে। দু’বার জীবনও পেলেন। এক বার স্টাম্প হতে হতে রক্ষা পেলেন। ইনিংসের শুরুতে সহজ ক্যাচ প়ড়ল স্লিপে। কিন্তু কোনও কিছুই হার্দিকের কৃতিত্বকে খাটো করতে পারবে না।

সবচেয়ে বেশি করে চোখে পড়ল তাঁর অকুতোভয় মনোভাব। এক বার রাবাডার বল পুল মারতে গিয়ে মিস করায় সজোরে এসে লাগল তলপেটে। নিউল্যান্ডসে পেসাররা বল করলে মোটামুটি পার্থের মতো অগ্নিগর্ভ আবহ তৈরি হয়। পার্থে যেমন লিলি-টমসনের জন্য দর্শকরা সারাক্ষণ রক্তলোলুপের মতো চিৎকার করে যেত, এখানেও তেমনই করে স্টেন-মর্কেলদের জন্য। তার সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে নিউল্যান্ডস মাঠের জায়ান্ট স্ক্রিনও। সকাল থেকে অবিরত স্ক্রিনে ধবন, কোহালিদের আউটের রিপ্লে দেখিয়ে যাওয়া হল। রাবাডার বলে হার্দিকের তলপেটে লাগতেই জায়ান্ট স্ক্রিনে ভেসে উঠল ‘রাবাডা রকেট্স’। সেই রকেটের ধাক্কায় বসে পড়লেও মাঠ ছেড়ে গেলেন না হার্দিক। চার পেসারের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই করে দলকে তিনি ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট থেকে বের করে আনলেন। তার পর বোলার হিসেবেও স্যালাইন আর অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করে রাখলেন।

ক্রিকেট ইতিহাস সম্পর্কে অবহিতদের হার্দিকের ইনিংস দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাওয়ার কথা ১৯৯২-এর ২৯ ডিসেম্বর। এটা কেপ টাউন। সেটা ছিল পোর্ট এলিজাবেথ। অ্যালান ডোনাল্ডের গোলা বর্ষণে ভারতীয় দল ২৭-৫ হয়ে গিয়েছিল সে দিন। সেখান থেকে পাল্টা আক্রমণ করে কপিল দেব ১৮০ বলে ১২৯ করেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠে সবচেয়ে দুঃসাহসিক ইনিংসের তালিকায় শনিবার কপিলের পাশে স্থান করে নিলেন হার্দিক।

ব্যাট হাতে ৯৩। বল করতে এসে দুই উইকেট। দেশের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারের জন্মদিনে তাঁর যোগ্য উত্তরসূরিরই হয়তো জন্ম হল টেবল মাউন্টেনে ঘেরা দর্শনীয় মাঠে! হরিয়ানা হারিকেন বলা হতো কপিল দেব-কে। তাঁর জন্মদিনে নতুন ঝড় তুলে এসে পড়ল হারিকেন হার্দিক!

Hardik Pandya South Africa India vs South Africa Cricket
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy