Advertisement
E-Paper

ইতিহাসের ইডেনকে ন্যায়বিচার এনে দিল নতুন ইতিহাস

অভিনন্দনের উত্তরে অট্টহাস্য আর ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলতে-বলতে গলা প্রায় বসে গেল। মুহুর্মুহ এগোচ্ছে বোর্ড অফিশিয়ালদের হাত, কানে আসছে অপ্রত্যাশিত প্রশংসার ধ্বনি, ‘তোমার দেড়শো বছরের শো তো হিট!’ কেমন যেন বিহ্বল দেখায় সিএবি কর্তাকে। কী বলবেন, মাথায় আসছে না। বিগলিত কণ্ঠস্বরে বারবার বলে চলেছেন, “শাস্ত্রী পর্যন্ত বলল, কী জাদু করলে দাদা! সবই তো রেকর্ড হয়ে গেল।” আড়াইশোর জার্সি না ব্যাট? কোনটা রেখে দেওয়া হবে? কোন রত্ন শোভা পাবে সিএবির ভবিষ্যত্‌ ক্রিকেট জাদুঘরে? শোনা গেল ব্যাট নয়। জার্সি। রোহিত নাকি বলেছেন, নাম লিখে দেবেন।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:৪৫

অভিনন্দনের উত্তরে অট্টহাস্য আর ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলতে-বলতে গলা প্রায় বসে গেল। মুহুর্মুহ এগোচ্ছে বোর্ড অফিশিয়ালদের হাত, কানে আসছে অপ্রত্যাশিত প্রশংসার ধ্বনি, ‘তোমার দেড়শো বছরের শো তো হিট!’ কেমন যেন বিহ্বল দেখায় সিএবি কর্তাকে। কী বলবেন, মাথায় আসছে না। বিগলিত কণ্ঠস্বরে বারবার বলে চলেছেন, “শাস্ত্রী পর্যন্ত বলল, কী জাদু করলে দাদা! সবই তো রেকর্ড হয়ে গেল।”

আড়াইশোর জার্সি না ব্যাট? কোনটা রেখে দেওয়া হবে? কোন রত্ন শোভা পাবে সিএবির ভবিষ্যত্‌ ক্রিকেট জাদুঘরে? শোনা গেল ব্যাট নয়। জার্সি। রোহিত নাকি বলেছেন, নাম লিখে দেবেন।

‘ঘরের ছেলে’ রবিন উথাপ্পা স্ট্রাইক নিচ্ছেন। ইডেনের গ্যালারি-গর্জনের তর্জমা: ওরে রবিন, আজ তুই রোহিতকে দে। রোহিতের কভার ড্রাইভটা প্রাণপণ চেষ্টাতেও আটকাতে পারলেন না লঙ্কা ফিল্ডার। ডাবল সেঞ্চুরির রাজমুকুট ধীরে ধীরে খুলছেন মরাঠি, মেক্সিকান ওয়েভের অনুরণনে কর্ণগহ্বরের দফারফা। পাঁচ নয়, জোলো ম্যাচেও ইডেনে আজ পঞ্চাশ হাজার! যারা বৃহস্পতিবারের গোটা বিকেল ধরে নাচল, গাইল, তেরঙ্গা দাপটে ওড়াল এবং ইডেনের প্রবাদপ্রতিম স্পিরিটকে আরও এক বার জিতিয়ে তবে বাড়ি ফিরল।

ইডেনের ভিতর-বাহির যাঁরা আজ দেখলেন, বিকর্ষণের চুল্লিতে চলে যাওয়া একটা ম্যাচকে মহারাজকীয় এক ইনিংসে ইতিহাস হয়ে যেতে দেখলেন, তাঁরা নির্যাসটা অবশ্যই ধরতে পারবেন।

ক্রিকেট-ঈশ্বরের ন্যায়বিচার।

ইডেন গার্ডেন্সের ন্যায়বিচার।

ড্রেসিংরুমের বাইরে রোহিতকে যখন টিম ইন্ডিয়া গার্ড অব অনার দিচ্ছে, সিএবি প্রশাসকরা তখন পারলে একুশ তোপধ্বনি দেন! ইডেনের সার্ধশতবর্ষের প্রেক্ষাপটে ম্যাচটাকেই শুধু এত দিন বর্ণহীন মনে হয়েছে। সিরিজ আগেই ৩-০, ন্যূনতম যুদ্ধের অভিলাষহীন বিপক্ষ, এমএসডি-ঋদ্ধিমান, তাঁরাও নেই। বুধবার রাতেও কোনও কোনও কর্তা ঘুমোতে গিয়েছেন এটা ভেবে যে, সাত দিন ধরে ইডেনে ক্রিকেটের দেড়শো বছরের উত্‌সব হল। স্পিন স্বর্ণযুগের ত্রয়ী এলেন। দুরানি থেকে শুরু করে ওয়াড়েকর, সবাইকে আনা হল। কিন্তু এত করেও প্রাণপ্রতিষ্ঠা হল না। আবহের কাঠামোই পড়ে থাকল। বুধবার রাত কেন, এ দিন দুপুর পর্যন্ত কেউ ভাবতেও পারেননি এ ভাবে ইতিহাস ছঁুয়ে যাবে ইতিহাসকে। দেড়শো বছরের অনুষ্ঠানপ্রবাহ মর্যাদা লাভ করবে এক মরাঠি মহাযোদ্ধার ব্যাটে। আর সেটা এতটাই যে, টানাটানি পড়বে ভিভিএস-আজহারের ইডেনের রাজসিংহাসন নিয়েও!

রোহিত শর্মা বৃহস্পতিবারের বারবেলায় যে অমিতশক্তিশালী ইনিংসটা খেললেন তা ইডেন ইতিহাসের প্রেক্ষিতে তো বটেই, ওয়ান ডে ক্রিকেটের তেতাল্লিশ বছরের ইতিহাসেও প্রচুর ওলটপালট করে দিয়ে গেল। এত দিন পৃথিবীর কোনও ব্যাটিং অধীশ্বরের ওয়ান ডে-তে দুটো ডাবল হান্ড্রেড ছিল না, আজ থেকে তার মালিকানা ‘প্রতিভাবান তবু নিষ্ঠা নেই’ রোহিতের। ওয়ান ডে-তে ২৬৪, সেটাও এত দিন ক্রিকেট-বিশ্বে কেউ করে দেখাতে পারেননি। কত রেকর্ড যে আছড়ে আছড়ে ভাঙলেন শিল্পী মরাঠি, গুনতে বসলে হিসেব গুলোতে বাধ্য।

ইডেনে ২৬৪— রেকর্ড। ওয়ান ডে-তে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ
• ইডেনে টেস্ট, ওয়ান ডে, আইপিএল, তিন ফর্ম্যাটে সেঞ্চুরি— এক এবং অদ্বিতীয় রোহিত শর্মা
• সহবাগের ২১৯, সেটাও চুরমার। নতুন সম্রাট— রোহিত শর্মা
• ইডেনে চারশো— এটাও রেকর্ড, আবার ‘থ্যাঙ্কস টু রোহিত’।

ইডেন এত দিন অনেক কিছু দিয়েছে রোহিতকে। রঞ্জি অভিষেক তাঁর এই মাঠে, ডাবল হান্ড্রেড দিয়ে। আইপিএল যুদ্ধে তিনি বনাম কেকেআরে তাঁর সঙ্গে থেকেছে ইডেন, দিয়েছে সেঞ্চুরি। সচিন তেন্ডুলকর ইডেনে বিদায়ী টেস্ট ম্যাচে নামলেন আর দেখলেন, ১৭৭ করে মহানায়ক অন্য এক মরাঠি। ইডেনের সম্মানরক্ষার প্রয়োজনে আজ রোহিতের রিটার্ন গিফটের দিন ছিল। আর সেটা এল শিল্পের সঙ্গে ধ্বংসের ককটেলে।

থিসারা পেরেরা সম্ভবত নিজের দুটো হাতকে জীবনে ক্ষমা করতে পারবেন না। থার্ড ম্যানে লোপ্পাটা যদি না পড়ত, তা হলে রোহিত-রূপকথা হয় না। রোহিত শর্মা নিয়ে মুম্বই ক্রিকেটমহলে একটা প্রবাদ আছে। ছেলেটাকে তিরিশ করা পর্যন্ত ঠুকঠুক মাস্টার দেখাবে, তিরিশ পেরোলে অবিকল ইনজামাম-উল-হক! বাউন্ডারি-ওভার বাউন্ডারির জন্য এতটুকু খাটাখাটনি নেই, ওগুলো যেন আপনাআপনিই বেরোচ্ছে ব্যাট থেকে। পুরো ব্যাপারটাই ঘটছে অপার্থিব মসৃণতায় যে মনে হবে ব্যাট নয়, কেউ হাতে তুলি আর সামনে ক্যানভাস রেখে গিয়েছে। ইডেনের তেত্রিশ বাউন্ডারি আর নয় ওভার বাউন্ডারি যার প্রামাণ্য নথি। যে নথি দেখাবে প্রথম পঞ্চাশ ৭২ বলে, সেঞ্চুরি করতে একশো বল, পরের দেড়শো ৬৬ বলে!

সত্যিই ভারতের ‘ইনজি’।

কী সব শট! অফস্টাম্প লাইন থেকে পেসারকে কব্জির মোচড়ে ফ্লিক, স্পিনারকে পরের পর ‘বাপি বাড়ি যা’-য় ইডেন পার। আর মরাঠির মহাকাব্যের বিচার মোটেও শুষ্ক পরিসংখ্যানের মানদণ্ডে করলে হবে না। করতে হবে পরিস্থিতি, প্রেক্ষাপট বিচারে। মনে রাখতে হবে, এই একই রোহিতকে ব্যর্থতা সত্ত্বেও বারবার খেলিয়ে যাওয়ার জন্য সমালোচনা-বিদ্ধ হতে হয়েছে মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে। বেঙ্গালুরুতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে জীবনের প্রথম দ্বিশতরানেও যে ক্ষতে প্রলেপ পড়েনি। মনে রাখতে হবে, গত আড়াই মাস চোটে আক্রান্ত হয়ে মাঠের বাইরে বসে থাকতে হয়েছে রোহিতকে। দেখতে হয়েছে, কী ভাবে ব্যাটিং লাইন আপে তাঁর জায়গাটা ধীরে ধীরে গ্রাস করছেন অজিঙ্ক রাহানে নামের আর এক মুম্বইকর। আর বৃহস্পতিবার রোহিতের একটা ভুলের জন্য মাঠজুড়ে শুধু শ্রীলঙ্কান ফিল্ডাররা অপেক্ষায় ছিলেন না। অদৃশ্য ভাবে জাতীয় নির্বাচকরাও ছিলেন। রাহানের সঙ্গে আজ জিততে না পারলে অস্ট্রেলিয়ার বিমান রোহিতের ধরা হত কি না সন্দেহ। বিশ্বকাপেও তাঁর নামটা ছেঁটে ফেলতে হাত কাঁপত না। অদৃষ্টের পরিহাসে রাহানে আজই দৃষ্টিকটু ভাবে এলবিডব্লিউ হলেন। আর জীবন পেয়ে, রান আউট নিয়ে ক্যাপ্টেনের ধাতানি খেয়েও রোহিত এমন এক অমর থ্রিলার উপহার দিয়ে গেলেন যে, সমালোচকদের এর পর টুঁ শব্দ করতে গেলে স্ট্যাটিসটিক্সের কানমলা খেতে হবে!

শ্রীলঙ্কা ব্যাটিংয়ের কিছু করার ছিল না। একটা সময় পর্যন্ত তারা লড়ার চেষ্টা করেছে, ভারতের সঙ্গে এক সময় সমানে সমানে রান রেখে গিয়েছে, থিসারার ছক্কাগুলো মৃদু কম্পনও তুলে দিয়েছিল। কিন্তু তারা তো রোহিতের রানটাও টপকাতে পারল না। আসলে শুক্তোর মশলা দিয়ে যেমন পোলাও রান্না সম্ভব নয়, তেমনই রূপকথার বিরুদ্ধে জিততে রূপকথা লাগে। আর এমন ঐতিহাসিক দিনে অঘটন ঘটলে অন্যায়ই হত। সেঞ্চুরির পর দৌড়োতে-দৌড়োতে রোহিত আকাশের দিকে আঙুল তুলে স্বগতোক্তি করছেন, হাঁটু গেড়ে বসে আবার প্রার্থনায় ডুব— ওটাই তো স্বপ্নের ফ্রেম, ওটাই তো ছবি। ক্রিকেট রোহিতের থেকে কেড়ে নিয়েছিল অনেক, ফিরিয়ে দিল প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি। ইতিহাসের মঞ্চে নতুন ইতিহাসের জন্ম দিয়ে।

স্বর্গের টিভিতে বসে ম্যাচটা এমিলি আর ফ্যানি ইডেন দেখলেন কি না জানা নেই। দেখলে গর্বের হাসির সঙ্গে দু’এক ফোঁটা আনন্দাশ্রুও নিঃসন্দেহে ঝরেছে!

শঙ্কর নাগ দাসের তোলা ছবি।

rohit sharma cricket india-sri lanka world record one day international 264 highest one day score rajarshi gangopadhyay Highest individual score Eden garden sports news online news
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy