ক্রিকেট থেকে ফুটবল দুনিয়ার শ্রদ্ধার্ঘ্য। ডালমিয়া-পুত্র অভিষেক।
ইডেনের ক্লাব হাউসে এসে থামল সেই গাড়ি। আজ কিন্তু সেই ছাইরঙা মার্সিডিজ থেকে নামলেন না তিনি, এত দিন এই গাড়ি চড়েই যিনি ইডেনে আসতেন। নামলেন তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-পুত্রবধু।
জগমোহন ডালমিয়া আর এই গাড়ি চড়ে কোনও দিন ইডেনে আসবেন না। তবু এই ইডেনে তিনি থাকবেন চিরস্মরণীয় হয়ে।
তাঁর বাবার কাছে যা ছিল মন্দির, সেই ইডেনের ক্লাব হাউসে দাঁড়িয়ে চোখের জল সামলাতে সামলাতে কন্যা বৈশালী বলছিলেন, ‘‘গাড়িটাতে উঠে এখানে আসতে খুব খারাপ লাগছিল। বাবার স্মৃতিগুলো যেন ফিরে আসছিল চোখের সামনে। এখনও ভাবতে পারছি না উনি নেই। যেখানে যাচ্ছি, বাড়িতে, ওঁর অফিসে, ইডেনে— সর্বত্রই মনে হচ্ছে, ওই তো, যেন বসে রয়েছেন।’’
জগমোহন ডালমিয়া নেই। তবু তিনি আছেন। তাঁর দেখানো পথ আছে। বুধবার ইডেনের বিষণ্ণ বিকেলে তাঁর স্মরণসভায় ডালমিয়া-সঙ্গী ও তাঁর উত্তরসূরিদের কথায় যে নির্যাস উঠে এল, তাতে এই ইঙ্গিত স্পষ্ট যে, তিনি সবার মাথার উপর রয়েছেন, এ কথা মাথায় রেখেই এখন থেকে চলবে সিএবি পরিবার। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শুরু করে সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়। সবাই সেই অঙ্গীকারই করে গেলেন ডালমিয়ার স্মরণ-মঞ্চে দাঁড়িয়ে।
শ্রদ্ধার্ঘ। শোকগাথা। স্মৃতিচারণ। আবেগ। প্রতিশ্রুতি। বুধবার বিকেলে এ সবই পাওয়া গেল ঘন্টাখানেকের স্মরণসভায়। চার দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রয়াত মহাকর্তার নানা মেজাজের ‘পোর্ট্রেট’। প্রতিটির নীচে রবীন্দ্র-কবিতার মর্মস্পর্শী অংশ। সিএবি কোষাধ্যক্ষ বিশ্বরূপ দে-র তত্ত্বাবধানে সজ্জিত এই পরিবেশেই যেন আবেগের বাঁধ ভাঙার উপক্রম। বিশ্বরূপের সঞ্চালনাতেও বেদনার সুর। যে ইডেনে কয়েক মাস আগেই তাঁকে বরণ করা হয়েছিল বোর্ড প্রেসিডেন্টের মসনদে প্রত্যাবর্তনের জন্য। সেই ইডেনেই তাঁর স্মরণসভা! উপস্থিত অনেকেরই চোখেমুখে যেন বিস্ময়ের ঘোর।
ক্রিকেট প্রশাসনে গুরু ‘জগুদা’কে যেমন চোখের জলে স্মরণ করলেন গৌতম দাশগুপ্ত, চিত্রক মিত্ররা। তেমনই ভারতীয় ক্রিকেটকে বিশ্বের দরবারে তুলে আনার জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন সঞ্জয় মঞ্জরেকর, ভিভিএস লক্ষ্মণ, সৌরভরা। ময়দানের সেরা প্রশাসককে শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে আসেন ৮৫-র বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়ও। বাংলার একঝাঁক প্রাক্তন ক্রিকেটার— সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তপনজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়, রণদেব বসু, জয়দীপ মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে বর্তমান বাংলা দলের মনোজ তিওয়ারি, সৌরাশিস লাহিড়ী, ঋদ্ধিমান সাহা, অশোক দিন্দারাও না এসে পারেননি।
সৌরভের কথায়, ‘‘বিশ্বের যে প্রান্তে খেলতে গিয়েছি, সেখানকার লোকেদের বলতে শুনেছি, ‘ডালমিয়াজিকে আমাদের সেলাম জানাবেন’। দেখে অবাক হয়েছি, সব দেশেই ওঁর গুণমুগ্ধ, বন্ধু আছেন। আমি ওঁর শহরেরই ছেলে বলে সবাই আমাকে এসেই বলতেন এই কথা।’’ মঞ্জরেকর বললেন, ‘‘যিনি কখনও ক্রিকেট কর্তাদের ভাল চোখে দেখেন না, সেই ইয়ান চ্যাপেলও ডালমিয়াজি সম্পর্কে ইতিবাচক কথা বলেছেন। এর থেকেই বোঝা যায়, তিনি কেমন প্রশাসক ছিলেন। উনি ছিলেন গুড অ্যাডমিনিস্ট্রেটর উইথ ক্রিকেটিং হার্ট।’’
প্রাক্তন টেস্ট তারকা সঞ্জয় মঞ্জরেকর। স্মৃতিচারণে সিএবি কোষাধ্যক্ষ বিশ্বরূপ দে এবং যুগ্ম সচিব সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।
বোর্ডের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট চিত্রক মিত্র যখন বলছিলেন, ‘‘মিকিকে (ডালমিয়া-পুত্র অভিষেক) প্রায়ই বলতাম তুই ওঁর ছোট ছেলে, আমি বড় ছেলে’’, তখন আর চোখের জল সামলাতে পারলেন না। ক্রিকেট প্রশাসনের তাঁর পিতৃসম ডালমিয়ার বহু স্মরণীয় কীর্তির নেপথ্য কাহিনি শুনিয়ে বললেন, ‘‘ওঁর কাছ থেকে কী পেয়েছি জানি না। তবে প্রচুর ভালবাসা পেয়েছি। উনি যেখানেই থাকুন ওঁর চোখ দুটো থাকবে ইডেনে।’’ বোর্ডের প্রাক্তন যুগ্মসচিব গৌতম দাশগুপ্তর স্বীকারোক্তি, ‘‘চল্লিশ বছর ধরে ক্রিকেট প্রশাসনে যা করেছি, সবই জগুদার ছত্রছায়া ছিল বলেই করতে পেরেছি।’’ ভারতীয় বোর্ডের যুগ্মসচিব অমিতাভ চৌধুরি এমন একটা কথা দিয়ে শেষ করলেন, যা পরিবেশকে যেন আরও গম্ভীর করে দিল। বললেন, ‘‘মহাত্মা গাঁধীর মৃত্যুর পর জওহরলাল নেহরু যে কথাগুলো বলেছিলেন— ‘দি লাইট হ্যাজ গন আউট অব আওয়ার লাইভস’। এখনও সেই কথাই মনে হচ্ছে।’’
স্মরণসভার শেষে একসময় ক্রিকেট প্রশাসনে তাঁর সতীর্থ প্রকাশ পোদ্দার বললেন, ‘‘আমার ৭৫তম জন্মদিনে পরিবারের সদস্যরা একটা অনুষ্ঠান করবে বলে ঠিক করেছে। ভেবেছিলাম সেখানে জগুদাকে নিমন্ত্রণ জানাব। উনি সুস্থ থাকলে নিশ্চয়ই আসতেন। আর সে সুযোগ পাব না। এই আফসোসটা চিরকালই রয়ে যাবে আমার। ১৯৫৭ থেকে ওঁর সঙ্গে মিশছি। এই ইডেনেই ওঁর সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল গত জুলাইয়ে। সেই ইডেনেই আসতে হল তাঁর স্মরণ সভায়! ভাবতে পারছি না। ওঁর মতো ক্রীড়া প্রশাসক সারা দুনিয়ায় আর একটা জন্মাবে না বোধহয়।’’
স্মরণ প্রাক্তন অলিম্পিক্স অধিনায়ক বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বুধবার সিএবি-তে।
জগমোহন ডালমিয়ার স্মরণ-মঞ্চ থেকে উঠে এল এক প্রস্তাবও। ইডেনের যে প্রবেশপথ দিয়ে ক্লাব হাউসে প্রবেশ করতেন ক্রিকেট সাম্রাজ্য শাসন করা এই মহাকর্তা। সেই প্রবেশপথ হোক ডালমিয়ার নামাঙ্কিত। যা শুনে হবু সিএবি প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন, ‘‘স্যরের (স্মরণ-মঞ্চেও তাঁকে এই নামেই সম্বোধন করলেন সৌরভ) নামে স্ট্যান্ড করার কথা তো ভেবেই রেখেছি। মূর্তিও বসানো হবে। সেই মূর্তি বানাতেও দেওয়া হয়ে গিয়েছে। গেটের প্রস্তাবটাও খারাপ নয়। হয় স্ট্যান্ড, নয় গেট— যে কোনও একটা ওঁর নামে করা হবে।’’ বিশ্বরূপের ইচ্ছা, ‘‘দুটোই হোক না। তাতে ক্ষতি কী?
এই বিষাদের মধ্যেও অবশ্য কন্যা বৈশালীর আক্ষেপ যাচ্ছে না তাঁর বাবার শেষ সময়ের চিকিৎসা নিয়ে। বললেন, ‘‘বাবার মৃত্যুর দশ দিন পর অস্ত্রোপচারের সিডি-টা পেলাম হাসপাতাল থেকে। এত সময় লাগল কেন, কে জানে? সত্যিই বাবার অস্ত্রোপচারের সিডি কি না, তাই বা জানব কী করে? কিন্তু এখন এই সময় আর কিছু ভাবতে পারছি না।’’
আক্ষেপ, আফসোস, বেদনা। সবই তাঁকে ঘিরে। জগমোহন ডালমিয়া। যিনি আজ নেই। তবে থাকবেন চিরকাল। ইডেনের আকাশে। ইডেনের ঘাসে ঘাসে।
ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy