Advertisement
E-Paper

টেস্টের সঙ্গে মনও জিতলেন কোহালিরা

দিমুথ করুণারত্নে নিশ্চয়ই বীরেন্দ্র সহবাগ নন। অশ্বিনের স্টাম্পের বল ওড়াতে গিয়ে বোল্ড হলেন। পার্সির আবেগ বা লড়াইয়ের ছিটেফোঁটাও যদি করুণারত্নে-রা দেখাতে পারতেন!

সুমিত ঘোষ

শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৭ ০৪:২৪
শনিবার গলে প্রথম টেস্ট জেতার পরে বিরাট হুঙ্কার। কোহালির ভারত সিরিজে এগিয়ে গেল ১-০। ছবি: এএফপি

শনিবার গলে প্রথম টেস্ট জেতার পরে বিরাট হুঙ্কার। কোহালির ভারত সিরিজে এগিয়ে গেল ১-০। ছবি: এএফপি

বিরাট কোহালির ভারতকে নিয়ে যখন উৎসবের আবহ, তখন ঐতিহাসিক গলের মাঠে করুণ এক দৃশ্য চোখে পড়ল।

বিষণ্ণ, পরাভূত এক যোদ্ধার মতো মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। হাতে তখনও শ্রীলঙ্কার বিশাল পতাকা ধরা। গত ছয় দশক ধরে এ ভাবেই শ্রীলঙ্কার পতাকা নিয়ে দেশ-বিদেশের মাঠে চিয়ারলিডারের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন পার্সি অভয়শেখর। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে ইডেনের সেই সেমিফাইনালেও উপস্থিত ছিলেন। কখনও এতটা হতাশ দেখায়নি। রবিবার, টেস্টের শেষ দিনে তাঁর ৮১তম জন্মদিন পালিত হওয়ার কথা ছিল মাঠে। নিজের দেশের ক্রিকেটারদের অপদার্থতায় সে সবই ভেস্তে গেল।

আরও পড়ুন: কোহালি যুগ শুরু বিরাট জয় দিয়ে

ভারতীয় বোলাররা টুঁটি চিপে ধরেছে দেখেও পার্সির দেশের ব্যাটসম্যানরা স্পিনারদের রিভার্স সুইপ মারার মতো দুঃসাহস দেখাতে গেলেন। ৯৭ রানে দাঁড়িয়ে সাধারণত ব্যাটসম্যান নিজের সেঞ্চুরি সম্পর্কে যত্নবান হয়। দিমুথ করুণারত্নে নিশ্চয়ই বীরেন্দ্র সহবাগ নন। অশ্বিনের স্টাম্পের বল ওড়াতে গিয়ে বোল্ড হলেন। পার্সির আবেগ বা লড়াইয়ের ছিটেফোঁটাও যদি করুণারত্নে-রা দেখাতে পারতেন!

শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে পার্সিকে টেনে তুলল বরং ভারতীয় ড্রেসিংরুম। নিজেদের উৎসব করার মুহূর্তেও কোহালিরা সৌজন্য হারালেন না। এই গলেই ২০১৫-র সফরে এসে প্রথম টেস্টে বিশ্রী ভাবে জেতা ম্যাচ হেরে যায় কোহালির তরুণ টিম ইন্ডিয়া। তখন সবে অধিনায়ক হয়েছেন কোহালি। টিমের ডিরেক্টর সেই রবি শাস্ত্রীই। আজ একই মাঠে সেই ম্যাচের ঘাতক রঙ্গনা হেরাথকে চূর্ণ করে লম্ফঝম্ফ দিতেই পারতেন তাঁরা। দেননি। বরং, তাঁদের মনোভাব দেখে মনে হল— আপসহীন, আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলে তোমাদের হারিয়েছি ঠিক আছে। কিন্তু গোল দড়ির ওপারে যুদ্ধের মেজাজ টেনে নিয়ে যাব না।

সত্যিই বাহবা দেওয়ার মতো মনোভাব দেখালেন ভারতীয় ক্রিকেটারেরা। আর সেই কারণে শ্রীলঙ্কাকে চার দিনের মধ্যে হারিয়ে শ্রীলঙ্কান দর্শকদেরও মন জয় করে নিলেন তাঁরা। পার্সি তো ছিলেনই, কোহালি যখন বিজয়ী ক্যাপ্টেন হিসেবে পুরস্কার মঞ্চে যাচ্ছেন, বাউন্ডারির বাইরে অপেক্ষারত শ্রীলঙ্কান দর্শকরা তাঁর নামে ‘ও.. ও.. ও.. কোহালি, ও.. ও.. ও.. কোহালি’ গান ধরল। মাঠ ছেড়ে বেরনোর সময়েও ভারতীয় দলের টিমবাসের পাশে রাস্তায় অনেক শ্রীলঙ্কান দাঁড়িয়ে। রেলিংয়ের মধ্যে থেকে তাঁরা অটোগ্রাফের খাতা বাড়িয়ে দিলেন। কোহালি তাঁদেরও নিরাশ করলেন না। দাঁড়িয়ে পড়লেন সই দিতে।

শাস্ত্রীকে আবার দেখা গেল সৌজন্যমূলক হ্যান্ডশেকের সময় খুব চিন্তিত ভাবে হেরাথকে জিজ্ঞেস করছেন, তোমার হাত কেমন আছে? অথচ হেরাথ তাঁদের এক নম্বর শত্রু এবং শাস্ত্রীয় ভঙ্গি হচ্ছে, মাঠে নেমে কাউকে ছাড়ব না। খেলার দিনে যেমন ছিল, কোচ হিসেবেও সে রকমই আছে। আঙুলের চোট নিয়ে যত বিব্রত থাকেন শ্রীলঙ্কার বাঁ হাতি স্পিনার, তত শাস্ত্রীর টিমের লাভ। কিন্তু আগেও ডিরেক্টর থাকার সময় মাঠে আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলার শপথ নিলেও বিরাটদের মধ্যে স্পোর্টসম্যান স্পিরিট গড়ে তোলার ব্যাপারেও উদ্বুদ্ধ করেছেন শাস্ত্রী। কোচ হিসেবে প্রত্যাবর্তনের প্রথম ম্যাচেও সেই স্পিরিট হাজির ছিল।

অধিনায়ক কোহালি গিয়ে হাত ধরে নিয়ে এলেন বিষণ্ণ পার্সি অভয়শেখর-কে। ভারতীয় দলে পার্সির প্রিয় বন্ধু রোহিত শর্মা এসে সান্ত্বনা দিয়ে গেলেন। পুরস্কার মঞ্চে এমনিতে বাইরের লোকের প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু কোহালি ডাকায় কিছুক্ষণের জন্য পার্সিকে থাকতে দেওয়া হল সেখানে। তার পর টিভি সম্প্রচারের জন্য সরে যেতে হলেও কোহালির ইশারায় তাঁকে কাছাকাছিই রাখা হল। পুরস্কার মঞ্চে ক্যাপ্টেনের ইন্টারভিউ সেরে কোহালি আবার পার্সির সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ হলেন। ভারত অধিনায়কের গালে চুম্বন দিয়ে বিদায় নিলেন পার্সি।

৩০৪ রানের এই জয় বিদেশের মাঠে রানের ব্যবধানে জেতার দিক থেকে সর্বোত্তম। তার জন্য কাউকে খুব উচ্ছ্বাসহীন উৎসব করতে দেখা না গেলেও খুশির আবহ অবশ্যই ছিল। নতুন কোচ রবি শাস্ত্রী ফিরে এসেই জয় দিয়ে শুরু করলেন। ড্রেসিংরুমের সিঁড়ি দিয়ে যে ভাবে তিনি তরতর করে নেমে গেলেন, দেখে মনে হবে বয়সটাই কমিয়ে দিয়েছে এই জয়। পঞ্চাশতম টেস্ট খেলা আর. অশ্বিন ম্যাচ থেকে নিলেন চার উইকেট। কিন্তু প্রভাবের দিক থেকে সেটা দশ উইকেটের সমান। শ্রীলঙ্কার ব্যাটসম্যানরা গোটা টেস্ট ম্যাচ ধরে অশ্বিনকে খেলার সময় আতঙ্কিত হয়ে থাকলেন। ম্যাচের শেষে বিশেষ স্মারক তুলে দেওয়া হল তাঁর হাতে।

ও দিকে অশ্বিনের স্ত্রী প্রীতি আবার অন্য কাণ্ড ঘটালেন। স্বামীর দ্বিতীয় ইনিংসের সংহার দেখতে ভিআইপি বক্সের এয়ার কন্ডিশন কক্ষ ছেড়ে তিনি উঠে গিয়েছিলেন গল ফোর্টের ছাদে। গলের মাঠের ঠিক গায়েই এই ফোর্ট। পাশ দিয়ে সমুদ্র। স্থানীয়রা অনেকেই তাই ফোর্টের ছাদে উঠে খেলা দেখে। সমুদ্রের শোভা আর ক্রিকেট— সব মিলিয়ে আকর্ষণীয় ট্যুরিস্ট প্যাকেজ। কিন্তু অশ্বিন-স্ত্রী যে কোনও কিছুর পরোয়া না করে ফোর্টের ছাদে উঠে পড়বেন, কে ভাবতে পেরেছিল! ব্যাপারটা জানাজানি হল অশ্বিন একটা উইকেট নেওয়ার পর কয়েক জন সতীর্থ ফোর্টের দিকে হাত তুলে দেখানোয়।

কোহালি পরে সাংবাদিক সম্মেলনে এসে বলছিলেন, এই টিমটার আসল ব্যাপার হচ্ছে, যে কেউ পারফর্ম করে দিতে পারে। কোনও এক জন নায়ক নয়। মিলিত ভাবে সকলে জেতাচ্ছেন। ‘‘শিখর মেলবোর্নে ছুটি কাটাতে যাবে ভেবেছিল। মুরলী বিজয় না থাকায় ওকে ডাকা হল। এখানে নেমে ১৯০ করে দিল।’’ ম্যাচের সেরা ধবন বললেন, ‘‘টিমে ওপেনারদের নিয়ে স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা রয়েছে। সেটা আমাদের সকলের উপকারই করছে। রান করেও তাই আমার আত্মতুষ্ট হওয়ার উপায় নেই।’’

স্কোরবোর্ডের দিকে তাকালেও কোহালির কথাই ঠিক বলে মনে হবে। সম্মিলিত পারফরম্যান্সের জয়। ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ধবন, পূজারা সেঞ্চুরি করলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে সেঞ্চুরি করলেন কোহালি। টেস্টে তাঁর ১৭তম সেঞ্চুরি। রান করে দিলেন অভিনব মুকুন্দ। বোলারদের মধ্যে পেসার এবং স্পিনাররা মিলেজুলে উইকেট তুললেন। গলে ব্যক্তি নয়, দলই নায়ক।

ভারত মহাসাগরে ঘেরা অপরুপ এক ক্রিকেট মাঠে এই টিমগেমের মন্ত্রেই শাস্ত্রী-কোহালি জুটির হাত ধরে নতুন যাত্রা শুরু হয়ে গেল। সামনের এক বছর বেশির ভাগ টেস্ট খেলতে হবে বিদেশে। ভয়ঙ্কর সেই চ্যালেঞ্জ এই টিম কতটা সফল ভাবে নিতে পারবে, তা সময়ই বলবে। কিন্তু বলে দেওয়া যায়, সেই অভিযানে গল যে খুব উল্লেখযোগ্য এক স্টেশন হয়ে থাকবে কোহালির ভারতের কাছে!

India vs Sri Lanka Galle test Cricket Virat Kohli বিরাট কোহালি
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy