Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ও তো শেষ, শুনে ফেরার শপথ নেন বক্সার মেরি

বুধবার হো চি মিন সিটি থেকে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে তাঁর পঞ্চম সোনার পদকটি আনার পর এই কথাটিই প্রথমে বললেন মেরি কম।

সেরা: অবসর নিয়েও ফিরে এসেছেন। মেরি কম সেই অপ্রতিরোধ্য। বুধবার ভিয়েতনামে সোনা জিতলেন এশীয় চ্যাম্পিয়নশিপে। এই নিয়ে পঞ্চমবার হলেন এশীয় সেরা। ছবি: পিটিআই।

সেরা: অবসর নিয়েও ফিরে এসেছেন। মেরি কম সেই অপ্রতিরোধ্য। বুধবার ভিয়েতনামে সোনা জিতলেন এশীয় চ্যাম্পিয়নশিপে। এই নিয়ে পঞ্চমবার হলেন এশীয় সেরা। ছবি: পিটিআই।

দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০১৭ ০৪:১৯
Share: Save:

ফিনিশড!

এই একটি শব্দই গত দু’বছর ধরে তাঁকে ছুটিয়েছে। ঝরিয়েছে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

এই একটিু শব্দই রাজ্যসভার সদস্য ও তিন সন্তানের মা মেরি কমকে দায়িত্ব পালনের পরও বক্সিং রিংয়ে গত দু’বছরে টেনে এনেছে বার বার।

বুধবার হো চি মিন সিটি থেকে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে তাঁর পঞ্চম সোনার পদকটি আনার পর এই কথাটিই প্রথমে বললেন মেরি কম।

কী সেই ঘটনা? রিও অলিম্পিক্সে অংশগ্রহণ করতে না পেরে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন ভারতের ‘ম্যাগনিফিসেন্ট মেরি’। দু’বছর আগে নয়া দিল্লি বিমানবন্দর থেকে বেরোনোর সময় জনৈক যাত্রী মেরি কমকে দেখিয়ে তাঁর সঙ্গীকে নাকি বলেছিলেন ‘‘ওই দেখো বক্সার মেরি কম। কিন্তু ওর কেরিয়ার এখন শেষ।’’

হো চি মিন সিটিতে এ দিন উত্তর কোরিয়ার বক্সার কিম হিয়াং মি-কে হারিয়ে ওঠার পরে তাই ‘ফিনিশড’ শব্দটা ফিরে আসে মেরি কমের গলায়। একটু পরেই ভিয়েতনাম ছেড়ে উড়ে যেতে হবে সুইৎজারল্যান্ডের লুসানে। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির অ্যাথলিট ফোরামে আইবা-র প্রতিনিধিত্ব করার জন্য। সে কথা জানিয়ে সোনার মেয়ে মেরি প্রথমে বলেন, ‘‘তাড়াতাড়ি কথা শেষ করুন। আমাকে একটু পরেই ভিয়েতনাম ছেড়ে যেতে হবে সুইৎজারল্যান্ড। আমার খেলোয়াড় জীবন সব দায়িত্ব পালন করতে শিখিয়েছে মসৃণ ভাবে।’’

আরও পড়ুন: সিন্ধু বধ করে দশ বছর পরে ভারতসেরা সাইনা

এর পরেই সোনার পদক গলায় ঝুলিয়ে হোটেলে ফেরার সময় মেরি বলতে থাকেন, ‘‘ওই ব্যক্তিকে ধন্যবাদ যিনি আমাকে দেখিয়ে ‘ফিনিশড’ বলেছিলেন। কথাটা শুনে প্রথমে খুব ভেঙে পড়েছিলাম। তার পরে দেখলাম, সত্যিই তো আমি আজ চ্যাম্পিয়ন নই। ওই শব্দটাই আমাকে গত দু’বছর তাড়িয়ে বেরিয়েছে। ওই ব্যক্তিকে ধন্যবাদ। উনি আমার রিংয়ে ফেরার তাগিদ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।’’

আর ফিরে আসার লড়াই?

মেরি কম বলেন, ‘‘শুরুর দিকে ফিটনেস সমস্যা হচ্ছিল। তাই রোজ সকালে সাত কিলোমিটার ছুটতাম। তার পরে টানা তিরিশ মিনিট স্কিপিং। সঙ্গে ব্যায়াম। চলত সকাল ছ’টা থেকে সাড়ে আটটা। তার পরে বাড়ি ফিরে রাজ্যসভায় হাজিরা দেওয়া। না হলে বাড়ির কাজকর্ম। বিকেল পাঁচটা বাজলেই ঠিক হাজির হতাম অনুশীলন শিবিরে।’’

এ বার নিজেকে সামলাতে পারেন না মেরি। গলায় দলা পাকিয়ে ওঠে কান্না। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘‘আজকের দিনটার আনন্দ আমার কাছে অনেক। আমার প্রত্যেকটা সাফল্যের পিছনে একটা করে গল্প রয়েছে। কিন্তু এই পদকের জন্য লড়াইটা খুব সহজ ছিল না। বয়সটা পঁয়ত্রিশ হয়ে গিয়েছিল। তিন তিনটে সন্তান বাড়িতে। কোচেরা বলেছিলেন, পরিশ্রম কর। ফের এশিয়া সেরা হতে পারবি। অনুশীলনে ফাঁকি দিইনি।’’

সেই পরিশ্রম আর ফিটনেস-ই যে এ দিন মেরিকে জেতাল তা স্বীকার করছেন ভারতীয় দলের অন্যতম কোচ ও বাংলার প্রাক্তন বক্সার আলি কামার। তাঁর কথায়, ‘‘মেরির প্রতিপক্ষ উত্তর কোরিয়ার মেয়েটা ওর চেয়ে লম্বা ছিল। রিংয়ে ঢোকার আগে মেরি ওর ব্যক্তিগত কোচ ছোটেলাল যাদব আর আমার সঙ্গে কথা বলছিল। তখনই আমরা রণনীতি ঠিক করে দিয়েছিলাম।’’

কী সেই রণনীতি? আলি কামারের কথায়, ‘‘শুরু থেকেই আক্রমণে গিয়ে বিপক্ষকে পাল্টা এগিয়ে আসতে প্রলুব্ধ কর। তার পর সে ঘুসি চালালে সেগুলোকে এড়িয়ে যাও ফিটনেস কাজে লাগিয়ে। এ বার বিপক্ষ নিজেকে সামলাবে। ঠিক সেই সময় প্রতি আক্রমণ করে শেষ করে দাও।’’ ম্যাচেও কি তাই হয়েছে? ভারতীয় বক্সিং কোচ হাসতে হাসতে বলেন, ‘‘বিপক্ষের ঘুঁসি মেরি এমন ভাবে এড়াচ্ছিল ফিটনেস কাজে লাগিয়ে, মনে হচ্ছিল আমরা কোনও চার্লি চ্যাপলিনের ছবি দেখছি। পর পর দু’ রাউন্ডেই ৫-০ করে জেতার পর বুঝে গিয়েছিলাম আজ মেরির দিন।’’ যদিও প্রথম দুই রাউন্ডে এক তরফা জিতলেও তৃতীয় রাউন্ডে হেরে গিয়েছিলেন মেরি। কিন্তু প্রথম দু’রাউন্ডের ঝকঝকে ফলের সুবাদে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় তাঁকে। মেরি প্রত্যাবর্তন দেখতে এ দিন স্টেডিয়ামে জড়ো হয়েছিলেন ভারতীয় দূতাবাসে কর্মরতরা এবং তাঁদের পরিবার। স্টেডিয়াম ছাড়ার আগে তাঁদের অভিবাদন নিতে গিয়ে কেঁদেও ফেলেন মেরি।

মেরি আগে নামতেন ৫১ কেজি বিভাগে। কিন্তু এখন নামছেন ৪৮ কেজি বিভাগে। শেষ মুহূর্তে যাতে ওজন যাতে না বেড়ে যায়, তাই গত একমাস রাতে খেতেন না। বিকেলে অনুশীলন সেরে খাবার খাওয়ার পর সকালে দেহের ওজন মাপতেন। তার পরে অনুশীলন করে খাবার খেতেন। কিন্তু ফাইনালে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য এতটাই একাগ্র ছিলেন মণিপুরের মেয়ে যে মঙ্গলবার বিকেলে অনুশীলনের পর ভারি খাবার খাননি। ফলের রস খেয়েই ঘুমোতে চলে যান। বুধবার সকালে উঠে ওজন মেপে দেখার পরে ফল আর স্যান্ডউইচ খেয়ে চলে এসেছিলেন রিংয়ে।

তাই সোনা জেতার পরে আগামী লক্ষ্য জানতে চাইলে মণিপুরের মেয়ে এ বার হাসতে থাকেন। বলেন, ‘‘কমনওয়েলথ আর এশিয়ান গেমস জিততে হবে। আর তার আগে হোটেলে ফিরে খেতে হবে। সারা রাত খাইনি। খুব খিদে পেয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE