বাটলার ও অশ্বিন। বিতর্কের পারদ চড়ছে। ছবি: এএফপি।
ভারতীয় দলের তারকা অফস্পিনার অশ্বিনের মাঁকড়ীয় ভঙ্গিতে জস বাটলারকে আউট করা নিয়ে উত্তাল ক্রিকেট বিশ্ব। মঙ্গলবার মুখ খুলেছেন অস্ট্রেলীয় স্পিন কিংবদন্তি এবং রাজস্থান রয়্যালসের উপদেষ্টা শেন ওয়ার্ন। টুইটারে তোপ দেগে তিনি বলেছেন, ‘‘অশ্বিন যে ঘটনা ঘটিয়েছে, তা কলঙ্কজনক এবং খেলোয়াড়ি মনোভাব বিরোধী।’’
সোমবার রাজস্থান রয়্যালস বনাম কিংস ইলেভেন পঞ্জাবের ম্যাচে দুরন্ত ছন্দে থাকা জস বাটলারকে মাঁকড়ীয় ভঙ্গিতে আউট করে দেন অশ্বিন। নন-স্ট্রাইকার প্রান্তে দাঁড়ানো বাটলার কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিলেন ক্রিজ থেকে। সেই সুযোগ নিয়ে তাঁকে রান আউট করে দেন অশ্বিন। এই ধরনের আউটকে মাঁকড়ীয় বলা হয় কারণ, ভারতের প্রয়াত অলরাউন্ডার বিনু মাঁকড় ১৯৪৭ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে প্রথম এ ভাবে হাত ঘুরিয়ে নন-স্ট্রাইকারকে আউট করেছিলেন। তখন সকলে বিনুর সমালোচনা করলেও আত্মজীবনীতে স্বয়ং ডন ব্র্যাডম্যান পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর।
এ দিন ডনের দেশের ওয়ার্ন অবশ্য টুইটারে ক্ষোভ উগরে দিয়ে লেখেন, ‘‘অধিনায়ক এবং মানুষ অশ্বিনকে নিয়ে আমি হতাশ। আইপিএলের প্রত্যেক অধিনায়ক খেলোয়াড়ি মনোভাব দেখাবে বলে সই করে। অশ্বিন বলটা করছিলই না। তাই এটাকে ডেড বল দেওয়া উচিত ছিল।’’ ওয়ার্ন ভারতীয় বোর্ডের কাছেও আর্জি জানান যে, তারা এই ঘটনা খতিয়ে দেখুক। মন্তব্য করেন, ‘‘এমন দৃশ্য আইপিএলের জন্য অবশ্যই ভাল নয়। অশ্বিনের আচরণ কলঙ্কজনক এবং আশা করব, ভারতীয় বোর্ড এমন আচরণ সমর্থন করবে না।’’
বলিউড অভিনেত্রী প্রীতি জিন্টার দলের পরের ম্যাচ আজ, বুধবার ইডেনে। কলকাতা নাইট রাইডার্সের মালিক শাহরুখ খান এবং প্রীতির পর্দার রোম্যান্সকে টেনে এনে এই দ্বৈরথকে ‘বীরজারা’ ম্যাচ বলা হয়। কিন্তু অশ্বিনকে নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্কের আবহে কতটা পর্দার প্রেম অক্ষত থাকে, তা-ও দেখার। মালিক হিসেবে শাহরুখ বরাবর প্রতিপক্ষের ভাল খেলাকে কুর্নিশ করেছেন। অনেক ম্যাচেই তাঁকে দেখা গিয়েছে মাঠে নেমে প্রতিপক্ষের সেরা খেলোয়াড়কে জড়িয়ে ধরেছেন বা তাঁর দলকে হারানো ক্রিকেটারের সঙ্গে খেলার ফলাফল ভুলে জার্সি বিনিময় করেছেন। প্রীতি যদিও তাঁর অধিনায়কের কাণ্ড নিয়ে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত মুখ খোলেননি।
অশ্বিন এর আগেও ২০১২-তে এ ভাবেই মাঁকড়ীয় ভঙ্গিতে আউট করেছিলেন শ্রীলঙ্কার লাহিরু থিরিমানেকে। সেই সময় অস্থায়ী অধিনায়ক বীরেন্দ্র সহবাগ আবেদন ফিরিয়ে নিয়ে থিরিমানেকে ব্যাট করতে দেন। আবার বাটলারকেও এর আগে একই ভাবে আউট হতে দেখা গিয়েছে। শ্রীলঙ্কার স্পিনার সচিত্র সেনানায়েক তাঁকে এই আউট করেন।
কিন্তু আগে যা-ই ঘটুক, অশ্বিনকে নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে, কারণ তিনি নিজে পঞ্জাব দলের অধিনায়ক। ওয়ার্ন বলেছেন, ‘‘অধিনায়ক উদাহরণ তৈরি করবে, এটাই ধরে নেওয়া হয়। এই কলঙ্কজনক এবং নিচু মানসিকতার কাজ করলে কেন? মিস্টার অশ্বিন, তোমাকে কিন্তু এই কুরুচিকর ঘটনা দিয়েই লোকে মনে রাখবে।’’ আকাশ চোপড়ার মতো কয়েক জন প্রাক্তন ক্রিকেটার অশ্বিনের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সেই প্রসঙ্গ টেনে ওয়ার্নের তোপ, ‘‘যাঁরা বলছেন, আইনসম্মত ভাবেই বাটলারকে আউট করেছে অশ্বিন, তাঁদের প্রশ্ন করি, যদি বেন স্টোকস এ ভাবে বিরাট কোহালিকে আউট করত, তা হলে তাঁরা কী বলতেন?’’ ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়ক মাইকেল ভনও এ ব্যাপারে সমর্থন করেন ওয়ার্নকে।
টুইটারে অনেকেই ধরিয়ে দিয়েছেন, আইনের দিক থেকে ঠিক হলেও এমন ধরনের আউট করাটা অখেলোয়াড়োচিত মনোভাবের পরিচায়ক। যে কারণে গ্রেগ চ্যাপেল যখন ট্রেভর চ্যাপেলকে দিয়ে আন্ডারআর্ম বল করিয়েছিলেন, সারা বিশ্ব নিন্দা করেছিল। ডন ব্র্যাডম্যানের বিরুদ্ধে বডিলাইন বোলিং করানোর জন্য ইংল্যান্ড অধিনায়ক ডগলাস জার্ডিন সারা জীবন ক্রিকেটসমাজ থেকে ব্রাত্য থেকেছেন। তেমনই অঘোষিত নির্বাসন নেমে এসেছিল বডিলাইনের প্রধান বোলার হ্যারল্ড লারউডের উপরে। উল্টো দিকে ১৯৮৭ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেলিম জাফরকে এই মাঁকড়ীয় ভঙ্গিতে আউট করার সুযোগ পেয়েও তা করেননি কোর্টনি ওয়ালশ। সেই রান আউট না করায় বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু ক্যারিবিয়ান ফাস্ট বোলারকে আজও ওই ঘটনার জন্য কুর্নিশ করে দুনিয়া।
অতীতে ভারতীয় ক্রিকেটারেরাও খেলোয়াড়ি মনোভাবের অনেক উদাহরণ রেখেছেন। সুনীল গাওস্কর কখনও আউট হয়ে ক্রিজে দাঁড়াতেন না। গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ জুবিলি টেস্টে ক্রিজে ফেরত এনেছিলেন ইংল্যান্ডের বব টেলরকে। সেখান থেকে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিয়ে ভারতকে হারিয়ে দেন ইয়ান বোথাম-টেলর জুটি। ইংল্যান্ডে ইয়ান বেলকে বিতর্কিত ভঙ্গিতে আউট করার পরেও ফেরত আনেন ধোনি।
প্রশ্ন উঠছে, এখনও মাঁকড়ীয় ভঙ্গিকে কেন আইনকানুনের মধ্যে রাখা হয়েছে? উত্তর হচ্ছে— কোনও ব্যাটসম্যান যাতে অন্যায় সুবিধে নিয়ে বল হওয়ার আগেই ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে রান নিতে না পারেন, সেই কারণেই তা তুলে দেওয়া হয়নি। কিন্তু এই ধরনের আউট করার আগে ব্যাটসম্যানকে সাবধান করে দেওয়াটাই ক্রিকেটীয় সহবত। অশ্বিন যা করেননি।
মাঁকড়ীয় আউট সংক্রান্ত ক্রিকেটের আইন বলছে, ‘‘বল খেলার মধ্যে থাকা থেকে বোলারের যখন সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী বল ছাড়ার কথা, সেই সময়ের মধ্যে যদি নন-স্ট্রাইকার (যিনি ব্যাট করছেন না, বোলারের ক্রিজের দিকে দাঁড়িয়ে থাকেন) তাঁর জন্য নির্দিষ্ট ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে যান, তা হলে বোলার তাঁকে রান আউট করতে পারেন।’’ ভিডিয়ো রিপ্লেতে দেখা গিয়েছে, অশ্বিন বল ছাড়ার আগে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। বাটলার ক্রিজ ছেড়ে বেরোতেই তিনি বেল ফেলে দেন। ওয়ার্ন এই জায়গাটাতেই প্রশ্ন তুলছেন। অশ্বিন যে-হেতু থেমে গিয়েছিলেন, তিনি দাবি তুলছেন, এটা ‘ডেড বল’।
অশ্বিন নিজে কৃতকর্মের জন্য আদৌ অনুশোচনায় ভুগছেন না। বলে দিচ্ছেন, ‘‘নিয়মের মধ্যে থেকে আউট করেছি। এর মধ্যে ক্রিকেটীয় স্পিরিটের প্রশ্ন আবার কোথা থেকে আসছে, বুঝছি না।’’ রাজস্থান রয়্যালসের কোচ এবং অশ্বিনদের সঙ্গে অতীতে কাজ করা প্যাডি আপটন পাল্টা বলছেন, ‘‘আমার মনে হয়, অশ্বিন যেটা করেছে, তা ওর মানসিকতাকেই তুলে ধরছে। ও কী রকম মানুষ সেটাই দেখিয়ে দিয়ে গেল। আইপিএল ভক্তদের হাতে বিষয়টি ছেড়ে দেব। তাঁরাই ঠিক করুন, এই ধরনের ঘটনা দেখতে চান কি না।’’
রাতারাতি ‘অখেলোয়াড়ি’ বনে যাওয়া অশ্বিন আজ, বুধবার নামবেন ইডেনে। যে মাঠ বরাবর সমাদৃত তার খেলোয়াড়ি মনোভাবের জন্য!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy