মোহনবাগান-১ (বলবন্ত)
চার্চিল-০
বারাসতের বিধায়ক মাঠে এসেছিলেন একেবারে সিনেমার ‘কিরীটি রায়’-এর মতো সেজে।
‘সত্যসন্ধানী’ চিরঞ্জিৎ গ্যালারিতে ছিলেন মিনিট তিরিশ। বলবন্তের গোলটা হওয়ার পরই বেরিয়ে গেলেন দ্রুত। ফলে বাগানের তারকাময় টিম আই লিগে প্রথম ম্যাচে কেন এ রকম খারাপ খেলল তার রহস্য ‘কিরীটি’র থেকে জানা হল না।
কিন্তু গ্যালারিতে তো অসংখ্য ‘কিরীটি রায়’ থাকেন কলকাতার দুই প্রধানের যে কোনও ম্যাচেই। মোহনবাগান গ্যালারিতেও ছিলেন রবিবার। টিমের ড্রেসিংরুম থেকে মাঠে কোচের স্ট্র্যাটেজি— সব কিছুর উপর যাঁদের নজর থাকে নিরন্তর। গোয়েন্দাদের মতোই। দ্বিতীয়ার্ধের ৬৩ মিনিটে সঞ্জয় সেনের টিম দশ জন হয়ে গেল। জীবনের প্রথম আই লিগ ম্যাচে নেমে লালকার্ড দেখে যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন অনূর্ধ্ব বাইশ কোটার ফুটবলার শুভাশিস বসু, তখন গ্যালারি থেকে আওয়াজ উঠল, ‘‘কোচ-দা কার্ড দেখলে শাস্তির ব্যবস্থা করুন। না হলে গত বারের মতো এ বারও ডুববেন।’’
ম্যাচের আগের দিন আই লিগে সবুজ-মেরুনের এ বারের ক্যাচলাইন বলে দিয়েছিলেন অধিনায়ক কাতসুমি। ‘‘ভাল খেলার দরকার নেই। ম্যাচ জিতলেই হল।’’ কী আশ্চর্য! সেটা প্রথম দিনই মাঠে করে দেখালেন তাঁর সতীর্থরা। কাতসুমি-মন্ত্র আউড়ে। ডাফি-প্রীতম-বলবন্তের নিখুঁত পাস আর হেডে মন ভরানো গোলটা ছাড়া সবুজ-মেরুন জার্সিতে তো কোনও ঝলকানিই পাওয়া গেল না এ দিন! অমিতাভ-শাহরুখ-আমিরকে একসঙ্গে নামিয়ে কোনও সিনেমা বক্সঅফিস হিট না করলে যা হয়, সেরকম মনে হচ্ছিল বাগানকে দেখে।
কেন এমন হল? কোচ সঞ্জয় সেন বললেন, ‘‘প্রথম ম্যাচ সব সময়ই কঠিন হয়। আরও একটু সময় লাগবে সব ঠিকঠাক হতে। তবে সবাই চেষ্টা করেছে। জিতে শুরু করলাম এটাই বড় ব্যাপার।’’ বাগানের উদ্বোধনী ম্যাচের রহস্যভেদ করতে নামলে কিন্তু বেরিয়ে আসছে আরও অনেক সত্য।
এক) কলকাতা লিগে যে টিম খেলেছিল তার মধ্যে একমাত্র ডাফি ছাড়া কেউই ছিলেন না এ দিনের দলে। ফলে টিমের একাত্মতা এখনও তৈরি হয়নি।
দুই) মাত্র বারো দিনের অনুশীলন করে নেমেছিলেন দেবজিৎ-শেহনাজরা। ফুটবল বিজ্ঞান বলে, এ ক’দিনের মধ্যে বিশ্বের কোনও টিম দক্ষতার চুড়োয় পৌঁছতে পারে না।
তিন) শৌভিক-প্রীতম-কেন লুইসদের মতো সদ্য আইএসএলে টানা ম্যাচ খেলে আসা ফুটবলারদের দেখে ক্লান্ত মনে হয়েছে। তাঁদের ক্লান্তি কাটিয়ে ওঠার উপর নির্ভর করছে বাগানের ভবিষ্যৎ সাফল্য।
চার) মাঝমাঠে পাসারের অভাব।
পাঁচ) অযথা ফাউল করে কার্ড দেখার প্রবণতা এখনই বন্ধ না হলে ভয়ঙ্কর ক্ষতি হবে এই টিমের।
বুদ্ধিমান বাগান কোচ এ সব যে জানেন না তা নয়। একান্তে কথা বলার সময় সেটা মানছেনও। কিন্তু কোচের হটসিটে বসে সেটা তাঁর পক্ষে বলা সম্ভব নয়, এ-ও ঠিক। তাই সনি নর্ডি এখনও না আসায় সমস্যা হচ্ছে কি না জানতে চাইলে রেগে যান সঞ্জয়। বলে দেন, ‘‘সনি গত বার ক’টা গোল করেছে? ওকে ছাড়াও তো আমরা অনেক ম্যাচ জিতেছি।’’ বরং তাঁর মুখে বলবন্ত সিংহের প্রশংসা। চোট সারিয়ে এক বছর পর খেলতে নেমে গোল পেলেন পঞ্জাবি এই স্ট্রাইকার। তাই মহাতারকা সনি নয়, বলবন্তকে সামনে আনছেন তিনি। ড্রেসিংরুমের রসায়ন ঠিক রাখতে বুদ্ধিমান কোচেরা এ রকমই বলে থাকেন। আসল সত্য বুকে চেপে রেখে।
চার্চিলের জার্সির রং বদলেছে। লাল-সাদার বদলে আকাশী নীল। কিন্তু জার্সি বদলালে কী হবে? টিমে যে রং-ই নেই। আদালতের নির্দেশ আর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আই লিগে ঢুকে পড়েছে টিমটা। কিন্তু দলটা গুছিয়ে তুলতে পারেননি কর্তারা। ইয়াকুবু, ওডাফা, কালুর মতো তারকা বিদেশি এনে ভারতীয় ফুটবলে চমক জাগানো চার্চিল ভাইদের সেই জোশ নেই যেন এ বার। ক্লাবের প্রধান চার্চিল আলেমাও নিজে গোয়ার আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী। সেখানে ব্যস্ত থাকায় কোনও ভাল বিদেশি এখনও আনতে পারেননি। বদলে অন্য দলগুলোর এক ঝাঁক বাতিল ফুটবলার ও গোয়ার ভূমিপুত্রদের টিমে নিয়ে নেমে পড়েছে চার্চিল। কোনওক্রমে জোড়াতালি দিয়ে। বর্তমান অস্থায়ী কোচ আলফ্রেড মূলত অ্যাকাডেমির কোচিং করতেন এতদিন। তবে বোঝা গেল মাঠে নেমে গেমপ্ল্যানটা করতে জানেন। টিমটা তিনি নামিয়েছিলেন এক পয়েন্ট তোলার কথা ভেবে। ৪-৫-১ ফর্মেশনে। কম পুঁজি নিয়ে অসম লড়াইয়ে নামলে সব কোচ যা করেন। সহজ অঙ্ক, ড্র-র জন্য রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলো এবং সুযোগ পেলে পাল্টা আক্রমণে গিয়ে গোল তুলে নেওয়ার চেষ্টা করো।
কিন্তু এটা এ বারের বাগানের ধার ও ভারের সামনে একেবারে সাদামাঠা কোচ-মন্ত্র। সফল হওয়া কঠিন। গোয়ার টিমটাও পারেনি শেষ পর্যন্ত। কিন্তু কিংসলে-সতীশদের লড়াকু মনোভাব ম্যাচটা জমিয়ে দিয়েছিল। উপভোগ্যও করে তুলল। সেরিটন ফার্নান্ডেজ, সুরচন্দ্র সিংহরা তো এ দিনই বাগান রক্ষণে কয়েক বার বিপদজ্জনক হানা দিলেন যা থেকে গোল হতেই পারত। এক বার বিপক্ষ ক্রসবার ছুঁয়ে গেল অ্যাগনেলো কোলাসোর শট। সবে লিগের শুরু। এদিনের চার্চিলকে দেখে মনে হল, বিদেশিরা ঢুকলে টুর্নামেন্টে গোয়ার একমাত্র টিম আরও গতি পাবে। বদলে যাবে টিমের চেহারাটাই।
উদ্বোধনী ম্যাচে টেনেটুনে পাস করলেও সঞ্জয় সেনের টিমও বদলাবে। এবং সেটা সনি-এডু-জেজেরা টিমে ঢুকলেই। সেই প্রত্যাশা নিয়েই হয়তো ফিরে গেলেন হাজার আটেক সমর্থক। আশা তাঁরা করতেই পারেন। খাতায় কলমে তো আই লিগের অশ্বমেধের ঘোড়া এ বার হওয়ার কথা বাগানেরই।
মোহনবাগান: দেবজিৎ, প্রীতম, কিংশুক, আনাস, শুভাশিস, কাতসুমি, শৌভিক, শেহনাজ, কেন লুইস (প্রবীর), বলবন্ত (প্রণয়), ডাফি (বিক্রমজিৎ)।