Advertisement
E-Paper

‘বিরাট যেন না পাল্টায়, ভিভ এমনই আগ্রাসী ছিল’

টাইগার পটৌডি স্মারক বক্তৃতায় এসে ওয়ালশ বলে দিলেন, ‘‘কোহালি আবেগহীন একটা রোবট হয়ে যাক, চাই না। আমি বুঝতে পারছি না, লোকে বিরাটের আগ্রাসন নিয়ে কেন রাতের ঘুম ত্যাগ করছে।

দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৮ ০৪:২১
অতিথি: ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ ও ‘দ্য বেঙ্গল ক্লাব’ আয়োজিত টাইগার পটৌডি স্মারক বক্তৃতায় নানা মেজাজে ধরা পড়লেন ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি কোর্টনি ওয়ালশ। বুধবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

অতিথি: ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ ও ‘দ্য বেঙ্গল ক্লাব’ আয়োজিত টাইগার পটৌডি স্মারক বক্তৃতায় নানা মেজাজে ধরা পড়লেন ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি কোর্টনি ওয়ালশ। বুধবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

ক্রিকেট দুনিয়ায় যখন ঝড় উঠেছে বিরাট কোহালির আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে তখন অন্য রকম কথা বলে দিচ্ছেন কোর্টনি ওয়ালশ। যাঁকে সব চেয়ে ভদ্র ক্রিকেটারের পুরস্কার দেওয়া যেতেই পারে।

টাইগার পটৌডি স্মারক বক্তৃতায় এসে ওয়ালশ বলে দিলেন, ‘‘কোহালি আবেগহীন একটা রোবট হয়ে যাক, চাই না। আমি বুঝতে পারছি না, লোকে বিরাটের আগ্রাসন নিয়ে কেন রাতের ঘুম ত্যাগ করছে। আমি তো ওকে টিভি-তে দেখে নিজের মনেই বলি, ওহ্! এই ছেলেটা ক্রিকেটের জন্য দারুণ একটা চরিত্র।’’

তাঁর দেশের কিংবদন্তি ভিভিয়ান রিচার্ডসের সঙ্গেও তুলনা করতে ছাড়েননি কোহালির। টেস্টে ৫১৯ উইকেট নেওয়া প্রাক্তন ফাস্ট বোলার বলে দিলেন, ‘‘ভিভ রিচার্ডস-ও এ রকমই আক্রমণাত্মক ছিল। প্রত্যেকটা দিন, প্রত্যেকটা মুহূর্ত জিততে চাইত। ভিভের অভিধানে হার বলে কোনও শব্দ ছিল না। আমি ভিভের ছায়া দেখতে পাই অধিনায়ক বিরাটের মধ্যে।’’ এক নিঃশ্বাসে ওয়ালশ বলে দিতে চান যে, বিরাট আগ্রাসী হলেও বয়স্কদের সম্মান করতে জানেন। তাঁর নিজেরই এমন অভিজ্ঞতা রয়েছে।

দু’বছর আগে ভারত যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়েছিল, তখন সেই অভিজ্ঞতা হয়েছিল ওয়ালশের। তখন ভারতীয় দলের কোচ ছিলেন অনিল কুম্বলে। যিনি কি না তাঁর ভাল বন্ধু ছিলেন। এক রাতে কুম্বলের সঙ্গে ডিনারে গিয়েছিলেন ওয়ালশ। তখন কুম্বলে তাঁকে অনুরোধ করেন, ভারতীয় বোলারদের সঙ্গে এসে কথা বলার জন্য। যদিও সেই সময়ে তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, প্রতিপক্ষ কোচের আবেদনে সাড়া দিতে এক বারও ভাবেননি ওয়ালশ। রাজি হয়ে যান।

এর পরে অধিনায়ক কোহালি স্বয়ং এসে তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। যা দেখে ওয়ালশের মনে হয়েছিল, কোহালি খুবই সক্রিয় এক অধিনায়ক। যিনি শুধু নিজেই উন্নতি করতে চান না, দল হিসেবে ভারতেরও উন্নতি চান। ‘‘আমার মনে হয় সেই সফরে ভারতীয় পেসারদের মধ্যে ছিল মহম্মদ শামি, ইশান্ত শর্মা, ভুবনেশ্বর কুমার, উমেশ যাদব-রা। কিন্তু সেই মিটিংয়ে সব চেয়ে আকর্ষণীয় সদস্যের নাম ছিল বিরাট কোহালি। সারাক্ষণ ও বসে থাকল শোনার জন্য যে, বোলারদের আমি কী বলি। সে দিন ক্রিকেটের এক মনোযোগী ছাত্রকে আমি দেখেছিলাম।’’ এখানেই থেমে থাকেননি কোহালি। এর পর ওয়ালশ-কে অনুরোধ করেন, তুমি আমাকে ভিভ রিচার্ডসের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবে? ওয়ালশ সেই ব্যবস্থাও করে দেন। ভিভ-কে বলে দেন, বিরাট তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। ভিভ রাজি হয়ে যান। পরের ম্যাচ ছিল অ্যান্টিগায়। ভিভের শহর। সেখানে দেখা হয়ে যায় ভিভ ও বিরাটের।

‘দ্য টেলিগ্রাফ’ ও ‘বেঙ্গল ক্লাব’ আয়োজিত টাইগার পটৌডি স্মারক বক্তৃতায় ওয়ালশ সকলের মন জিতে নিলেন ‘স্পিরিট অব ক্রিকেট’ নিয়ে বলার সময়। কে ভুলবে তাঁর সেই আত্মত্যাগের কথা! সাতাশি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেলিম জাফর বেরিয়ে গিয়েছিলেন নন-স্ট্রাইকারের ক্রিজ থেকে। বোলার ওয়ালশ রান আউট করে দিলে ম্যাচ জিতে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু তিনি রান আউট করেননি। ‘‘যে ভাবে আমি বেড়ে উঠেছি, মানুষকে ঠকাতে শেখানো হয়নি। তাই সেলিম জাফরকে সতর্ক না করে আউট করতে চাইনি। আমার আজও কোনও আক্ষেপ নেই এ নিয়ে। ক্যাপ্টেন ভিভ রিচার্ডস এবং দলের সকলে আমাকে সমর্থন করেছিল।’’ যুব বিশ্বকাপে তাঁরই দেশের দুই জুনিয়র ক্রিকেটার এই সুযোগ পেয়ে ওয়ালশের উদাহরণ অনুসরণ করেননি। তাঁরা নন-স্ট্রাইকারকে আউট করে দিয়েছিলেন। যা দেখে ব্যথিত হয়েছিলেন তিনি। বক্তৃতায় বলে ফেললেন, ‘‘যুব বিশ্বকাপে অন্তত ক্রিকেট স্পিরিটের কথা মনে রাখবে তরুণরা, এটাই আশা করেছিলাম। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সেই ম্যাচে জিতে থাকতে পারে। সে দিন আইন লঙ্ঘন করেনি কেউ। কিন্তু ক্রিকেটীয় স্পিরিটকে হত্যা করা হয়েছিল। খেলায় জেতা দরকার। কিন্তু স্পিরিটকে জলাঞ্জলি দিয়ে নয়।’’

যাঁর স্মরণে বক্তৃতা, তাঁর সঙ্গে কখনও কথাবার্তা হয়নি ওয়ালশের। বলে দিচ্ছেন, ‘‘পটৌডি কখনও চার আগুনে পেস বোলার টিমে পাননি। বদলে পেয়েছিলেন চার স্পিনার। তা নিয়েই তিনি ভারতীয় ক্রিকেটের স্পিনের স্বর্ণযুগ তৈরি করেন। সব চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, পটৌডি একটা রণকৌশল গড়ে তুলেছিলেন জেতার জন্য এবং সফলও হয়েছিলেন।’’ মজা করে বললেন, ‘‘টাইগারের ছিল চার স্পিনার। ক্লাইভ লয়েডের ছিল চার পেসার। আমি মনে করি অধিনায়ককে বিগ ব্রাদার হতে হয়। কিন্তু টাইগার এবং ক্লাইভ দু’জনেই হয়ে উঠেছিলেন বিগ ফাদার। আপন আপন রণকৌশলে দারুণ সফল হয়েছিলেন ওঁরা।’’

পটৌডিকে তিনি কখনও দেখেননি। কিন্তু লয়েডের অধীনে খেলেছেন। বলে ফেললেন, ‘‘আমি একটা সিরিজেই লয়েডের অধীনে খেলি। আমার অভিষেক সিরিজ। আর তাতেই বুঝে যাই, ক্লাইভ কেন এত বড় ক্যাপ্টেন। আমার মতো জুনিয়রকেও জিজ্ঞেস করেছিল, কী ধরনের ফিল্ডিং চাও। আমি তো শুনে অবাক হয়ে যাই। আমি ভেবেছিলাম, ক্যাপ্টেন যা ফিল্ডিং সাজাবে সেই অনুযায়ী আমাকে বল করতে হবে।’’ তাঁর দেখা সেরা ক্যাপ্টেনদের মধ্যে ইমরান খান-কে রাখছেন ওয়ালশ। যিনি পটৌডি স্মারক বক্তৃতায় প্রথম বক্তা হিসেবে এসেছিলেন। ‘‘আমার মতে বড় অধিনায়ক মানে সে বিপ্লব আনবে ক্রিকেটে। পরিবর্তন রেখে যাবে। ইমরান পাল্টে দিয়েছিল পাকিস্তান ক্রিকেটে। আমি যতটুকু শুনেছি, পটৌডিও একই রকম ছিল। আমার মনে হয় ইমরান এবং টাইগারের অধিনায়কত্বের ধরনের মধ্যে অনেক মিল ছিল।’’

কপিল দেব-কে টপকে টেস্টে বিশ্বের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি হয়েছিলেন তিনি। সেরা পুরস্কার হিসেবে এখনও মনে রেখেছেন কপিলের ফোন। ‘‘ভারত থেকে জামাইকায় ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছিল। জীবনে ভুলতে পারব না,’’ বলে তিনি যোগ করছেন, ‘‘সঙ্গে দারুণ একটা প্রস্তাবও দিয়েছিল কপিল। জানি না কেন, আইসিসি এখনও এটা ভেবে দেখল না। কপিল বলেছিল, রেকর্ড ভাঙা হলে পুরনো রেকর্ডের মালিক কোনও স্মারক তুলে দিক নতুনের হাতে। তা হলে দু’জনেই তো স্বীকৃতি পায়। আমার মনে হয়, এটা দারুণ একটা প্রস্তাব ছিল।’’

তিনি জামাইকার তারকা। মাইকেল হোল্ডিং একই দ্বীপ থেকে উঠে এসেছিলেন। হোল্ডিং-ই ছিলেন ওয়ালশের আদর্শ। জামাইকা মানে সাবাইনা পার্ক। যেখানে এক সময় বিশ্বের দ্রুততম এবং সব চেয়ে বিপজ্জনক পিচ হতো। ওয়ালশের চেয়ে ভাল কেউ জানে না। মজা করে বলে দিলেন, ‘‘সাবাইনা পার্কের আশেপাশে অনেকগুলো ভাল হাসপাতাল আছে। আর যখনই ক্রিকেট ম্যাচ থাকত, হাসপাতালগুলো খুব ব্যস্ত হয়ে উঠত। প্রচুর লোক আহত হয়ে সাবাইনা পার্ক থেকে হাসপাতালে ছুটত।’’ একটি বিশেষ ম্যাচের কথা তাঁর মনে পড়ছে। ‘‘আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটের ম্যাচ চলছিল। প্যাট্রিক প্যাটারসন পাঁচ জনকে হাসপাতালে পাঠিয়েছিল। কারও হাত ভাঙা, কারও নাক ফাটা, কারও আঙুল মটকে গিয়েছে। তার পর যখন ওরা ব্যাট করতে এল, আরও তিন জন আহত হল। তখন অন্য হাসপাতালের ব্যবস্থা করতে হল কারণ আগেরটাতে আর কোনও বেড খালি পড়ে ছিল না।’’

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী কোচ হিসেবে নিদাহাস ট্রফিতে যাচ্ছেন শ্রীলঙ্কায়। তিনি আশাবাদী, বাংলাদেশ উজ্জীবিত পারফরম্যান্স করবে। দারুণ কিছু ফাস্ট বোলার উঠে আসছে বাংলাদেশে, এমন মন্তব্যও করলেন। ‘‘টাইগারকে কখনও খেলতে দেখিনি। শুধু শুনেছি। কিন্তু টাইগার পটৌ়ডি স্মারক বক্তৃতায় আসার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেই আমি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী কোচ হিসেবে উত্তীর্ণ হলাম। তাই বলব, টাইগার, তুমি আমার জন্য লাকি ক্যাপ্টেন!’’ শেষ করলেন ওয়ালশ। গ্র্যান্ড হোটেলের বল রুমে হাততালি আর উচ্ছ্বাসের বহর দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি যেন সেই ১ রানে ৫ উইকেট নিয়ে ফিরছেন!

Courtney Walsh aggression Virat Kohli Cricket
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy