.
ইডেনে ভিভিএস লক্ষ্মণের ঐতিহাসিক ২৮১-র সময় তাঁর বয়স ছিল ছয়।
ক্রিকেট-নগরী মোরাতুয়ার বাসিন্দা হয়েও তখন ক্রিকেটের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়নি।
১৫ বছর বাদে সেই ছেলেটা লক্ষ্মণের মতোই এক কাণ্ড ঘটিয়ে সনৎ জয়সূর্য, কুমার সঙ্গকারা, মাহেলা জয়বর্ধনেদের দেশের নায়ক।
অথচ লক্ষ্মণের সেই ইনিংসটাই কখনও দেখা হয়নি কুশল মেন্ডিসের। যাঁকে এখন শ্রীলঙ্কার লক্ষ্মণ বলে ডাকতে শুরু করেছেন অনেকে।
ইডেনে যে ভাবে অস্ট্রেলিয়ার মুখ থেকে গ্রাস কেড়ে নিয়েছিলেন লক্ষ্মণ, গত সপ্তাহে প্রায় একই ভাবে পাল্লেকেলেতে অস্ট্রেলিয়ার হাত থেকে জয় ছিনিয়ে নেন কুশল।
তবু লক্ষ্মণের সেই বিখ্যাত ইনিংসের ভিডিও দেখার সুযোগই তাঁর হয়নি। এই ইউটিউবের যুগেও নয়!
ক্রিকেটবিশ্বের আধুনিকতার সঙ্গে নিজেকে এখনও ঠিক মানিয়ে নিতে পারেননি। মোরাতুয়ার প্রিন্স অব ওয়েলস কলেজের ছাত্র। ইংরেজিটা অবশ্য এখনও ঠিকমতো বলে উঠতে পারেন না। তাই শ্রীলঙ্কা দলের মিডিয়া ম্যানেজার মারফৎ ই-মেলে আনন্দবাজারের প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, ‘‘২০০১-এ আমার বয়স ছিল ছয়। তখন ক্রিকেট বুঝতাম না। আর আমাদের বাড়িতেও তখন টিভি ছিল না। পরেও কখনও সুযোগ হয়নি ইনিংসটার ভিডিও দেখার। তবে ইনিংসটার কথা অনেক বার শুনেছি। লক্ষ্মণের খেলাও দেখেছি কলম্বোর মাঠে। জানি উনি খুব বড় ব্যাটসম্যান। তবে আমি সচিন তেন্ডুলকরের ভক্ত। ওঁর ব্যাটিংয়ের ভিডিও প্রায়ই দেখি।’’
দলীপ মেন্ডিস, অজন্তা মেন্ডিস, রমেশ কালুভিথারানা, লাহিরু থিরামান্নেদের জন্মভিটে থেকে উঠে আসা এই নতুন প্রতিভার কীর্তিও স্বচক্ষে দেখা হয়নি তাঁর পূর্বসূরির। রবিবার বিকেলে হায়দরাবাদ থেকে ফোনে তা স্বীকার করে নিয়েই লক্ষ্মণ বলেন, ‘‘ইডেনের সেই ইনিংসের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এমন কঠিন পরিস্থিতি থেকে দলকে এত দূর টেনে নিয়ে যাওয়াটাই বড় ব্যাপার।’’
এই টি-টোয়েন্টির যুগে একুশ বছরের একটা ছেলের এমন মহাকীর্তি স্থাপনের খবর শুনে অবাক লক্ষ্মণ বলেন, ‘‘এমন ইনিংস খেলার জন্য যেমন সিংহহৃদয় ও ঠান্ডা মাথা দরকার, তেমনই অসীম ধৈর্যেরও প্রয়োজন। এই বয়সের একটা ছেলে এ রকম একটা কাজ কী করে করতে পারল, ভেবে পাচ্ছি না।’’
গত বছর অক্টোবরে যখন প্রথম টেস্ট খেলেন কুশল, তখন তিনি কুড়ি। এখন একুশ। মাত্র হাফ ডজন টেস্টের অভিজ্ঞতা নিয়ে ১৭৬-এর অভাবনীয় ইনিংস খেলে শ্রীলঙ্কাকে ভরাডুবি থেকে বাঁচালেন কী ভাবে? এর উত্তরে কুশল জানান, ‘‘আমি ওই সময়ে নিজের পারফরম্যান্স ছাড়া আর কিছুই ভাবছিলাম না। কোচ, ক্যাপ্টেন দু’জনেই আমাকে বলে দিয়েছিলেন, তুমি গিয়ে নিজের স্বাভাবিক ব্যাটিংটা করো। দল কোন জায়গায় আছে বা এই অবস্থা থেকে দলকে বাঁচাতে হবে, সে সব কিছুই আমার মাথায় ছিল না। সে দিন আমার কাজ ছিল যত বেশি সম্ভব রান করা।’’
এই মিশনে নেমেও মাঝে মাঝেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। নাথান লায়নকে ছয় হাঁকিয়ে একশোয় পৌঁছন। এমন বড় দায়িত্ব নিয়ে নেমে এতটা বেপরোয়া কেন? কুশলের ব্যাখ্যা, ‘‘বলটাই তো ছিল উড়িয়ে দেওয়ার মতো। ওই বলে ছয় মারা ছাড়া আর কিছুই করা যায় না। তা ছাড়া তখন খেয়ালও ছিল না যে, জীবনের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছি।’’
এক কাঠ-মিস্ত্রির ছেলের যে কোনও দিন টেস্ট ক্রিকেট খেলা হবে, তা বোধহয় কখনও ভাবেননি তাঁর পরিবারের সদস্যরা।
একজন বাদে। তাঁর বাবা দীনেশ।
কুশল জানালেন, ‘‘বাবা আমাকে বরাবর সাপোর্ট দিয়েছেন। আমার ক্রিকেটের জন্য তাঁকে এক সময় রাজমিস্ত্রির কাজও করতে হয়েছে। তাতেও পিছপা হননি। বাবা প্রথম যে ব্যাটটা আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন, সেটা ছিল একটা পাকিস্তানি ব্র্যান্ডের ব্যাট— ‘ইরফান’। সেটা দিয়েই শুরু আমার। এখনও সেই ব্যাটটা যত্ন করে রেখে দিয়েছি। চিরকাল যত্ন করে রেখেও দেব।’’
শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট মহল এখন ধন্য ধন্য করছে কুশল মেন্ডিসের নামে। শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটকে বহু দিন পর ফোকাসে আনার কৃতিত্ব যে তাঁরই। লক্ষ্মণও বললেন, ‘‘ইংল্যান্ডে গিয়ে যা ভরাডুবি হয়েছিল শ্রীলঙ্কার, তার পর এ রকম একটা সাফল্যের প্রয়োজন ছিল ওদের। এই টেস্ট থেকে ওরা যদি ঘুরে দাঁড়াতে পারে, তা হলে সে জন্য অবশ্যই কুশলকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।’’
আর ‘প্রিন্স অব মোরাতুয়া’ এখন শুধু সামনের দিকে তাকিয়ে। বলছেন, ‘‘সঙ্গকারা, জয়সূর্য স্যারদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে চাই আমি। ওদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে চাই।’’
পাল্লেকেলের জয়ের পরই জয়সূর্যর সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। টিপস পেয়েছেন প্রচুর। এখন এগুলোই তাঁর ভবিষ্যতের রাস্তায় চলার প্রধান সম্বল। কুশলের আশা, ভবিষ্যতের কঠিন রাস্তায় চলতে চলতে এমন ‘সম্পদ’ আরও পাবেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy