Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

নায়কের মুখে সেই দলগত সংহতির মন্ত্র

প্রশ্ন শুনে লালডানমাউইয়া রালতে কী বুঝলেন বোঝা গেল না। পাশে বসা দোভাষী বন্ধু ব্রেন্ডন ভ্যানলালরামডিকার দিকে তাকালেন লাল-হলুদের শিলং জয়ের নায়ক। ব্রেন্ডন প্রশ্নটা বুঝিয়ে দিতেই  পাহাড়ি টাট্টু ঘোড়ার মুখে নিস্পাপ হাসি। বলে দিলেন, ‘‘বাবা এবং মা-কে।’’

নায়ক: দুরন্ত হ্যাটট্রিকে ইস্টবেঙ্গলের খেতাবের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার উল্লাস ডানমাউইয়ার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

নায়ক: দুরন্ত হ্যাটট্রিকে ইস্টবেঙ্গলের খেতাবের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার উল্লাস ডানমাউইয়ার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

রতন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৪:২৪
Share: Save:

ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে কাকে উৎসর্গ করতে চান আপনার হ্যাটট্রিক?

প্রশ্ন শুনে লালডানমাউইয়া রালতে কী বুঝলেন বোঝা গেল না। পাশে বসা দোভাষী বন্ধু ব্রেন্ডন ভ্যানলালরামডিকার দিকে তাকালেন লাল-হলুদের শিলং জয়ের নায়ক। ব্রেন্ডন প্রশ্নটা বুঝিয়ে দিতেই পাহাড়ি টাট্টু ঘোড়ার মুখে নিস্পাপ হাসি। বলে দিলেন, ‘‘বাবা এবং মা-কে।’’

আইজল থেকে প্রায় দু’শো কিলোমিটার দূরে এক কৃষক পরিবারে রালতের জন্ম। গ্রামের নাম সিয়ালহক। বাবা চাইতেন, তাঁর ছোট ছেলে বড় ফুটবলার হোক। এবং সেই ইচ্ছা এতটাই প্রবল যে, তখনকার ব্রাজিলের তারকা ফুটবলার রোমারিও দে সৌসা ফারিয়ার মতো চুল ছেঁটে দিয়েছিলেন ছোট রালতের (ইস্টবেঙ্গলে ওই নামেই তাঁকে ডাকা হয়। কারণ দলে আর একজন রালতে রয়েছেন। তিনি লালরিন্দিকা রালতে)।

লাল-হলুদের ছোট রালতের নয় বছরের ফুটবলারের মুকুটে বেশ কিছু রঙিন পালক জুড়েছে ইতিমধ্যেই। মিজোরাম লিগে চ্যাম্পিয়ন, রাজ্যের হয়ে সন্তোষ ট্রফি জয় এবং দু’বছর আগে আইজলের জার্সিতে আই লিগ জয়। দেশের জার্সিতেও খেলেছেন। এত আলোর মধ্যেও বৃহস্পতিবার বিকেলে আলেসান্দ্রো মেনেন্দেসের দলের মিডিয়ো উজ্জ্বল দীপ্তি ছড়ালেন। এ বারের আই লিগের প্রথম ভারতীয় ফুটবলার হিসাবে হ্যাটট্রিকের কৃতিত্ব অর্জন করলেন ছোট রালতে। আই লিগ ডার্বিতে জোড়া গোলের পর এই তিন গোল করে কতটা তৃপ্ত আপনি? এক বর্ণ ইংরেজি জানেন না। কথা বলছিলেন মিজো ভাষায়। বলে দিলেন, ‘‘নিজের তৃপ্তির চেয়ে দল জিতেছে এটাই সব চেয়ে বড় তৃপ্তি। তিন পয়েন্ট দরকার ছিল, সেটা পেয়েছি।’’

তাঁর সতীর্থ জবি জাস্টিন ইতিমধ্যেই তারকা। দেশীয় ফুটবলারদের মধ্যে সর্বাধিক গোল হয়ে গিয়েছে তাঁর। কেরলের স্ট্রাইকারের পিছনে মিডিয়ো হিসেবে বলের সাপ্লাই লাইনে দাঁড়িয়ে ছোট রালতেও করে ফেললেন সাতটি গোল। পাশেই বসেছিলেন স্প্যানিশ কোচ আলেসান্দ্রো। ছাত্র সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইস্টবেঙ্গল কোচের গলায় উচ্ছ্বাস। ‘‘প্রত্যেক দিন ও উন্নতি করছে। আমার দলের সম্পদ হয়ে উঠছে। প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে পারে। আমার দলে শুধু বিদেশিরাই নন, ভারতীয়রাও কিন্তু দারুণভাবে সফল।’’ আলেসান্দ্রো এমনিতে আবেগপ্রবণ নন। পনেরো বছরে প্রথম বার ইস্টবেঙ্গলকে খেতাব জেতার স্বপ্ন দেখানো মানুষটি ডার্বি জিতেও উচ্ছ্বাসে ভাসেননি। তবু এ দিনের প্রতিপক্ষ শিলং লাজংয়ের গোলের সামনে ছোট রালতের ছটফটানি, গোলের জন্য মরিয়া ভাব দেখে লাল-হলুদের স্প্যানিশ কোচ যে দারুণ খুশি, চোখ-মুখ দেখেই তা বোঝা গেল।

নিশানা: ম্যাচ সেরার পুরস্কার নিয়ে ডানমাউইয়া। বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র

কিন্তু আলেসান্দ্রোর কাছে নতুন কী শিখছেন আপনি? ছোট রালতের জবাব আসে খুব ছোট। ‘‘শৃঙ্খলা, পরিশ্রম এবং দল হয়ে কী ভাবে এককাট্টা হয়ে লড়তে হয়।’’ বলেই তাকান পাশে বসা কোচের দিকে। আলেসান্দ্রোও লাল-হলুদ আকাশের নতুন ধ্রুবতারার দিকে তাকিয়ে কিছু বলেন। দু’জনকেই হাসতে দেখা যায়। কলকাতা লিগ ও আই লিগ ডার্বিতে পর পর গোল করার জন্য মশালবাহিনীর গ্যালারি ছোট রালতেকে আদর করে ডাকছে ‘ডার্বি বয়’ বলে। ছোটবেলা থেকেই যে এই রালতের গোল করাই অভ্যাস। ২০০৯-তে যখন রালতের বয়স ১৬, তখন মিজোরামের একশো দলের গ্রামীণ লিগে সেরা ফুটবলার হয়েছিলেন তিনি। মিজোরাম আর্মড পুলিশ অ্যাকাডেমিতে তাঁর বেড়ে ওঠা। পরে মিজোরাম লিগে চ্যম্পিয়ন করেন ডিনথার ফুটবল ক্লাবকে। পান যুগ্ম গোলদাতার সম্মান। এক সময় ব্যাডমিন্টন খেলতেন। স্বপ্ন দেখতেন র‌্যাকেট হাতে সাফল্য পাওয়ার। কিন্তু কোর্ট থেকে মাঠে নেমে গোল পাওয়ার পর আঁকড়ে ধরেন ফুটবলই। দু’বার পান মিজোরামের সেরা ফুটবলার হিসাবে ‘জো ফ্রুটি’- সম্মান।

উত্তর-পূর্বের দলের বিপক্ষে খেললে কি বাড়তি কোনও তাগিদ অনুভব করেন? পাহাড়ি কাঁটা উপড়ে ফেলা ছোট রালতের জবাব ‘‘একেবারেই না। যে দলের বিরুদ্ধেই খেলি, সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করি। এর পর চার্চিল ম্যাচ রয়েছে। ওটাও জিততে হবে।’’

আলেসান্দ্রোর দর্শনের রাস্তায় হাঁটেন ছোট রালতে। বোঝাই যায়, ছাব্বিশ বছর বয়সে এসে স্প্যানিশ কোচের ড্রেসিংরুম তাঁর জীবনটাই বদলে দিচ্ছে। প্রত্যেক দিন, প্রতিনিয়ত।

ইস্টবেঙ্গল: রক্ষিত দাগার, লালরাম চুলোভা (সামাদ আলি মল্লিক), জনি আকোস্তা, বোরখা গোমেস পেরেস, মনোজ মহম্মদ, কাশিম আইদারা (প্রকাশ সরকার), লালডানমাউইয়া রালতে, লালরিনডিকা রালতে, টোনি দোভালে, জবি জাস্টিন, এনরিকে এসকুয়েদা (খাইমে সান্তোস কোলাদো)।

লাজং এফসি: ফুরবা টেম্পা লাচেনপা, রাকেশ প্রধান (কিনসেইলাং খোংসিত), কেনস্টার খারসৌং, আইবানভা কুপার ডোহলিং, নবীন রাভা, নবীন গুরুং, ফারাংকি বুয়াম, লালরোহলুহা (ডনবোকলাং লিংডো), স্যামুয়েল লিংডো কিনসি, নওরেম মহেশ সিংহ, কিটবোকলাং পেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE