Advertisement
E-Paper

শাড়ির নীচে ট্র্যাকস্যুটে যোগ ‘চ্যাম্পিয়ান ঠাকুমা’র

জাতীয় ও রাজ্য স্তরের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ান হওয়ার সুবাদে সকলের কাছে ‘চ্যাম্পিয়ান ঠাকুমা’ নামে পরিচিত হয়েছেন। আজ অনেকেই তাঁর আসল নামটাই ভুলে গিয়েছেন। তিনি অপর্ণা মুখোপাধ্যায়। বাষট্টি বছরে যোগাসন প্রশিক্ষণের শুরু। তাঁর সঙ্গে কথা বললেন সৌমিত্র সিকদার জাতীয় ও রাজ্য স্তরের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ান হওয়ার সুবাদে সকলের কাছে ‘চ্যাম্পিয়ান ঠাকুমা’ নামে পরিচিত হয়েছেন। আজ অনেকেই তাঁর আসল নামটাই ভুলে গিয়েছেন। তিনি অপর্ণা মুখোপাধ্যায়। বাষট্টি বছরে যোগাসন প্রশিক্ষণের শুরু। তাঁর সঙ্গে কথা বললেন সৌমিত্র সিকদার

শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৯ ০৪:০২

জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতায় সবাইকে পিছনে নিজের জায়গা করে নেন। এ ভাবেই এক সময় নিজের নামটা হারিয়ে ফেলেন। হয়ে ওঠেন সকলের ‘চ্যাম্পিয়ান ঠাকুমা’।

ইটের দেওয়াল টালির চাল দেওয়া ঘরের সামনে এক ফালি জমি। সেখানেই ওয়াকার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন চ্যাম্পিয়ান ঠাকুমা। ইতিমধ্যে আশি বছর বয়স পার করে এসেছেন ওই যোগা। জাতীয় ও রাজ্য স্তরের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ান হওয়ার সুবাদে সকলের কাছে চ্যাম্পিয়ান ঠাকুমা নামে পরিচিত হয়েছেন। আজ অনেকেই তাঁর আসল নামটাই ভুলে গিয়েছেন।

তিনি অপর্ণা মুখোপাধ্যায়।

গত কয়েক বছরে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন কী ভাবে এক জন সামান্য মধ্যবিত্ত ঘরের সাধারণ বৌ থেকে অসামান্য হয়ে ওঠা যায়। কী ভাবে সব রকমের প্রতিকূলতাকে দূরে সরিয়ে রেখে শিরোনামে পৌঁছোনো যায়।

প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেখা হলে পরিচিতদের খোঁজখবর নেন। কারওর পিঠের ব্যথা সারিয়েছেন। কারওর কোমরের ব্যথা সারিয়েছেন। কারওর বা ঘাড়ের ব্যাথা সারিয়েছেন যোগাসনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। খোঁজ নেন, সকলে নিয়মিত অনুশীলন করছেন তো?

অপর্ণা বলেন— “ ধারাবাহিক ভাবে যোগাসনের প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে হবে। তা হলে কারও কোনও যন্ত্রণা থাকবে না। সবাই সুন্দর ভাবে দিন কাটাতে পারবেন। ভাল ভাবে বাঁচতে পারবেন।”

সে অনেক দিন আগের কথা। কোমরে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন সে সময়ে বছর বাষট্টির অপর্ণা। যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিভিন্ন চিকিৎসককে দেখিয়েছিলেন। চিকিৎসকদের পরামর্শ মতো বহু ওষুধও খেয়েছিলেন। কিন্তু কোনও কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। ব্যথা সারছিল না কোনও মতেই। শেষমেশ পরিচিত এক জনের কথামতো তিনি যোগাসন করার সিদ্ধান্ত নেন।

প্রথম প্রথম ট্র্যাকস্যুট পরে অনুশীলন করতে লজ্জা পেতেন। সেই জন্য চুড়িদার পরে অনুশীলন করতেন। বাড়িতে যখন কেউ থাকত না, সেই সময় ছেলেদের গেঞ্জি গায়ে দিয়ে অনুশীলন করতেন যোগাসনের। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকত আশপাশের লোকজন। ঠাকুমাকে দেখে তাঁর দুই নাতনি দিয়া এবং দিশানি মুখোপাধ্যায়ও যোগাসনে ভর্তি হয়। তিনি নিজে দুই নাতনিকে প্রশিক্ষণ দিতেন। সময় মতো প্রশিক্ষণ না নিলে বকাবকি করতেন।

এক দিন সুস্থ থাকার জন্য প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেছিলেন সকলের প্রিয় ঠাকুমা। সুস্থ থাকার জন্য আজ অনেকেই তাঁর পথে হাটছেন। যোগাসন করতে এগিয়ে এসেছেন নির্মলা সিংহ রায়, ভগবতী বিশ্বাস, আরাধনা পাল, গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মঞ্জু পাল, রুমকি সরকার, পাপিয়া বিশ্বাস সহ অনেক মহিলাই।

এঁদের সকলের বয়স ৬০ ছাড়িয়েছে। এঁরা সকলেই মানছেন, বয়স যাই হোক, অপর্ণা মুখোপাধ্যায়ই তাঁদের প্রেরনা।

নির্মলা বলেন, ‘‘এক দিন ওঁকে দেখে আমরা যোগাসনে ভর্তি হয়েছিলাম। এখন খুব ভাল আছি। আর যাই করি না কেন, ওঁর কথা মাথায় রেখে নিয়মিত অনুশীলন করতে ভুলি না। আজ মনে হয়, সে দিন ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম।

চাকদহ ব্লকের চান্দুরিয়া ১ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্য চান্দুরিয়া এলাকায় বাড়ি অপর্ণা মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর তিন ছেলে এবং দুই মেয়ে। সকলেই বিবাহিত। বছর কুড়ি আগে বড় বৌমা শিখা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দুরে হরসুন্দরী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগাসন কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেছিলেন অপর্ণা। বছর দশেক পরে বাড়ির সামনে শিমুরালি গার্লস প্রাথমিক শিমুরালি যোগ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণে যোগ দেন।

প্রথম প্রথম তিনি অনুশীলন করতে লজ্জা পেতেন। এ দিকে ও দিকে তাকিয়ে তার পর যোগাসন শুরু করতেন। তাঁকে প্রশিক্ষণ নিতে দেখে পথচলতি মানুষ দাঁড়িয়ে যেতেন। পাড়ার লোকেরা যদি কিছু বলেন, সেই লজ্জায় তিনি শাড়ির নীচে ট্র্যাকস্যুট পড়ে যোগাসন কেন্দ্রে যেতেন।

অপর্ণার বড় বৌমা শিখা বলেন, “মা যন্ত্রণায় খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। ছেলেরা কাজে ব্যস্ত থাকায় আমি নিজে তাঁকে যোগাসনে ভর্তি হতে নিয়ে গিয়েছিলাম। বিভিন্ন রাজ্যে প্রতিযোগিতায় অংশ নেবেন অথবা তিনি চ্যাম্পিয়ান হবেন, সেই আশা নিয়ে মাকে যোগাসনে ভর্তি করিনি। আমরা চেয়েছিলাম, মা সুস্থ হয়ে উঠুন। কষ্ট থেকে মুক্তি পান। আর যেন চোখের সামনে তাঁকে কাতরাতে না দেখি। প্রথম দিকে মায়ের ব্যথাটা মাঝে মাঝে কমত। আবার, বেড়েও যেত। এ ভাবে কিছু দিন চলার পর এক দিন মা আমায় বললেন— আজ ব্যথাটা সে ভাবে অনুভব করছি না। এটা শুনে সে দিন আমার খুব ভাল লেগেছিল। আনন্দে চোখের জল আটকে রাখতে পারিনি। তারপর যা হয়েছে, তা তো প্রায় ছোটখাট ইতিহাস বলা যায়।”

অপর্ণার যোগাসনে অগ্রগতি দেখে কোচ বিজন ঘোষ তাঁকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য পরামর্শ দেন। কোচের কথা শুনে জেলা স্তরের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শুরু করেন তিনি। যোগাসনের ব্যাপারে সরকার থেকে কোনও ধরনের আর্থিক সাহায্য পাওয়া যায় না। যে কারণে বাধ্য হয়ে বেশ কয়েক বছর তাঁর ছোট ছেলে স্নেহাশিস মুখোপাধ্যায় টিউশনি করে সেই টাকায় মাকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে নিয়ে যান।

এ ভাবেই এক দিন একের পর এক প্রতিযোগিতায় সাফল্য আসতে শুরু করে। জেলা, রাজ্য হয়ে জাতীয় প্রতিযোগিতায় সবাইকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছেন অপর্ণা। এ ভাবেই এক দিন তাঁর নিজের নামটা হারিয়ে গিয়ে সকলের কাছে হয়ে ওঠেন ‘চ্যাম্পিয়ান ঠাকুমা’।

বছর পনেরো ধরে হাওড়া জেলার বাগনান, উত্তর ২৪ পরগনা জেলার আড়িয়াদহ সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গার প্রতিযোগিতায় তাঁকে অংশ নিতে দেখা গিয়েছে। এ ছাড়া হরিদ্বার, চেন্নাই, পাঞ্জাবে জাতীয় প্রতিযোগিতায় তিনি অংশ নিয়েছিলেন। প্রথম বার জাতীয় যোগাসন প্রতিযোগিতায় তিনি তৃতীয় হয়েছিলেন। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। আরও বেশি বেশি করে অনুশীলন করতে শুরু করেন। পরের বছর তিনি বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিযোগীদের হারিয়ে চ্যাম্পিয়ান হয়েছিলেন।

সব মিলিয়ে মোট কুড়িটির মতো আসন চ্যাম্পিয়ান ঠাকুমার হাতের মুঠোয় ছিল। সত্তর বছর বয়েসেও তিনি এক পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। তাঁর সেই ব্যালেন্স দেখে উপস্থিত সকল দর্শক তাঁকে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানাতেন।

কোচ বিজন ঘোষ বলেন, “যোগাসনকে তিনি মনপ্রাণ দিয়ে ভালবেসে ফেলেছিলেন। একটা সময়ে এটাকে বাদ দিয়ে তিনি কিছু ভাবতেই পাড়তেন না।’’

কোচের কথায়, “খুব আস্তে কথা বলেন। কোনও জিনিস দেখিয়ে দিলে সেটা খুব সহজেই ধরতে পারতেন। তাঁকে প্রশিক্ষণ দিতে খুব একটা সমস্যায় পড়তে হয়নি। ওঁর সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় গিয়ে দেখেছি, মানুষ তাঁর খুব কাছে চলে আসতেন। তাঁর সঙ্গে ছবি তুলতেন। অভিনন্দন জানাতেন।”

বিজনের মতে, যোগাসনে আগ্রহ থাকার কারণে ওই বয়েসেও অপর্ণা জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ভাল ফল করেছিলেন। প্রতিযোগিতার সময়ে অন্য রাজ্যের মহিলারা অবাক হয়ে অপর্ণার যোগাসন দেখতেন।

আর ওয়াকারে হাঁটতে হাঁটতে চ্যাম্পিয়ান ঠাকুমা বলছেন, ‘‘প্রতিযোগিতায় অংশ নেব ভেবে এ সব শুরু করিনি। সবাই তো এক দিন মরে যাব। যে ক’টা দিন আছি, যেন সুস্থ ভাবে বাঁচতে পারি।’’

Aparna Mukherjee Yoga Champion চ্যাম্পিয়ান ঠাকুমা
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy