Advertisement
E-Paper

মুম্বইয়ে কোহালিয়ানার দর্পের পাশে কলকাতার টেনিস নস্ট্যালজিয়া

বেসলাইন থেকেই বাঁ হাতে টানা ব্যাকহ্যান্ড মেরে গেলেন রোচ। জয়দীপ মারছিলেন হাতের কাছে আসা ভলিগুলো। জয়দীপের ভলি সে সময় টেনিস সার্কিটে বিখ্যাত ছিল। মধ্য সত্তরে নড়তে পারেন না তো কী। বল কাছে এলে পুরনো স্মৃতি তো আছে। রোচ এখনও এত নিঁখুত কী করে? তাঁরা ফাইনালে উঠে যাওয়ার পর ব্যস্ত আলোচনা শুরু হল।একজনের বয়স সাড়ে চুয়াত্তর! একজনের সাড়ে একাত্তর! আরব সাগরের ধারে বিরাট কোহালি তাঁর ডাবল সেঞ্চুরি পূর্ণ করার ঘণ্টাখানেক বাদে মাঝদুপুরে কলকাতার টেনিস কোর্টে এই বৃদ্ধদের আগমন।

গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:৪৭
কলকাতায় রোচ-জয়দীপ যুগলবন্দি। শঙ্কর নাগ দাস

কলকাতায় রোচ-জয়দীপ যুগলবন্দি। শঙ্কর নাগ দাস

একজনের বয়স সাড়ে চুয়াত্তর! একজনের সাড়ে একাত্তর!

আরব সাগরের ধারে বিরাট কোহালি তাঁর ডাবল সেঞ্চুরি পূর্ণ করার ঘণ্টাখানেক বাদে মাঝদুপুরে কলকাতার টেনিস কোর্টে এই বৃদ্ধদের আগমন। প্রথম জনের নাম জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। দ্বিতীয় জন— টনি রোচ।

জীবিত বা মৃত, যে কোনও পারফর্মারই বলবে দর্শক উপস্থিতি হল তার সর্বোচ্চ মাদক। কোহালি যেমন ফর্মে এমনিতেও বড় রান করবেন। করতেন। কিন্তু চার্চ গেট স্টেশনের পিছন থেকে এই যে সাপের মতো এঁকেবেঁকে মুম্বইকরদের টেস্ট ক্রিকেট দেখতে আসার লাইন, তা তাঁর অ্যাড্রেনালিন অবশ্যই বাড়িয়েছে। এটাও তো বিলক্ষণ জানেন যে, হঠাৎ টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে এত চর্চা তার কারণও তিনি। টেস্ট ক্রিকেটকে আপাতত জীবনের চুম্বন এবং স্যালাইন দুটোই তিনি।

সল্টলেকের টেনিস কোর্টের ক্ষেত্রে অবশ্য একই শর্ত রক্ষিত হওয়ার উপায় নেই। কলকাতাবাসী ক’জনই বা জেনেছেন বা জেনে রোমাঞ্চিত বোধ করেছেন যে, টেনিস কোর্টের ষাট দশকের নস্ট্যালজিয়া এই ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকা দু’হাজার ষোলোয় আজ রোববার ফেরত আসতে পারে!

জয়দীপ-রোচ জুড়ি যখন সেলিব্রিটি টেনিসে কোর্টে নামছেন, তাঁদের আশেপাশে জনা পঞ্চাশেক দর্শকও রয়েছে কি না সন্দেহ। কলকাতার কিছু পুলিশ কর্তা, কর্পোরেট জগতের হনু, রাজ্য টেনিস সংস্থার কিছু মানুষ, মিডিয়ার হাতে গোনা লোক, ছত্তীসগঢ়ের প্রাক্তন রাজ্যপাল, ভুটানের রাজপরিবারের বিশিষ্ট মহিলা, প্রেমজিৎ লালের স্মৃতি রক্ষার্থে আয়োজিত কার্নিভালে তাঁর দাদা অজিত লাল— এই তো।

মুম্বই কোহালিময়। -এএফপি

উত্তুরে হাওয়া দিতে শুরু হলেও ওই সময় তো চড়া রোদ্দুর। এই পরিবেশে যে ডাবলস জুড়ির গড় বয়স সাড়ে বাহাত্তর, তারা ব্যাক টু ব্যাক ম্যাচ খেলতে হলে স্রেফ পার্সেন্টেজ খেলবে এটাই স্বাভাবিক। মাথায় রাখবে কতটা হিসেবি হয়ে কোর্ট থেকে উঠে আসা যায়। একটা স্ট্রেচ করে ফোরহ্যান্ড ভলিই তো অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি ডেকে আনতে পারে। বা একটা ওভারহেড ব্যাকহ্যান্ড বাইপাস সার্জারি।

সমস্যা হল চ্যাম্পিয়নদের মধ্যে এ সব জাগতিক বিপদ, আশঙ্কা এড়িয়েও একটা মহাজাগতিক সীমান্ত থাকে। যার নাম নিজের পুরনো শৌর্য ঘিরে গর্বের রোম্যান্টিসিজম। জয়দীপ-রোচ বোধহয় সেই সীমান্তেরই ডাক শুনছিলেন বারবার। ‘মাসল মেমরি’ বলে গুরুত্বপূর্ণ একটা শব্দ আছে। আধুনিক স্পোর্টসে যা বারবার ওঠে। একটা জিনিসের অনুশীলন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর করতে করতে সেটা শিরায় ঢুকে যায়। আর থেকেও যায়। সামান্য খোঁচাখুচিতে সেটা আবার বারও হয়ে পড়ে।

নইলে সেই পিছিয়ে যাওয়া সময় যখন কোহালির বাবা-মায়ের নির্ঘাত দেখা হয়নি। সেই ছেষট্টির চ্যালেঞ্জ রাউন্ডে মুখোমুখি হওয়া দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে আজও পারফেকশন কী করে লুকিয়ে থাকতে পারে? ছেষট্টি সালের মেলবোর্ন। সেই ডেভিস ফাইনালে যখন প্রথম সেট হেরেও টনি রোচ-জন নিউকোম্বকে হারিয়ে দিলেন জয়দীপ-কৃষ্ণন। লেখা হয়েছিল বছরের বৃহত্তম অঘটন। নিউকোম্ব-রোচ তখন ডাবলসে বিশ্বসেরা জুটি। সে বছর একটাও ম্যাচ হারেননি।

অধুনা সিডনিবাসী রোচের গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেতাব মাত্র একটা। কিন্তু তারই সঙ্গে পাঁচ বারের গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনালিস্ট। একাধিকবার দেশকে ডেভিস কাপ জেতানোতেই শেষ নয় তাঁর টেনিস সিভি।

কোচ হিসেবেও তিনি শালপ্রাংশু। দু’ধরনের চ্যাম্পিয়নকে তিনি কোচ করেছেন যারা স্বেচ্ছায় তাঁর শিষ্যত্ব নিয়েছে দুটো ভিন্ন সময়ে। দুটো ভিন্ন স্ট্র্যাটেজিক কারণে। ইভান লেন্ডল উইম্বলডন জিততে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে ভলি নিঁখুত করার জন্য রোচের কাছে নাড়া বাঁধেন। আর ফেডেরার উন্নতি করতে চেয়েছিলেন বেসলাইন প্লে-র। যাতে ফ্রেঞ্চ ওপেন জিততে পারেন। কী দাঁড়াল? না এমন এক্সপার্ট যে নেটের কাছে যেমন তুখোড় ছিল, বেসলাইনেও তাই।

এ দিন অবশ্য বেসলাইন থেকেই বাঁ হাতে টানা ব্যাকহ্যান্ড মেরে গেলেন রোচ। জয়দীপ মারছিলেন হাতের কাছে আসা ভলিগুলো। জয়দীপের ভলি সে সময় টেনিস সার্কিটে প্রসিদ্ধ ছিল। তিনটে গ্র্যান্ড স্ল্যামের চতুর্থ রাউন্ডে ওঠা মানুষটা আজ মধ্য সত্তরে নড়তে পারেন না তো কী। বল কাছে এলে পুরনো স্মৃতি তো আছে। নিজের সম্পর্কে রোম্যান্সের তাজকে তো আর খসতে দেওয়া যায় না। রোচ এখনও এত নিঁখুত কী করে? তাঁরা ফাইনালে উঠে যাওয়ার পর ব্যস্ত আলোচনা শুরু হল।

তার চেয়ে সামান্য বিস্ময়কর যখন জানা গেল গোটা পিঠে সার্জারি হয়েছে অস্ট্রেলীয়র। তা নিয়ে আজও এত নিঁখুত। এ মডার্ন গ্র্যাফাইট র‌্যাকেট পেলে কী করত? কিন্তু এত ব্যাকহ্যান্ড কেন? জয়দীপ ম্যাচ শেষে ব্যাখ্যা করলেন, টনি ফোরহ্যান্ড মারতে পারে না। কব্জির একটু ওপর থেকে বড় ইনজুরি আছে।

সপ্তাহখানেক আগে কোহালির ফিটনেসের প্রশংসা করেছিলেন এক আইপিএল কর্তা। কোহালি তাঁকে বলেছেন, ‘‘এখনও নিজের ফিটনেস নিয়ে সন্তুষ্ট নই। আমার শরীরে ফ্যাটের পার্সেন্টেজ এখনও ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর চেয়ে বেশি। আমার লক্ষ্য ফিটনেসে রোনাল্ডোকে ধরা।’’ সাধে কী আর তাঁকে বলা হচ্ছে তেন্ডুলকর + ফিটনেস!

কিন্তু ফিটনেস অধ্যুষিত আধুনিক ক্রিকেটসমাজের সেরা প্রতিনিধি কোহালি কি স্বপ্নেও ভাবতে পারেন পঁচাত্তুর আর বাহাত্তুরেরা ফিটনেসশূন্য অবস্থাতেও এমন প্রদর্শনী দেখাতে পারে যে, ফাইনাল হেরে গেলেও তাদের ঘিরে বিস্ময় থেকে যায়।

চ্যাম্পিয়নের সূর্য ওঠা। আরব সাগরের ধারে। তার দীপ্তি আলাদা। তার তেজ আলাদা।

চ্যাম্পিয়নের অস্তমিত সূর্য। গঙ্গাপারে। তারও যে জুড়িয়ে দেওয়া প্রশান্তি থাকে!

Tony Roche Virat Kohli Cricket-Tennis
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy