বেলজিয়ামকে হারিয়ে মাঠে দুই সন্তানের সঙ্গে ওয়েলসের তারকা নিল টেলর।—নিজস্ব চিত্র
বছর নয়-দশের ছোট্ট ছেলে। স্বপ্ন আর বাস্তব মিলিয়ে যার দুনিয়াটা শুধুই ফুটবল। সে বন্ধুদের জন্মদিনের পার্টি ছাড়তে পারে, স্কুলের নানা উৎসবের হুটোপাটি ভুলতে পারে, কিন্তু ফুটবল প্র্যাকটিস?
কখনও না!
‘‘ও যখন ছোট্ট বাচ্চা, তখন থেকেই ফুটবলের বাইরে আর কখনও কিছু চায়নি। টিনএজার হিসাবেও ওর ধ্যানজ্ঞান ছিল শুধু ফুটবল।’’ বলছিলেন কলকাতার গুরুসদয় দত্ত রোডে বড় হওয়া শিবানী চক্রবর্তী টেলর। যাঁর ছেলে নিল বুধবার ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর পর্তুগালের স্বপ্নভঙ্গ ঘটিয়ে ফুটবলের ওয়েলশ-রূপকথা লেখার প্রতিজ্ঞা নিয়ে নামছেন লিয়ঁর মাঠে।
নিল টেলর। কলকাতা মামারবাড়ি হওয়ার সূত্রে শহরটার সঙ্গে যাঁর নাড়ির টান। প্রথম বাঙালি ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত ফুটবলার হিসাবে যিনি এ বার ইউরো কাপের মঞ্চে নেমে শুধু সাড়াই ফেলেননি। সিআর সেভেন, ইব্রাহিমোভিচের মতো মহাতারকাকে ফাজিল খোঁচা মারার সাহসও দেখিয়েছেন!
ওয়েলসের সাতাশ বছরের লেফট ব্যাক রাশিয়ার বিরুদ্ধে ৩-০ জয়ে একটা গোল করেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘‘প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত ফুটবলার হিসাবে ইউরোয় গোল করে কেমন লাগছে?’’ জবাব এসেছিল, ‘‘দারুণ! শুধু তাই নয়, আমি এখনও টুর্নামেন্টে রোনাল্ডো, ইব্রাহিমোভিচের চেয়ে গোল করায় এগিয়ে!’’
সেই নিল পর্তুগালের সঙ্গে সেমিফাইনালের আগে বলেছেন, ‘‘রোনাল্ডোরা নিশ্চয়ই চেয়েছিল যেন বেলজিয়াম নয়, ওয়েলসের সামনে পড়ে। ম্যাচের পর ওরা কিন্তু ভাববে কী কুক্ষণে যে ওয়েলসকে চেয়েছিলাম!’’
নিলের বাবা জন টেলর ব্রিটিশ। ছেলের ফুটবল প্রেম দেখে ন’বছর বয়সেই নিলকে ভর্তি করেছিলেন ম্যাঞ্চেস্টার সিটির অ্যাকাডেমিতে। শিবানী বলছিলেন, ‘‘সপ্তাহে তিন দিন ডেনবিশায়ারে আমাদের রুথিনের বাড়ি থেকে ম্যাঞ্চেস্টার সিটির অ্যাকাডেমিতে নিয়ে যেতাম ওকে। গাড়িতে বসেই হোমওয়ার্ক সেরে রাখত। এমন হয়েছে কোনও বন্ধুর জন্মদিনের পার্টি আছে বা স্কুলে কোনও ফেস্ট কী ডিস্কোর অনুষ্ঠান। তবু সব ফেলে শুধু ফুটবল খেলেছে। আজ ও ইউরো সেমিফাইনাল খেলবে। মনে হচ্ছে ওর সব তপস্যা আজকের এই দিনটায় সার্থক হল।’’
ন’বছর বয়স পর্যন্ত প্রত্যেক ছুটিতে নিয়ম করে মায়ের সঙ্গে আসতেন গুরুসদয় দত্ত রোডের মামারবাড়িতে। তবে ফুটবলের কাছে সেই টানও হার মানে। পনেরো বছর পর্যন্ত ম্যাঞ্চেস্টার সিটির যুব দলে খেলে যোগ দেন রেক্সহামে। সেই ক্লাব থেকেই ওয়েলস জাতীয় দলে প্রথম ডাক ২০১০-এ, ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে। এর পর যোগ দেন সোয়ানসি সিটিতে এবং টিমকে প্রিমিয়ার লিগে তোলায় ভূমিকা নেন।
তাঁর বাবা জন, স্ত্রী জেনা এবং মা, কলকাতার শিবানী।—নিজস্ব চিত্র
২০১৩-য় নিলের কলকাতা যাত্রা অবশ্য ছিল ফুটবলের সৌজন্যেই। ব্রিটিশ কাউন্সিল, প্রিমিয়ার লিগ এবং কলকাতা পুলিশের যৌথ উদ্যোগে খুদে প্রতিভা তুলে আনার এক কর্মশালায় যোগ দিতে। সে বার ইস্টবেঙ্গল মাঠে প্রায় দু’শো বাচ্চার সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলে চুটিয়ে হল্লা করেছিলেন।
তার পর থেকে অবশ্য ওয়েলসের হয়ে ইউরোর যোগ্যতা অর্জনে মন দেন। আর এখন সেমিফাইনালের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘‘বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত বুঝতে পারব না দেশে ঠিক কী কাণ্ড ঘটছে। তবে যা উৎসাহ তৈরি হয়েছে শুনছি, বুধবারটা মনে হচ্ছে ছুটি ঘোষণা করে দিলেই ভাল হয়।’’ ছেলেকে নিয়ে অসম্ভব গর্বিত মা-ও। শিবানী, তাঁর স্বামী জন এবং পুত্রবধূ জেনা। যাঁরা ইতিমধ্যেই ফ্রান্সে। বুধবার গ্যালারি থেকে নিলের দলের হয়ে গলাও ফাটাবেন।
নিলের স্ত্রী ও তাঁদের দুই সন্তানের মা জেনা বলেছেন, ‘‘এই জায়গায় পৌঁছতে ও অবিশ্বাস্য পরিশ্রম করেছে। অনেক স্বার্থত্যাগ রয়েছে। কিন্তু বিনিময়ে আজ ওর জন্য শুধু আমরা নই, গোটা দেশ গর্বিত।’’
নিলকে নিয়ে গর্বিত তাঁর মামার বাড়ির দেশও। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো অনুরাগীরা যতই থাকুন না কলকাতায়, বুধবার গুরুসদয় দত্ত রোড কিন্তু সমর্থন করবে ওয়েলসকেই।
ইউরোর শেষ চারে
পর্তুগাল বনাম ওয়েলস বুধবার, রাত ১২-৩০
জার্মানি বনাম ফ্রান্স বৃহস্পতিবার, রাত ১২-৩০
সোনি সিক্স ও সোনি-ইএসপিএন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy