Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

শান্তিতে ঘুমোও, দেখা হবে ক্রিজে

দাদার টিমে প্লেয়ার কম না পড়লে হয়তো ক্রিকেট ব্যাটটাই হাতে তোলা হত না। জেসন হিউজ তখন শহরের অনূর্ধ্ব দশ টিমের সদস্য। এগারো জন পাওয়া যাচ্ছে না, তাই একদিন ডাক পড়ল ছোট্ট ফিলিপের। ক্রিকেটে যার ছিটেফোঁটা আগ্রহও তখন নেই। এবং দুই ভাইয়েরই ধারণা ছিল, ফিল ব্যর্থ হবে। জীবনের প্রথম ক্রিকেট ম্যাচে সে দিন টেলএন্ডার হিউজের স্কোর ছিল ২৫।

শেষ যাত্রায়। ক্লার্কদের কাঁধে কফিন।

শেষ যাত্রায়। ক্লার্কদের কাঁধে কফিন।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:২৭
Share: Save:

দাদার টিমে প্লেয়ার কম না পড়লে হয়তো ক্রিকেট ব্যাটটাই হাতে তোলা হত না। জেসন হিউজ তখন শহরের অনূর্ধ্ব দশ টিমের সদস্য। এগারো জন পাওয়া যাচ্ছে না, তাই একদিন ডাক পড়ল ছোট্ট ফিলিপের। ক্রিকেটে যার ছিটেফোঁটা আগ্রহও তখন নেই। এবং দুই ভাইয়েরই ধারণা ছিল, ফিল ব্যর্থ হবে। জীবনের প্রথম ক্রিকেট ম্যাচে সে দিন টেলএন্ডার হিউজের স্কোর ছিল ২৫।

সেই থেকে শুরু। তার পর ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাদার সঙ্গে পড়ে থাকা। কী, না ব্যাটিং গড়টা কী ভাবে কষতে হয়, বুঝতে পারছেন না। বাবা গ্রেগকে দিয়ে এত বেশি থ্রো-ডাউন করিয়ে যাওয়া যে, তাঁর কাঁধের করুণ অবস্থা দেখে স্থানীয় ক্লাবের একটা বোলিং মেশিন কিনে ফেলা। একটু বড় হলে ম্যাক্সভিল থেকে সিডনি যাত্রা, রান্নাবান্না খুব ভাল না পারলেও বাড়ি না ফিরে দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থাকা। বাবার সঙ্গে নিজেদের খামারে সময় কাটাতে খুব ভাল লাগত, কিন্তু তত দিনে ক্রিকেটটাকেও বড্ড ভালবেসে ফেলেছেন।

নিউ সাউথ ওয়েলস থেকে সাউথ অস্ট্রেলিয়া হয়ে ব্যাগি গ্রিন প্রাপ্তি। সবচেয়ে কম বয়সে জীবনের দ্বিতীয় টেস্টের দু’ইনিংসেই সেঞ্চুরির রেকর্ড। প্রতিভাবান সম্ভাবনা হিসেবে শুরু করে ভবিষ্যতের লগ্নি হয়ে ওঠা।

১৯৮৮ থেকে ২০১৪— ছাব্বিশ বছরের তিন দিন আগে শেষ হয়ে যাওয়া একটা জীবন। সংক্ষিপ্ত, কিন্তু সমৃদ্ধ। যে জীবনের বড়-ছোট, সুখী-অসুখী নানা মুহূর্ত সযত্ন, সস্নেহ তুলির টানে নতুন প্রাণ পেল এ দিন। শিল্পী কখনও পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্য, কখনও বোর্ডের মুখ্য কর্তা। কখনও খুব কাছের বন্ধু, কখনও জাতীয় দলের অধিনায়ক।

ম্যাক্সভিল হাইস্কুলে হিউজ-স্মরণ, তাঁর আত্মার শান্তি কামনায় প্রার্থনা, তার পর কফিন নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ, সব শেষে তাঁকে চিরবিশ্রামে শুইয়ে দেওয়া। অনুষ্ঠানের তাত্‌পর্য দৈর্ঘ্যে নয়, তার অসীম গভীরতায়। অবিশ্বাস্য ব্যাপ্তিতে। ম্যাক্সভিল শহরের জনসংখ্যা কম, কিন্তু ম্যাক্সভিল-জাত হিউজের অবস্থান এখন আর কোনও শহর বা দেশে সীমাবদ্ধ নেই। তাঁর শেষকৃত্যে যদি সশরীরে হাজির হন ব্রায়ান লারা-শেন ওয়ার্ন, তা হলে আত্মিক ভাবে উপস্থিত ছিলেন সচিন তেন্ডুলকর। হিউজের কফিনের সামনে যখন ফুল সাজাচ্ছেন এক তরুণ, বিশ্বের আর এক প্রান্তে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে মোমবাতি জ্বালাচ্ছেন কোনও এক প্রৌঢ়। কফিন নিয়ে শোকযাত্রায় বিরাট কোহলি-ডানকান ফ্লেচারের পাশে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট-ডেভিড ওয়ার্নার-শেন ওয়াটসন, হিউজ পরিবারের সঙ্গে সস্ত্রীক মাইকেল ক্লার্ক, সাধারণ শহরবাসীর সঙ্গে হাঁটছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবট।

সিডনি, লর্ডস, ওয়াকা, বেলেরিভ ওভাল, অ্যাডিলেড— ক্রিকেটবিশ্বের খুব চেনা সব মাঠে ততক্ষণে মঠের আবহ। স্কোরবোর্ডের স্ক্রিনে হিউজের শেষকৃত্য দেখতে দেখতে কোথাও অঝোরে কাঁদছেন মাঠকর্মী থেকে ক্রিকেটার। কোথাও ‘৬৩ নট আউট’ লেখা জার্সি পরা এক ঝাঁক নিশ্চুপ খুদে। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ড, যেখানে হিউজের শেষের শুরু, সেখানে সারি দিয়ে দাঁড় করানো তেষট্টিটা ক্রিকেট ব্যাট। হিউজের শেষ ইনিংসের প্রতিটা রান অমর করে রাখা প্রত্যেকটা ব্যাটে লেখা তাঁকে নিয়ে কোনও না কোনও তথ্য। যে স্টাম্পের সামনে দাঁড়িয়ে মারণ আঘাতটা পান হিউজ, সেখানে এখন তাঁর স্মৃতিসৌধ। ছবি, ফুল, ক্রিকেট কিটে সাজানো। পিচ আর সেন্টার স্কোয়ার দড়ি দিয়ে ঘেরা। যে পিচে হিউজের শেষ ইনিংস খেলা, সেখানে আপাতত ক্রিকেট বন্ধ। এই গ্রীষ্মে ওই পিচ আর ব্যবহার করা হবে না।

বিশ্বব্যাপী এই শোকসভা যত দিন চলবে, তত দিনই বোধহয় প্রতিধ্বনিত হবে ‘ছোট ভাই’য়ের প্রতি মাইকেল ক্লার্কের বিদায়ী বার্তা। ব্যাগি গ্রিন মানে শুধু জেদ-হিংস্রতা-স্লেজিং নয়, ব্যাগি গ্রিন যে গভীর মানবতারও প্রতীক, তা গত আট দিনে বারবার ফুটে উঠেছে অস্ট্রেলীয় অধিনায়কের কথায়, তাঁর কান্নায়। এখনও ক্লার্কের মনে হয়, ‘হিউজি’ বুঝি আশেপাশেই আছেন। “বৃহস্পতিবার রাতে এসসিজির পিচে হাঁটছিলাম। ওই ঘাসের উপর ফিল আর আমার কত পার্টনারশিপ আছে। ওই গ্যালারি কত বার উঠে দাঁড়িয়ে ফিলকে অভিবাদন জানিয়েছে। ওই বাউন্ডারির বাইরে কত বার বল মেরে ফেলেছে ফিল। উইকেটের উপর ঝুঁকে পড়ে ঘাসগুলো ছোঁয়ার সময় মনে হল, ফিল আমার সঙ্গেই আছে। আমাকে টেনে তুলে দেখছে, আমি ঠিক আছি তো? আমাকে বলছে, অন্তত চা-বিরতি পর্যন্ত ক্রিজে পড়ে থাকতেই হবে। আমি যে লুজ শটটা খেলেছি, সেটা নিয়ে আমাকে বকছে। রাতে কী সিনেমা দেখব, সেটা নিয়ে গল্প করছে। অস্ট্রেলিয়ায় আমরা বিশ্বাস করি আমরা যে মাটিতে হাঁটি, তার সঙ্গে আমাদের আত্মার যোগাযোগ তৈরি হয়ে যায়। এসসিজিতে এটাই হয়েছে। ফিলের আত্মা মাঠটাকে ছুঁয়ে গিয়েছে, তাই ওই মাঠটা আমার কাছে চিরকাল পবিত্র হয়ে থাকবে। শান্তিতে ঘুমোও আমার ছোট্ট ভাইটা। আবার দেখা হবে ক্রিজে।”

ক্লার্ক মনে করেন, হিউজের আত্মা বিশ্বের মানুষের মধ্যে একটা অদৃশ্য যোগসূত্র সৃষ্টি করে দিল। ক্লার্ক মনে করেন, হিউজের আত্মা চিরকালের জন্য ক্রিকেটের অংশ হয়ে গেল। ক্লার্ক মনে করেন, হিউজের আত্মা এ বার থেকে ক্রিকেটের রক্ষক হয়ে থাকবে।

ফিলিপ জোয়েল হিউজ আজ শান্তিতে ঘুমোতে গেলেন। ফিলিপ জোয়েল হিউজ আজ থেকে অমর হয়ে থাকলেন।

ছবি গেটি ইমেজেস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE