Advertisement
E-Paper

বারো বছরের শাপমোচন আর মেসিকে হারানোর হাতছানি

লিওনেল মেসির নাম শুনলে পর্তুগিজ সমর্থকরা প্রশ্নকর্তার সঙ্গে একটু ইয়ার্কি করতে বেশ পছন্দ করেন। অপরিচিতের থেকে দু’জনের তুলনা শুনে মিটিমিটে হেসে চকিত পাল্টা দেন, “মেসি, কুইম?”

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৬ ০৩:৫৮

লিওনেল মেসির নাম শুনলে পর্তুগিজ সমর্থকরা প্রশ্নকর্তার সঙ্গে একটু ইয়ার্কি করতে বেশ পছন্দ করেন। অপরিচিতের থেকে দু’জনের তুলনা শুনে মিটিমিটে হেসে চকিত পাল্টা দেন, “মেসি, কুইম?”

পর্তুগিজে ‘কুইম’-এর অর্থ হল ‘কে’। গত রাতে এক পর্তুগিজই বললেন। বক্তব্যের সারমর্ম এর পর ক্লাস টু-র বাচ্চার কাছেও দুর্বোধ্য হওয়ার কথা নয়। ফ্রান্সে দিন পনেরো কাটিয়ে ফেলার পর ওই দু’শব্দের অবজ্ঞা ছাড়াও পর্তুগিজ সমর্থকদের থেকে মেসি-প্রসঙ্গে অনেক কিছু কানে এসেছে। ‘তুলনাটা আসে কী করে’, ‘কোথায় রোনাল্ডো আর কোথায় মেসি’, ‘ভাই, তুমি পর্তুগিজকে জিজ্ঞেস করছ কে বড়’ নানাবিধ ছোট-বড় খোঁচা। বিশ্বসেরা ফুটবলারের সিংহাসন নিয়ে আর্জেন্তিনীয়র সঙ্গে সকাল-সন্ধে টানাটানি চলে যখন নিজ-দেশের এক নম্বর ফুটবল-তারকার, মনে বিতৃষ্ণার মেঘ জমে থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু উপায়ও কী? পেলে-মারাদোনা, সচিন-গাওস্কর, ম্যাকেনরো-বর্গ, মহম্মদ আলি-জো ফ্রেজিয়ারের মতো খেলাধুলোর কালজয়ী যুদ্ধ-তালিকায় এটা ঢুকে গিয়েছে কবে।

সিআর সমর্থকদের নিস্তারও নেই। বারো বছর পর ইউরো ফাইনালে ওঠার অমৃতে তৃপ্ত চুমক দেবেন কী, আবার কোথা থেকে লিওনেল মেসি হাজির হয়ে যাচ্ছেন! ইউরোর পঁচাশি মাইলের মধ্যে নেই, আর্জেন্তিনা লাতিন আমেরিকার টিম। কিন্তু তার পরেও আর্জেন্তিনীয়র ছায়া উপস্থিত হয়ে যাচ্ছে স্তাদ দে ফ্রাঁসের ইউরো সমাপ্তি-যুদ্ধে।

লিওনেল মেসির প্ল্যাটফর্মে এ বার ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো!

লিওনেল মেসি আজ পর্যন্ত দেশের জার্সিতে চারটে মেগা টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলেছেন। বিশ্বকাপ, কোপা আমেরিকা। কিন্তু একটাও পারেননি জেতাতে। সবুজ-লালে ক্রিশ্চিয়ানোর এটা দু’নম্বর। বারো বছর আগে ইউরো কাপ ফাইনালে উঠেছিলেন। গ্রিসের বিরুদ্ধে সহজতম সুযোগ বারের উপর দিয়ে উড়িয়ে না দিলে কেউ তো আজ মেসির সঙ্গে তুলনায় ঢোকার সাহসই পেত না। এক সময়ের পর্তুগিজ জলদস্যুদের মতোই তাই চরম প্রশ্নটা ইউরো-আকাশে হানা দিচ্ছে যে, এক যুগ পর কী হবে? রবিবার পারবেন একত্রিশ বছরের রোনাল্ডো? পারবেন, লিওকে ধুলিস্যাৎ করে সম্মানের মুকুট বরাবরের মতো ছিনিয়ে নিতে?

বুধবার রাতে পর্তুগাল সমর্থকদের দেখে যদিও মনে হল না, বিশ্বব্যাপী এ সব প্রশ্নের ন্যূনতম মর্যাদা দানে ইচ্ছুক বলে। অত সময়ই নেই। এত দিন ফ্রান্স জিতলে যে উচ্ছ্বাসের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ত, বুধবার রাতে পর্তুগিজরা তার অবিকল অনুকরণ করে গেলেন! সেই রাস্তা দিয়ে প্লাবনের মতো হাতে-হাত ধরে হেঁটে যাওয়া, সেই ফরাসিদের মতো রাস্তা-ঘাটের গাড়ি থামিয়ে উন্মত্ত নটরাজ-নৃত্য, মেট্রোর টিকিট পাঞ্চিং মেশিনের সামনে জনসমাবেশ ঘটিয়ে লোকজনের যাতায়াতকে দুঃসাধ্য করে তোলা। সঙ্গে আবার ‘লে ব্লু’, ‘লে ব্লু’ আওয়াজ! ফরাসিদের প্রতি বক্রোক্তি কি না, ভাষা-অজ্ঞতার কারণে নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব। হতেও পারে। সমর্থনের ভঙ্গিমা অনুকরণ তো একটাই বার্তা দিচ্ছিল— ফ্রান্স প্রহর গোনো, দেখতে থাকো তোমার হৃদয় থেকে আমাদের রোনাল্ডো কেমন কাপটা নিয়ে যায়!

বিশ্বফুটবলের দুই মহাতারকার প্রেক্ষাপটটাই এখন এত বিপরীতধর্মী আর নাটকীয় যে, তুলনা আরও বেশি করে চলে আসছে। সিআর ব্যর্থতার মৃত্যুগুহা থেকে এক রাতে বেরিয়ে সাফল্যের সূর্যোদয় দেখছেন। পর্তুগালের কাগজে গোলের পর তাঁর ট্রেডমার্ক সেলিব্রেশনের ছবি এ দিন কভারপেজ জুড়ে নেওয়া হয়েছে। নীচে বড় একটা আর্টিকল— রোনাল্ডো দেশকে ফাইনালে তো তুললেনই, ইউরোয় মিশেল প্লাতিনির গোলের রেকর্ডও ছুঁলেন একই সঙ্গে।

গত কাল ম্যাচের প্রথমার্ধ পর্যন্ত দেখে যা ঘটতে পারে বলে মনে হয়নি। পর্তুগাল বক্সের পাশে ক্রমাগত ‘বেল-ড্যাশের’ পাশে রোনাল্ডোর হতাশার আস্ফালনের ছবি নিয়েই লিখতে হবে বলে মনে হচ্ছিল। কে জানত, প্রথমার্ধে হতাশার সিআর, দ্বিতীয়ার্ধে কয়েক মিনিটের মধ্যে গোলের ক্রুদ্ধ গর্জন তুলবেন। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ভরে যাবে, ‘সিআর, ইউ বিউটি’, ‘বড় ম্যাচের বড় প্লেয়ার’ জাতীয় পোস্টে, ম্যাচ শেষে রোনাল্ডো বলে দেবেন, “আমাদের এখন রবিবারের জন্য তৈরি হতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, চ্যাম্পিয়ন হব। গোটা কেরিয়ার জুড়ে যে আত্মত্যাগ, যে খাটাখাটনি আমি করেছি তাতে বিশ্বাস করি, ইউরো জেতা আমার পক্ষে সম্ভব।”

রোনাল্ডো-রাতে মেসি কোথায়? না, কোপা হারের শোকতাপে অবসর-সিদ্ধান্তের পর আর এক অপমানের সম্মুখীন। রোনাল্ডো-উচ্ছ্বাসের দিনেই আদালতের অর্ডার বেরিয়েছে— মেসি কর ফাঁকি দিয়েছেন। শাস্তি একুশ মাসের জেল। স্পেনের নিয়মে কারাগার-বাস আর্জেন্তিনীয়কে করতে হচ্ছে না। কিন্তু এর পর সম্মান অক্ষুণ্ণ থাকে কতটুকু?

দু’পক্ষের দীর্ঘ দিনের বৈরিতার উদাহরণও ইউরো ফাইনাল-মঞ্চ বেয়ে উঠে আসছে। মেসি একবার বলে দিয়েছিলেন, রোনাল্ডোর সঙ্গে তিনি লড়েন না। মিডিয়া লড়িয়ে দেয়। শুনে সিআর বলে দিয়েছিলেন, মেসিকে তিনি এক নম্বর বলেই ভাবতে পারেন না। নিজের বাইরে কাউকে সেরা হিসেবে দেখেনও না। লোকের রোনাল্ডোকে তখন উন্নাসিক মনে হয়েছিল। কিন্তু সে দিনের উন্নাসিকতাই ধ্রুব সত্য হয়ে যাবে রবিবারের ফাইনালটা রোনাল্ডো জিতলে। যার আগাম হুঙ্কারও যথাযথ।

রোনাল্ডো বলেছেন। পর্তুগাল কোচ ফের্নান্দো স্যান্টোস বলছেন, “কী ভাবে জিতছি না জিতছি, আমার ভাবার সময় নেই। জিতছি, সেটাই আসল। দারুণ খেলে হার আমার কাছে যুক্তিহীন।” পর্তুগাল জনতাও বলছে। বারো বছর আগের রাত যাঁদের মনে আছে। মনে আছে, কান্নার রোনাল্ডো। নিজেদের নির্ঘুম রাত। কোথাকার কে এক ক্যারিস্তিয়াস এসে যে দিন সর্বস্ব লুঠ করে নিয়ে গিয়েছিলেন। বারো বছর পর পর্তুগাল চায় একটা শান্তির ঘুম। চায়, শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে মেসিকে হারিয়ে মুকুটটা চলে যাক রোনাল্ডোর মাথায়।

এটুকু পারবেন না সিআর? না পারলে তিনি আর কীসের সিআর!

Portugal euro cup 2016
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy