পদানির গোল-উত্সব ভেস্তে দিলেন পুণের কোস্তাস। শনিবার বালেওয়াড়ি স্টেডিয়ামে।
আটলেটিকো ১ (পদানি)
পুণে সিটি ১ (কোস্তাস)
পুণে সিটির হোর্ডিংয়ের নীচের স্লোগানটা কি কোস্তাস কাতসুরানিসের জন্যই তৈরি? হয়তো তাই-ই।
‘লিভ টু উইন’। জেতার জন্যই বাঁচা। রঙিন আর বর্ণময় কমলা গ্যালারিতে শহর জুড়ে ছেয়ে ফেলা স্লোগানেরই প্রতিধ্বনি। কোস্তাস তো বাঁচিয়েই রাখলেন দলকে। না হলে আজই শেষ হয়ে যেত বাণিজ্যশহরের সব আশা।
বিদ্যুত্ গতির জোরাল বলটা যখন আটলেটিকো কলকাতার গোলে আছড়ে পড়ল তখন তাই সেই স্লোগানটা বদলে গেল। ‘লিভ টু উইনের’ বদলে ‘পুণে, পুণে, কোস্তাস, কোস্তাস ....।”
ব্রাজিল বিশ্বকাপে গ্রিস টিমের অধিনায়ক দলকে অক্সিজেন দিয়ে দৌড়ে এসে কাকে চুপ করতে বললেন? ভিভিআইপি গ্যালারিতে আঙুল তুললেন কার দিকে? প্রেসবক্স থেকে বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানে বসে আছেন কলকাতার মালিক-কর্তারা। যাঁরা পদানির গোলটার পর আটলেটিকোর পতাকা উড়িয়ে ছিলেন। দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দিয়েছিলেন।
ম্যাচের আগে যা দেখার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন এখানকার আইএসএল দর্শকরা, তার কিছুই অবশ্য দেখা যায়নি। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় আর হৃতিক রোশন মুখোমুখি হননি। দু’জনেই আসেননি মাঠে। লুই গার্সিয়া বনাম ডেভিড ত্রেজেগুয়েও তো হল না। কলকাতার স্প্যানিশ বিশ্বকাপার তাঁর কোটার সময় মেনে খেললেন। বসেও গেলেন দ্বিতীয়ার্ধে। আর বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্স স্ট্রাইকার সারাক্ষণ দলের ‘ভীষ্ম’ হয়ে বসে রইলেন রিজার্ভ বেঞ্চে। নামার সুযোগই পেলেন না। ফেরার সময় মুখটা বেশ মলিনই দেখাল মেজাজি ত্রেজেগুয়ের। মিক্সড জোনেও কোনও প্রশ্ন উড়ে এল না তাঁর জন্য। বেচারা! বিশ্বের সেরা স্টেডিয়ামগুলো যাঁর জন্য একসময় বারবার উদ্বেল হয়েছে, যাঁকে বলা হত ‘ডার্লিং স্ট্রাইকার’, কেউ তাঁর জন্য একটা হাতও বাড়াল না। আসলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চোখ যে বদলে যায়। বদলে যায় সমর্থনের অভিমুখ। নন-পারফর্মারদের দিকে কেউই হাত বাড়ায় না। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। ত্রেজেগুয়ের ক্ষেত্রে এর অন্যথা হবে কেন?
কিন্তু তাতে অবশ্য ম্যাচের রং ফিকে হয়ে যায়নি। গোলের পর আন্তোনিও হাবাস লাফালেন, দল সমতায় ফেরার পর ফ্র্যাঙ্কো কোলোম্বা দৌড়ে এক পাক ঘুরে নিলেন। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে গেল দর্শকদের নিজেদের টিম নিয়ে আবেগ আর উদ্বেলতা। বালেওয়াড়ি স্টেডিয়াম মূল পুণে শহর থেকে অনেক দূরে। অনেকটা কলকাতা থেকে বারাসতের মতো। সেখানে পাণ্ডববর্জিত গ্রামীণ এলাকায় হাজির দেশের সেরা মডেলের অসংখ্য গাড়ি। বিদেশের মতো দর্শকরা পরিবার নিয়ে এসেছেন বহু দূর-দূর থেকে। কলকাতার গোলটার সময়ও চিত্কার হল। কারণ প্রবাসীরা এসেছিলেন প্রিয় শহরের টিমের ম্যাচ দেখতে। আর পুণের সময় তো বাজল ঢাক! উঠল শব্দব্রহ্ম। আইএসএল যতগুলো স্টেডিয়ামে হচ্ছে তার মধ্যে পুণেরটা সবচেয়ে ছোট। কিন্তু উন্মাদনা দেখে মনে হল ক্রিকেটের শহরকে ক্রমশ গ্রাস করছে আইএসএল। দু’টো আই লিগের টিম থাকলেও এই দর্শক আসছেন ‘অন্য আনন্দ’ উপভোগ করতে। উত্তেজনার সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া। গালে রং মেখে এসে চিত্কার।
তবে ম্যাচটা এতটাই অঙ্ক মেনে হল যে, মন ভরল না। দু’দলের দু’টো গোল চোখ টানল। কলকাতা কিপার বেটের সেভগুলো আন্তর্জাতিকতার ছোঁয়া আনল। কিন্তু ওইটুকুই। হাবাস ম্যাচের পর বলছিলেন, “পয়েন্ট পেয়ে ভাল লাগছে। কিন্তু দলের খেলায় খুশি নই। আমরাই তো ওদের পায়ে বল তুলে দিচ্ছিলাম।” পাশে থাকা নোটবই অবশ্য তা বলছে না। বরং লেখাই যায়, বেটে বাঁচিয়ে দিয়ে গেলেন দলকে। না হলে হয়তো হেরেই ফিরত কলকাতা। ম্যাচের সেরা কোস্তাসও বলে গেলেন, “আটলেটিকো কিপারের কাছে আটকে গেলাম।”
হাবাসের টিমটায় হঠাত্-ই যেন ঘুন ধরেছে। সেটপিসে নতুনত্ব নেই। ডাউন দ্য মিডল আক্রমণ তুলে আনার চেষ্টা নেই। মাঝমাঠের সাপ্লাই লাইন অকোজো। নিজেদের মধ্যে সমঝোতার চূড়ান্ত অভাব। এক বার তো দেখা গেল মাঠে ফিকরুর সঙ্গে গার্সিয়ার তর্ক হচ্ছে। বিপক্ষ গোলের সামনে স্প্যানিশ মিডিওর বাড়ানো বল বুঝতেই পারলেন না ইথিওপিয়ান স্ট্রাইকার। এ দিনের ফিকরুকে দেখে মনে হল ‘ওভার রেটেড’। চক্রব্যূহে পড়লে ওকোলি ওডাফাও হতে পারেন না। বল পেলে সতীর্থদের কথা মনে থাকে না। স্বার্থপরের মতো আচরণ করেন। আঠারো গজ বক্সের বাইরে থেকে ব্যাকভলি করতে গিয়ে এক বার হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। গ্যালারিতে তখন আওয়াজ উঠল, “হু হু হু’। ডুডুকে দেখে তাঁর শেখা উচিত। কী পরিশ্রমই না করলেন পুণের নাইজিরিয়ান স্ট্রাইকার! গোল না পাওয়ায় তাঁর নাচার ইচ্ছে পূর্ণ হয়নি। কিন্তু চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি।
সিদ্ধান্তহীনতার মোড়ক থেকে বেরিয়ে এসে দু’দলের কোচই এমন দু’টো চমক দিলেন টিম লিস্টে, যা কখনও ওঁরা করেননি। হাবাসের মগজাস্ত্র থেকে বেরোল বলজিত্ সিংহ আউট। মহম্মদ রফি ইন। শুরুতে হোফ্রে রিজার্ভ বেঞ্চে, পদানি মাঠে। তবে আগের ম্যাচের টিমে পাঁচটা পরিবর্তন করলেন কলকাতা কোচ। আর পুণে কোচের আস্তিন থেকে বেরোল আরও বড় চমক। সব আলোচনা থামিয়ে দিয়ে ত্রেজেগুয়ে এবং জোয়াকিম আব্রাঞ্চেজ দু’জনেই শুরুতেই বেঞ্চে রেখে দল নামালেন। বদলে ফ্রাঙ্কো কোলোম্বা আস্থা রাখলেন নবাগত দুই মিডিও পেন্যান্ট আর ভাদজের উপর। নিখুঁত অঙ্ক কষে বদল দু’ই কোচের এই পরিবর্তনের স্রোতে গা ভাসানো, সন্দেহ নেই।
কলকাতা টিমের সবথেকে গতিশীল ফুটবলার পদানি। শুরুতেই তাঁকে নামানোর পিছনে কারণ, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। মদ্যপ অবস্থায় প্রচণ্ড জোরে ইংল্যান্ডের রাস্তায় গাড়ি চালানোর জন্য জেলে যেতে হয়েছিল পেন্যান্টকে। সেই বোহেমিয়ান আগুনে গতির পুণে উইঙ্গারকে থামানোর জন্যই পদানিকে নামানো। হাবাসের লক্ষ্য সফল। গোলটার জন্য শুধু নয়, প্রাক্তন আর্সেনাল মিডিওকে থামানোর জন্যও পদানি ভাল নম্বর পাবেন। হোফ্রের জায়গায় শুরুতে নেমে পদানি ভালই খেললেন। কিন্তু আটলেটিকোর রক্ষণ যদি এক লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে, তা হলে যা হওয়ার তাই হল। বিরতির আগেই গোলটা শোধ হয়ে গেল। কোস্তাসের সৌজন্যে। কলকাতার সঙ্গে দু’টো ম্যাচেই সফল তিনি।
হাবাসকে প্রশ্ন করা হল, আপনার টিমের তো ধারাবাহিকতাই নেই? জয়ের পরই হার অথবা ড্র। এ বারও ভাগ্য বাঁচিয়ে দিল? শুনে কিছুটা রেগেই গেলেন কলকাতা কোচ। বলে দিলেন, “কেরলে রেফারি কী ভাবে হারিয়ে দিল সেটা তো বলছেন না? আর এত কম সময়ে পরপর ম্যাচ হলে এই রকমই হবে।”
পুণে কোচের মতো তাঁর কপালে শেষ চারে যাওয়ার চিন্তার বলিরেখা নেই। এখনও লিগ টেবলে দু’নম্বরে। যা হিসেব তাতে বাকি তিন ম্যাচের একটিতে জিতলেই কেল্লা ফতে। ফলে হাবাসের এখন লক্ষ্য দেল পিয়েরো বধ আর ‘মিশন দিল্লি’।
সেমিফাইনালে উঠলেও কলকাতা কি চ্যাম্পিয়ন হতে পারবে? পারফরম্যান্স যে ভাবে নিচের দিকে নামছে তাতে কিন্তু আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না।
আটলেটিকো: বেটে, কিংশুক, হোসে রে, অর্ণব, মোহনরাজ, পদানি (মনসরু), বোরহা, রাকেশ, রফি (বলজিত্), গার্সিয়া (হোফ্রে), ফিকরু।
ছবি: আইএসএল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy