Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ব দিয়ে ভয় কিন্তু বাংলাদেশের আগে বৃষ্টি

সকাল থেকে মেলবোর্নে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি আর তা থেকে ক্রিকেটমহলে নবতম দুশ্চিন্তা ছড়িয়ে যাওয়া। একটা বাক্যে এই হল বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালের আগের আগের দিনের এমসিজি। কোথাও কিছু নেই। এত দিন আবহাওয়ার চার্টে দেখা যাচ্ছিল বিষ্যুদবার তাপমাত্রা থাকবে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তার সঙ্গে এ দিন কয়েকটা ওয়েদার রিপোর্ট দেখাতে শুরু করে, বিকেলে বৃষ্টি। একটা ওয়েদার রিপোর্টে আবার বলছে বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি।

ফিল্ডিংয়ে অভিনবত্ব। পাতলা গ্লাভসে ক্যাচিং প্র্যাকটিস কোহলিদের।

ফিল্ডিংয়ে অভিনবত্ব। পাতলা গ্লাভসে ক্যাচিং প্র্যাকটিস কোহলিদের।

গৌতম ভট্টাচার্য
মেলবোর্ন শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৫ ০৪:৫১
Share: Save:

সকাল থেকে মেলবোর্নে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি আর তা থেকে ক্রিকেটমহলে নবতম দুশ্চিন্তা ছড়িয়ে যাওয়া।

একটা বাক্যে এই হল বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালের আগের আগের দিনের এমসিজি। কোথাও কিছু নেই। এত দিন আবহাওয়ার চার্টে দেখা যাচ্ছিল বিষ্যুদবার তাপমাত্রা থাকবে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তার সঙ্গে এ দিন কয়েকটা ওয়েদার রিপোর্ট দেখাতে শুরু করে, বিকেলে বৃষ্টি। একটা ওয়েদার রিপোর্টে আবার বলছে বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি।

তার পরই স্থানীয় ভারত সমর্থকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে যায়—ভারত টুর্নামেন্টটা আগাগোড়া এত ভাল খেলে বৃষ্টির নাগরদোলায় ফেঁসে যাবে না তো? বৃষ্টি সংক্রান্ত নকআউট আইনগুলো ঝেড়েঝুড়ে বার করা হল। সেই খেলা সম্পূর্ণ হওয়ার জন্য দু’টো টিমের কুড়ি-কুড়ি চল্লিশ ওভার শেষ হওয়া চাই। নইলে ম্যাচ পরের দিন রিপ্লে হবে। সে দিনও খেলা না হলে যারা গ্রুপ লিগ পর্যায়ে বেশি ম্যাচ জিতেছে (ভারত) তারা সেমিফাইনাল চলে যাবে।

বিকেলে ইন্ডিয়ান টিম এল প্র্যাকটিসে। কিন্তু অল্প অল্প বৃষ্টিতে বাইরে নেট করবে কী করে? এমসিজির মধ্যেই কিছুক্ষণ ফুটবলের পর ক্যাচিং প্র্যাকটিস করে ফিরে গেল। ক্যাচিং প্র্যাকটিসের সময় লক্ষ্য করা গেল কোহলি থেকে ধবন সকলের হাতে একটা পাতলা গ্লাভস। সাধারণত ক্যাচিং প্র্যাকটিস দেওয়ার সময় যাকে বলটা ছুড়ে ফেরত পাঠানো হয় সে বেসবল গ্লাভস পরে থাকে। এখানে যাঁরা ক্যাচ নিচ্ছেন, তাঁরাও হলুদ গ্লাভস পরে। লক্ষ্য অবশ্যই আঙুলের যত্ন। যাতে ন্যূনতম চান্স ফ্যাক্টরকেও কমিয়ে আনা যায়।

এ দিন সেন্ট প্যাট্রিক্স ডে ছিল বলে উইকডে হয়েও রেস্তোরাঁ এবং আরও বেশি করে পানশালাগুলো জমজমাট। অস্ট্রেলিয়ায় সেন্ট প্যাট্রিক্স ডে খুব প্রচলিত একটা বার্ষিক উৎসব যে দিন আয়ার্ল্যান্ডের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি সাড়ম্বরে পালিত হয়। আইরিশ পাবে তাই বসার জায়গা নেই এবং পুলিশ চারপাশে সতর্ক— আজ প্রচুর মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাবার ঘটনা ঘটবে। শহরের এই সব উত্তেজনার মধ্যে চ্যানেলের ক্যামেরাম্যান ঠিক কোহলি সহ টিমের দু’তিন জনকে স্পট করে ফেললেন তাঁরা এনএইচ-১০ দেখে ফিরছিলেন। পরে কোহলি তো টুইটও করেন, ‘এখুনি এনএইচ ১০ দেখলাম। স্রেফ উড়ে গিয়েছি। অসাধারণ ফিল্ম, বিশেষ করে আমার প্রেমিকা অনুষ্কা শর্মার পারফরম্যান্স তো অসাধারণ। সো প্রাউড।’ গুজব ছড়িয়েছে অনুষ্কা বুধবার মেলবোর্ন আসতে পারেন। কারণ শোনা যাচ্ছে ভারতীয় বোর্ড সেমিফাইনাল থেকে বউ/বান্ধবীদের এখানে আসার অনুমতি দিয়েছে। অন্যদের নিয়ে তোলপাড় নেই, কিন্তু অনুষ্কার সম্ভাব্য আগমণ নিয়ে এখন থেকেই চ্যানেল ক্যামেরাম্যানদের উত্তেজনা। ক্রিকেট-মিডিয়ার একটা অংশ এমন পাপারাৎজি হয়ে গিয়েছে বলে আরওই শৈত্য এসে যাচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেটার-দেশজ মিডিয়া সম্পর্কে। যখনই একটা মিটমাটের দিকে এগোয়, তখনই একটা রগরগে ব্রেকিং নিউজ চলে আসে। আবার যে কে সেই।

মেলবোর্নে একটা আন্তর্জাতিক ছবি অবশ্য ভারতীয় মিডিয়ার কেউই পায়নি। তা হল টিম হোটেলের অনতিদূরে এলিজাবেথ স্ট্রিটের ওপর বিনা হেলমেটে সাইকেল চালানোর জন্য অস্ট্রেলীয় পুলিশের হাতে এক বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্বের ধরা পড়া। তাঁর নাম আর্নল্ড সোয়ার্ৎজেনেগার। ফর্মুলা ওয়ান দেখার জন্য তিনি মেলবোর্ন এসেছিলেন। কী শখ হয় সাইকেল নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন। জানতেন না এখানে সাইকেলেও হেলমেট বাধ্যতামূলক। পুলিশ তাঁকে আটকানোর পর পরিচয় জেনে স্তম্ভিত হয়ে যায়। বলে এর জন্য ফাইন ১৪৬ ডলার। কিন্তু আপনি বলে নিচ্ছি না। যান এখনই সামনের ৭/১১ দোকানটা থেকে একটা হেলমেট কিনে নিন। সোয়ার্ৎজেনেগার দ্রুত রাজি হয়ে যান।

যেটা বলতে বলতে খেই হারিয়ে ফেলে অন্য দিকে চলে এলাম, ধোনির নেতৃত্বে টিম ইন্ডিয়ার এই জেনারেশন ওয়াই এখন এতটাই পেশাদার যে, ফিটনেস নিয়েও সামান্য শৈথিল্য বরদাস্ত করে না। এমন নয় যে সবাই একেবারে হোস্টেল ছাত্রের মতো রাত দশটার মধ্যে ফিরে-টিরে শুয়ে পড়ে। কিন্তু খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে খুব সতর্ক। প্লেয়ারদের ঘনিষ্ঠ একজনের মুখে শুনছিলাম, ফিটনেসের এই উদাত্ত ডাক দেওয়ার নেতা হলেন বিরাট কোহলি। তিনি নাকি রিচ পঞ্জাবি খাবার প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। ভাত নয়, রুটিও নয়। শুধু গ্রিলড চিকেন আর স্যালাড। তাঁর দেখাদেখি তরুণদের অনেকেরই তাই মেনু। এমনকী নিরামিষাশী রবিচন্দ্রন অশ্বিনও গ্রিলড খাবারে চলে গিয়েছেন। টিমে এক জন বলছিলেন, ভারতীয় সব রেস্তোরাঁ নেমন্তন্ন করে আর ভাবে অতীতে টিমগুলো সব খেতে আসত। এখন কেন আসে না? আরে এখন তো ধোনি-রায়নার মতো দু’চার জনকে বাদ দিয়ে কেউ ইন্ডিয়ান খাবারের রাস্তাই মাড়ায় না। সব সময় ভয় ফ্যাট বেড়ে যেতে পারে।

চলতি বিশ্বকাপ ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন প্রজন্মের ফিটনেসের এ হেন পৌরুষ দেখছে। তাঁদের বিপরীত দলের অধিনায়কের ফিটনেসে আবার ততটাই কন্ট্র্যাডিকশন। অথচ তাতেও তাঁর মাশরফি মর্তুজার ঔজ্জ্বল্য কমছে না। মাশরফির কাহিনি চোট এবং ফিটনেস নিয়ে লড়াইয়ের। সব সময় হয়তো জেতা নয়, কিন্তু ভেসে থাকার। মেলবোর্ন তাঁর কাছে অসীম দুঃখনগরী। মোট সাত বার এই শহরেই হাঁটুতে অস্ত্রোপচার হয়েছে তাঁর। কালকেই বাংলাদেশ অধিনায়ক বলেছেন, “মেলবোর্ন মানেই আমার কাছে রক্তপাত। হতাশায় ডুবে থাকা। অথবা তীব্র কাটাছেঁড়া আর রক্ত। মেলবোর্ন মানে কখনও আমার সুস্থতা নেই। আজ সেই শহরের কাছে আমার প্রার্থনা, জীবনে আমার অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছ। এ বার দাও।”

কোয়ার্টার ফাইনাল হিসেবে সিডনি অনেক উচ্চাঙ্গের। সঙ্গকারা শ্রীলঙ্কা সমর্থকদের মাঠে আসার ডাক দিয়ে ম্যাচটার মেজাজ যেন আরও ভাবগম্ভীর করে দিয়েছেন। বিরানব্বই বিশ্বকাপের সময় এমনই ভারতীয় দর্শকদের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন ইমরান। দক্ষিণ আফ্রিকা— তারাও তো ম্যাচটাকে অবিস্মরণীয় পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রাক্-অনুশীলনের অভিনবত্বে। অন্য বারের মতো তারা আর বেশি প্রস্তুতি নিতে চায় না। সেটা এখানকার অস্ত্রের মতোই ব্যুমেরাং হয়েছে বারবার। এ বার তাই টিম সেশনে হাসি-ঠাট্টা চলল যতটা ক্রিকেট মন থেকে সরিয়ে রেখে চাপ কমানো যায়। যাতে চোকার্স ট্যাগটা বুধবার ব্যাট করার সময় ফের চেপে না বসে।

অস্ট্রেলিয়া তারাও মেতে গিয়েছে পাকিস্তান নিয়ে। অজি সংবাদমাধ্যম পাকিস্তানের জন্য চিন মিউজিক শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যে। মিচেল স্টার্কের গড়, ইকনমি রেট, কার্যকারিতা বারবার তুলে এ বার হাজির অন্য জন। তিনি মিচেল জনসন। নকআউটে ব্যাটসম্যানদের কেমন ভাজবেন তার সবিস্তার পরিকল্পনা দিয়েছেন জনসন। অ্যাডিলেড বা সিডনি নিয়ে বহির্বিশ্বের মিডিয়া উত্তেজনা এমসিজি লড়াইয়ের চেয়ে বেশি।

কিন্তু তাতে কী আসে যায়! প্রতিদ্বন্দ্বী দু’দেশের সমর্থকেরাই তো শুধু একটা অসম্ভব রং চড়ানো কপি। তা ছাড়া কত কিছু নির্ভর করে রয়েছে ম্যাচটার ওপর। স্কোরবোর্ডে তো সব পাওয়া যায় না। একটা জাতি ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবোধে নতুন রক্ত সঞ্চালন করতে চাইছে। আর একটা দেশ তার বিপুল ক্রিকেটপ্রেমী জনসংখ্যা আর প্যাশন নিয়ে উন্মুখ হয়ে বসে রয়েছে সেমিফাইনাল যাওয়ার জন্য।

বৃষ্টির কি কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই! এমন সেটিংয়ে কেউ বিরক্ত করে! না কি করা উচিত!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE