Advertisement
E-Paper

ক্লাবের আগে দেশ, দেখালেন রোনাল্ডো

আন্দ্রে গোমসকে কাল রাতের প্যারিস ফ্যান জোনে কোথাও পাওয়া গেল না। ঐতিহাসিক রবিবারের পর ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণের সফেন জলরাশি চোখে পড়ছে, তার গর্জন কানে আসছে। কেউ বলছেন, মেসি বনাম রোনাল্ডো যুদ্ধ আজ থেকে শেষ। কেউ বলছেন, ছেলেটা এর পর ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ প্লেয়ার হয়ে গেল কি না, ভেবে দেখতে হবে।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৬ ০৩:৫৩
হাতে ট্রফি, উচ্ছ্বসিত রোনাল্ডো। লিসবন বিমানবন্দরে। ছবি: এএফপি

হাতে ট্রফি, উচ্ছ্বসিত রোনাল্ডো। লিসবন বিমানবন্দরে। ছবি: এএফপি

আন্দ্রে গোমসকে কাল রাতের প্যারিস ফ্যান জোনে কোথাও পাওয়া গেল না। ঐতিহাসিক রবিবারের পর ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণের সফেন জলরাশি চোখে পড়ছে, তার গর্জন কানে আসছে। কেউ বলছেন, মেসি বনাম রোনাল্ডো যুদ্ধ আজ থেকে শেষ। কেউ বলছেন, ছেলেটা এর পর ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ প্লেয়ার হয়ে গেল কি না, ভেবে দেখতে হবে। কিন্তু কোথায়, কেউ তো গোমসের কথাটা বললেন না।

পর্তুগাল মৃতপ্রায়। পর্তুগালের আজ আর কিছু নেই। পর্তুগালে চাকরি নেই, জীবন নেই, মর্যাদা নেই। পর্তুগালের শুধু একটা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো আছে!

ইউরো সেমিফাইনালে ওয়েলসকে হারানোর দিন আইফেল টাওয়ার ফ্যান জোনে গল্পোচ্ছলে কথাটা বলেছিলেন গোমস। দু’রাত পরের ক্রিশ্চিয়ানোকে জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখতে-দেখতে তাই গোমসকে মনে পড়ে যাওয়া খুব স্বাভাবিক। রোনাল্ডো তাঁদের জীবনে ভোরের আকাশ, শরতের কাশফুল। স্বপ্নের শেষ সৌধ। আজ তো গোমসদেরই রাত, স্বপ্ন ছোঁয়ার রাত। মজার হল, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো নামটা ব্যাপ্তিতে, প্রভাবে, পর্তুগিজ মননের উপর এতটাই বিস্তৃত যে, একটা আন্দ্রে গোমসকে না পাওয়ার আক্ষেপ পড়ে থাকেও না বেশিক্ষণ। হাজার-হাজার আন্দ্রে গোমস আবির্ভূত হয়ে যান যে!

বেঞ্জামিন যেমন। সিআর সেভেনকে ইউরো ফাইনালের রাতে দু’বার কাঁদতে দেখল ফুটবল-বিশ্ব। এক বার, ম্যাচের চব্বিশ মিনিটে। ইউরো ফাইনালের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাঁকে যখন চিরতরে বেরিয়ে যেতে হল। আট মিনিটে দিমিত্রি পায়েতের ট্যাকলের পরেও প্রাণান্ত চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারেননি। একটা দেশের, একটা সমগ্র জাতির যাবতীয় আশাবাদও তখন ধীরে-ধীরে মাটিতে মিশে যাচ্ছে।

ভাবা যায়নি, এর পরেও ক্রিশ্চিয়ানো আরও এক বার কাঁদবেন। যন্ত্রণায় নয়, আনন্দাশ্রুতে ভিজবে চোখ। ভাবা যায়নি, বেঞ্জামিনকেও দু’বার দু’রকম আবেগে চূর্ণ হয়ে যেতে দেখতে হবে। রোনাল্ডো যখন স্ট্রেচারে শুয়ে টানেলের অভ্যন্তরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন, কৃষ্ণকায় পর্তুগাল সমর্থককে দেখা গেল বিয়ারের গ্লাসে সপাট লাথি মারতে। হাঁটু মুড়ে বসে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়তে। সন্তান অকালে চলে গেলে পিতার যেমন হয়। এডারের গোলটার পর তাঁকে যখন বলতে গেলাম, আপনাকে দেখেছি রোনাল্ডো বেরনোর সময় কাঁদতে, বেঞ্জামিন কথাটা শেষ করতে দিলেন না।

অচেনা, অজানা এক বিদেশি সাংবাদিকের গলা জড়িয়ে আরও এক মর্মস্পর্শী কান্নায় আছড়ে পড়লেন। কথা শোনা যায় না, দোমড়ানো-মোচড়ানো কণ্ঠ থেকে অসংলগ্ন কয়েকটা শব্দ নিঃসৃত হয়, “ওহ গড... রোনাল্ডো... রোনাল্ডো... হি ডিড ইট... প্লিজ ব্লো দ্য হুইসল, প্লিজ...।”

না, রোনাল্ডো আর মাঠে নামেননি। স্ট্র্যাপ বাঁধা হাঁটু নিয়ে তা আর সম্ভব ছিল না। কিন্তু ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো নিজেকে নিঃশেষও হয়ে যেতে দেননি। ততক্ষণে তিনি বার করে এনেছেন আর এক ক্রিশ্চিয়ানো, ক্যাপ্টেন ক্রিশ্চিয়ানো! যিনি স্ট্র্যাপ বাঁধা হাঁটু ভুলে উত্তেজনায় ঢুকে পড়তে চাইছেন মাঠে, যিনি কোচ ফের্নান্দো স্যান্টোসকে হঠিয়ে নিজেই আবির্ভূত হয়েছেন কোচের ভূমিকায় এবং বেঞ্জামিনের মতোই চরম আর্তি নিয়ে রেফারির দিকে বারবার ছুটে যাচ্ছেন ‘ব্লো দ্য হুইসল’-এর দাবিতে!

বহু রাতে লুনো নামের আর এক পর্তুগাল সমর্থক বলছিলেন যে, তাঁর দেশকে কেউ সেরা বলে এত দিন ভাবত না। আলোয়-আলোয় আইফেল টাওয়ার ততক্ষণে পর্তুগালের সবুজ-লালে রাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে সে দিকে তাকিয়ে লুনো বলছিলেন, “পর্তুগাল নিয়ে লোকে বলত, তোমরা কী পারো? আজ থেকে বলতে পারব যে, আমরা লড়তে পারি। মাঠে না থেকেও আমাদের রোনাল্ডো লড়তে পারে। এর উপর ক্যাপ্টেন হয়? পারবে এ জিনিস মেসি?” শুনলে মনে হবে, রোনাল্ডো ইউরো ট্রফিটা শুধু হাতে তুললেন কোথায়? আরও বড় ট্রফি তুলে ফেললেন। না, না। মেসিকে ট্রফি ভাগ্যে ছাপিয়ে যাওয়া নয়। রোনাল্ডো কেঁদে ট্রফি পেয়েছেন, মেসি কেঁদেও পাননি, ঠিক আছে। কিন্তু দেশ বনাম ক্লাবের চিরন্তন যুদ্ধ— সে ময়দানে আজকের পর রোনাল্ডোকে আর হারাবে কে?

অধুনা ফুটবল-বিশ্বে বরাবর বলা হয়, প্লেয়ারদের কাছে এখন ক্লাব আগে, দেশ পরে। ক্লাবগুলোর বিত্তের চাবুকের কাছে এখন মাথা নিচু করতে হয় দেশকে। হাঁটতে হয় আপসের অপমান-সরণি ধরে। ব্রাজিলের সামনেই যেমন শতবার্ষিকী কোপার আগে নেইমার নিয়ে শর্ত রেখেছিল বার্সেলোনা। বলেছিল, হয় কোপায় খেলাও, নইলে রিও অলিম্পিক্সে। দু’টো একসঙ্গে হবে না। বাধ্য ব্রাজিল বেছে নেয় অলিম্পিক্স। নেইমার-হীন টিমের কোপা অভিযানও শেষ হয়ে যায় গ্রুপ পর্বে।

শুধু তাই নয়। এটাও বলা হয় যে, ফুটবলাররা ক্লাবকে যতটা নিংড়ে দেন, দেশের হয়ে আজ অতটা আর দেন না। দেশের জার্সিতে এত টাকা নেই, পেশাদারিত্বের যুগে প্লেয়ারও নাকি তাই সবটুকু আর দেয় না। মেসি নিয়ে অভিযোগটা বারবার উঠেছে। রোনাল্ডোও ব্যতিক্রম ছিলেন না। কিন্তু রবিবারের পর অন্তত সমর্থকদের মনে দেশের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা, ভালবাসা, মমত্বের ট্রফিটা জিতে গেলেন রোনাল্ডো। রুপোর ইউরো ট্রফিকে যে স্নেহে প্রগাঢ় চুম্বন করছিলেন রোনাল্ডো, আজ পর্যন্ত কোনও প্রেমিকাকেও করেছেন কি?

বিলেতের এক কাগজ দেখা গেল, ক্লাব বনাম দেশ যুদ্ধে জয়ী দেশপ্রেমের রোনাল্ডো নিয়ে লেখালিখি করেছে। স্পেনের ‘মার্কা’ লিখেছে, ফাইনালের চোটের জের বিস্তৃত হতে পারে রিয়াল মাদ্রিদের মরসুম শুরু পর্যন্ত। তারা ধরে নিচ্ছে, অগস্টের শুরুতে ইউরোপিয়ান সুপার কাপে খেলা হবে না রিয়াল তারকার। ক্লাবকে উপেক্ষা করে এই বিধ্বংসী দেশপ্রেম— কই, মেসির কেরিয়ারে এমন উদাহরণ তো খুঁজে পাওয়া যায় না!

এক পর্তুগিজ সাংবাদিকদের থেকে শোনা গেল, ফাইনালে দু’টো পেপ-টক দিয়েছেন রোনাল্ডো। প্রথমটা, ফার্স্ট হাফের পর। টিমকে যখন তিনি বলেন দেন, শোনো বন্ধুরা, আমি নেই। কিন্তু তবু আমরা জিতব। স্রেফ নিজেদের ক্ষমতার উপর ভরসা রাখো। আর লড়াই ছেড়ো না। রোনাল্ডো তখনও বেঞ্চে এসে বসেননি। পরেরটা দেন, এডারকে। নব্বই মিনিটের পর। বেঞ্চে তখন আহত সিংহের মতো ঘুরছেন রোনাল্ডো। কোচকে নিষ্ক্রিয় করে টিমের রিমোট নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। অতিরিক্ত সময় শুরুর আগে এডারকে ক্যাপ্টেন ক্রিশ্চিয়ানো বলে দেন, তুমি গোল করছ! আমি জানি, তুমি গোল করছ। এই ম্যাচ তুমিই জেতাবে।

রেফারির সঙ্গে হুইসল বাজানো নিয়ে গরম তর্ক-বিতর্ক ছেড়ে দিন। রাফায়েল মনে করুন। পর্তুগিজ ডিফেন্ডার শেষ দিকে পারছিলেন না আর। চোট লেগেছিল। বেরিয়ে আসতে চাইছিলেন। আচমকা দেখা গেল, কোথা থেকে আবার হাজির রোনাল্ডো, ঠেলছেন রাফায়েলকে। নির্দেশ দিচ্ছেন, যাও মাঠে যাও। খেলে দাও শেষ ক’টা মিনিট। জীবন চলে গেলেও জয়কে আজ হাত থেকে যেতে দিও না।

এর পর কাঁদবে না লোকে? কাঁদতে-কাঁদতে হাসবে না ঝর্ণাধারার মতো? বলবে না, আমাদের কিছু না থাকুক, রোনাল্ডো আছে? পেপে তাঁর অধিনায়ককে কাপ উৎসর্গ করেছেন। বলেছেন, “রোনাল্ডোর জন্যই আমাদের জিততে হত।” পঁচিশ গজের দুর্দান্ত শটে গোল করা এডার বলে ফেলেছেন, “এ রকম ক্যাপ্টেন থাকলে আপনাআপনি চার্জড লাগে।” আর পর্তুগাল সমর্থক বেঞ্জামিন বললেন, ক্রিশ্চিয়ানোর এই এক টুকরো হাসির জন্য বারবার পর্তুগিজ হিসেবে জন্মগ্রহণ করা যায়!

আর ঠিক তখনই ঝাপসা হয়ে আসে সব কিছু। আবেগের স্রোতে ভেসে যায় সব, পেপে-এডার-বেঞ্জামিন-লুনারা একাকার হয়ে যান। যাবতীয় চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্খা একই মোহনায় মিশিয়ে দেশের আকাশে তাঁরা লেখেন একটাই নাম, সৃষ্টি করেন এক অপার্থিব অবয়ব।

লাইনস্ কাট চুল। সিক্স প্যাক্সের পাথুরে শরীর। দেশজ আবেগে ফুটতে থাকা হিংস্র মুখ। আর ভুবনভোলানো ওই আকাশছোঁয়া লাফ।

ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো!

Cristiano Ronaldo Portugal Real Madrid
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy