Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

আফ্রিকার সিংহ শিকার করে ম্যাচের ‘সরকার’ সৌম্য

হাতিবাগান মার্কেটের অলিগলিতে যদি দু’জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়, চিনে বেরোতে পারবেন কি না সন্দেহ। লাজুক, শান্ত, মিষ্টভাষী, বিনয়ী— ভাল ছেলের ব্যাখ্যায় যে যে উপমা ব্যবহার সম্ভব, স্বচ্ছন্দে সেগুলো এঁদের নামের পাশে বসিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

ডি কককে ফিরিয়ে উচ্ছ্বসিত মুস্তাফিজুর। ছবি: এএফপি।

ডি কককে ফিরিয়ে উচ্ছ্বসিত মুস্তাফিজুর। ছবি: এএফপি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৫ ০০:২৭
Share: Save:

হাতিবাগান মার্কেটের অলিগলিতে যদি দু’জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়, চিনে বেরোতে পারবেন কি না সন্দেহ।

লাজুক, শান্ত, মিষ্টভাষী, বিনয়ী— ভাল ছেলের ব্যাখ্যায় যে যে উপমা ব্যবহার সম্ভব, স্বচ্ছন্দে সেগুলো এঁদের নামের পাশে বসিয়ে দেওয়া যেতে পারে। মুস্তাফিজুর রহমানকে দেখলে বিশ্বাস হবে না, তাঁর হাত থেকে ও রকম মারণ-কাটার বেরনো সম্ভব। শান্তশিষ্ট কলেজপড়ুয়া হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য, কিন্তু ক্রিকেট-বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেওয়া বোলার হিসেবে নয়। পেস বোলারের গলায় যে আগুনে ভাষাটা থাকতে দেখা যায়, সেটা শতচেষ্টাতেও খুঁজে পাওয়া কঠিন। সৌম্য সরকার দ্বিতীয় জন। কথাবার্তা এতটা মার্জিত, ব্যবহারে এতটা ভদ্র যে মনে হবে, এ ছেলে তো সাহিত্যের প্রোফেসর হতে পারত! এ ক্রিকেটে কেন?

দৃষ্টির বিচার অধিকাংশেই ভ্রমাত্মক এবং এখানেও তা ব্যতিক্রম নয়। সে তো ইতালির আন্দ্রে পির্লোকে দেখলেও মনে হয়, ইনি ফুটবলে না থেকে সঙ্গীতজগতের কেউ হলে বেশি মানাত। ইংল্যান্ডের অ্যালিস্টার কুককে দেখলে ক্রিকেটারের চেয়ে হলিউডের রোম্যান্টিক নায়কের চরিত্রে বেশি উপযোগী লাগে। মুস্তাফিজুর-সৌম্যরও তাই আফ্রিকার সিংহদের বিস্ফারিত করে ছেড়ে দেওয়ায় অবিশ্বাস্য কিছু নেই।

কিন্তু শুধু বিস্ফারিত করে আফ্রিকার সিংহদের এঁরা ছেড়ে দিলেন বললে, খুব অন্যায় হবে। রবিবাসরীয় মীরপুর আরও একটা দেশের ইতিহাস শুধু দেখল না, দেখল দেশের ক্রিকেট-ভবিষ্যতও ঠিক দিকে এগোচ্ছে। মাশরফি মর্তুজার পরে কে, তামিম ইকবালদের পরে কে, এ দিনের পর থেকে প্রশ্নগুলোর ভিড় আর থাকা উচিত নয়।

পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা— ক্রিকেটের তিন মহাশক্তিকে পর্যদুস্ত করে ছেড়ে দিলেন মাশরফি মর্তুজারা। নির্যাসে ধরলে ওই দু’জন— মুস্তাফিজুর এবং সৌম্য। প্রথম জন স্বমূর্তি ধরে প্রোটিয়া ব্যাটসম্যানদের নাচিয়ে তিনটে উইকেট। দ্বিতীয় জন, ম্যাচ জেতানো অপরাজিত ৮৮। পদ্মাপারের ক্রিকেটকে তাঁরা মনে রাখার মতো দিনই উপহার দিলেন না, চলতি ওয়ান ডে সিরিজের সিংহদরজাও হাট করে দিলেন। সিরিজ এখন সেই স্টেশনে দাঁড়িয়ে যেখান থেকে দু’টো ট্রেন ছাড়তে পারে। একটা, ও পারের গৌরবের। অন্যটা, আফ্রিকার সম্মানের। সিরিজ এখন তো ১-১।

দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথমে ব্যাট করে এ জিন তুলেছিল ১৬২। যাকে মোটেও অঘটন বলা যাবে না। কারণ এর পিছনে একটাই কারণ—বাংলাদেশের দুর্ধর্ষ বোলিং। মুস্তাফিজুর যে বলটায় কুইন্টন ডি’কক আউট হলেন, সেটা কাটার ছিল না। কিন্তু স্বপ্নের ডেলিভারি ছিল। যা ডি’কককে অসহায় করে দিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে গেল। দক্ষিণ আফ্রিকা বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে যখন, দ্বিতীয় ধাক্কাটা দেন মুস্তাফিজুর। জে পি দুমিনিকে তুলে নিয়ে। হাসিম আমলাও ব্যর্থ। এবি ডে’ভিলিয়ার্সের জায়গায় তাঁকে অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁকে তো বল্গাহীন দৌড়ের সুযোগই দিচ্ছে না বাংলাদেশ। এ দিন ২২ রানের বোল্ড। ঘাতকের নাম রুবেল হোসেন। একশো রানেরও কমে এ দিন পাঁচ উইকেট চলে গেল, দেড়শোর আগে সাতটা, বাংলাদেশকে বাঁচাত কে? মুস্তাফিজুর তিনটে, নাসির হোসেন তিনটে, রুবেল দু’টো, মাশরফি একটা— এঁরা মাত্র ১৬২ রানে গুঁড়িয়ে দিলেন বাংলাদেশকে।

কিন্তু তখনও অর্ধেক কাজ সমাপ্ত মাত্র, পুরোটা নয়। বরং উদ্যত দাঁতনখ নিয়ে পূর্ণ উদ্যমে বাংলা ব্যাটিংয়ের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আফ্রিকার বোলিং। তামিম ইকবাল আউট। লিটন দাস আউট। বাংলাদেশ ২৪-২। ওই সময় স্রোতের টানে ভেসে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু তার সামনে দুর্ভেদ্য প্রাচীর হয়ে দাঁড়ালেন সৌম্য সরকার। ৭৯ বলে অপরাজিত ৮৮, তেরোটা বাউন্ডারির সঙ্গে একটা ছক্কা। মাহমুদউল্লাহকে কৃতিত্ব অবশ্যই দিতে হবে। অর্ধশতরানের জন্য শুধু নয়, অন্য দিকটাও তিনি নিশ্ছিদ্র করে দেন। সবচেয়ে বড় কথা, এঁরা দু’জন একদম শেষ পর্যন্ত থেকে জিতিয়ে ফিরলেন। সৌম্যকে তো আউট করাই গেল না। মাহমুদউল্লাহ আউট হলেনঠিকই, কিন্তু তখন বাংলাদেশের জয়কে স্রেফ সময়ের অপেক্ষা দাঁড়াচ্ছে।

ম্যাচ শেষে মাশরফি মর্তুজা বলছিলেন, ‘‘জয়টা খুব দরকার ছিল। আমরা শেষ চারটে ম্যাচ হেরেছি। কিন্তু গত আট মাসে আমরা খুবই ভাল খেলছিলাম।’’ বাংলাদেশ অধিনায়ক যে সম্মানের কারণে জয়টা চাইছিলেন, সেটা তাঁর ও টিমের প্রাপ্য। নভেম্বর ২০১৪ থেকে আজ পর্যন্ত যে ওয়ান ডে ক্রিকেটে জয়ীর তালিকায় এর পর বাংলাদেশ দুইয়ে। একে নিউজিল্যান্ড। তারা জিতেছে উনিশটা। বাংলাদেশ চোদ্দো। মহাশক্তি হয়েও যাদের আগে দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত বা পাকিস্তান নেই।

যদি এটা সামিয়ক সু-সময়ের আশীর্বাদ হয়, আলাদা কথা। কিন্তু এমন মহাসাফল্য যদি এখন থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের পরিচিতি হয়, তা হলে একটা কথা লিখে ফেলা উচিত।

পদ্মাপারের সামনে ক্রিকেট-গৌরবের অনন্ত আকাশ অপেক্ষা করে আছে।

সংক্ষিপ্ত স্কোর: দক্ষিণ আফ্রিকা ৪৬ ওভারে ১৬২ (দু’প্লেসি ৪১, মুস্তাফিজুর ৩-৩৮, নাসের ৩-২৬) বাংলাদেশ ২৭.৪ ওভারে ১৬৭-৩ ( সৌম্য ৮৮ন:আ:, মাহমুদউল্লাহ ৫০)।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE