Advertisement
E-Paper

লোকটাকে দেখেই বুঝেছিলাম মারাত্মক কিছু ঘটতে চলেছে

ঘটনাচক্রে সেই আতঙ্কের স্তাদ দ্য ফ্রঁসের কাছেই শনিবার সকালে পাওয়া গেল তাঁকে। ফরাসি কাগজের এক সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন। তিনি, সেলিম টুরাবালি। পেশায় নিরাপত্তারক্ষী এবং নাম শুনে চেনার কথাও নয়।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৬ ০৩:৫৫
স্টেডিয়ামের বাইরে দাঁড়িয়ে সেই সেলিম টুরাবালি। শনিবার। -নিজস্ব চিত্র

স্টেডিয়ামের বাইরে দাঁড়িয়ে সেই সেলিম টুরাবালি। শনিবার। -নিজস্ব চিত্র

ঘটনাচক্রে সেই আতঙ্কের স্তাদ দ্য ফ্রঁসের কাছেই শনিবার সকালে পাওয়া গেল তাঁকে। ফরাসি কাগজের এক সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন। তিনি, সেলিম টুরাবালি। পেশায় নিরাপত্তারক্ষী এবং নাম শুনে চেনার কথাও নয়। কিন্তু যদি মনে করিয়ে দেওয়া হয় ১৩ নভেম্বর, ২০১৫-র জঙ্গিহানার ফ্রান্স? যদি বলা হয় স্তাদ দ্য ফ্রঁসে সে দিন জার্মানি বনাম ফ্রান্স ম্যাচ একা হাতে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন ইনিই? এক জঙ্গিকে স্টেডিয়ামে ঢুকে পড়া থেকে আটকে দিয়ে?

এবং সেলিম টুরাবালি ১৩ নভেম্বর, ২০১৫ আজও ভোলেননি। ইউরো ফাইনালের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়েও সে দিনের আতঙ্কের স্তাদ দ্য ফ্রঁস তাঁর এখনও মনে পড়ে। ফ্রান্স বনাম পর্তুগাল নিয়ে বলতে গিয়ে ফিরে যান আট মাস আগের ফ্রান্স-জার্মানিতে। ফরাসি কাগজে কাজ করা মরিশাস-জাত ওই সাংবাদিক আনন্দবাজার সাক্ষাত্কারে দোভাষীর কাজটা করে দিলেন।

“...লোকটাকে বোধহয় জীবনে ভুলতে পারব না। স্তাদ দ্য ফ্রঁসে সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে সে দিনই আমার প্রথম দায়িত্ব পড়েছে। বাড়ি থেকে বেরনোর সময় বেশ খুশি ছিলাম। বারবার মনে হচ্ছিল, সেলিম এত বড় একটা দায়িত্ব তুমি পেলে। ভাল করে কাজ তোমাকে করতে হবে। আজ দেশের প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোঁয়া অল্যাঁদ মাঠে থাকবেন। তোমার কাজের মর্যাদাটাই অনেক বেড়ে গেল।

নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে এটাই আমার প্রথম চাকরি নয়। কাজ করতে করতে প্রচুর অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিছু ভাল, কিছু খারাপ। কিন্তু আমি বরাবর একটা দর্শন মেনে চলতাম যে, যা-ই করি না কেন দেখব লোককে যাতে সাহায্য করতে পারি। নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে আমার ধর্ম ছিল, নিয়ম অবশ্যই মানব। কিন্তু লোককে সাহায্যও করব। চেষ্টা করব বন্ধুর মতো মিশে যাওয়ার। সে দিনও সেটা ভেবেই গিয়েছিলাম। মনে আছে, মাঠের পরিবেশও দুর্দান্ত ছিল। একে ফ্রান্স বনাম জার্মানির আন্তর্জাতিক ম্যাচ। লোকে গমগম করছে স্টেডিয়াম। অনুভূতিটাই অন্য রকম হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, দিনটা খুব ভাল যাবে।

ঠিক তখনই লোকটাকে দেখতে পাই।

অন্যান্যদের মতো ওরও টিকিট দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ও দেখাতে পারল না। বলল, ওর কাছে ম্যাচের টিকিট নেই। কিন্তু তবু ও স্টেডিয়ামে ঢুকতে চায়। ভাল ভাবেই বললাম, দেখুন সেটা সম্ভব নয়। টিকিট ছাড়া আপনাকে মাঠে ঢুকতে দিতে পারি না। শুনে পাগলের মতো করতে লাগল। বলতে থাকল, না না আমাকে ঢুকতেই হবে। মাঠে ঢুকতেই হবে। কঠোর ভাবে তাকে বলে দিলাম, বাইরে যান। এখানে থাকবেন না।

আচমকা খবর এল, প্যারিসে কিছু একটা গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। কোনও কোনও জায়গায় নাকি বোমা পড়ছে। স্টেডিয়ামের কাছেও ফেটেছে একটা। প্রথমটায় ঠিক বুঝতে পারিনি, কী হচ্ছে। শুধু এটুকু মগজে ঢুকে গিয়েছিল যে, সব কিছু স্বাভাবিক চলছে না। বুঝতে পারছিলাম, মারাত্মক কিছু একটা ঘটতে চলেছে।

ঠিক তখনই লোকটার দিকে আবার চোখ পড়ল।

তাড়িয়ে দিয়েছিলাম বলে একটু দূরে গিয়ে ও দাঁড়িয়ে ছিল। দেখি, কেমন অদ্ভুত একটা দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে! দেখছে, আমি কী করছি। গা-টা কেমন শিরশির করে উঠল। মনে হচ্ছিল, এ লোক সুবিধের নয়। একে মোটেও সুস্থ মনে হচ্ছে না। নইলে ঢুকতে বারণ করা সত্ত্বেও দাঁড়িয়ে থাকবে কেন? মাথার মধ্যে একটা অ্যালার্ম বাজতে শুরু করল যে, কোনও গণ্ডগোল বাধানোর চেষ্টায় এ দাঁড়িয়ে নেই তো? আমাকে টপকানো সুবিধে হবে না দেখে মিনিট দশেক পর দেখি, অন্য গেট দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করছে।

সিকিউরিটি সিস্টেমে অন্য গার্ডদের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর সেটা যে কত গুরুত্বপূর্ণ, সে দিন বুঝলাম। দ্রুত অন্য গেটের গার্ডকে বলে দিলাম, দেখো একটা লোককে দেখছি টিকিট ছাড়া স্টেডিয়ামে ঢোকার চেষ্টা করছে। মোটেও সুবিধের লাগছে না। কোনও ভাবে যেন ও মাঠে ঢুকতে না পারে।

ও দেখতে পেয়েছিল যে, আমি অন্য গেটের নিরাপত্তারক্ষীকে ব্যাপারটা জানাচ্ছি। বুঝতে পেরেছিল, এ বার কপালে দুঃখ আছে। দেখলাম, সোজা উল্টো দিকে ঘুরে পালিয়ে গেল! আর ফিরে আসেনি।

পরে বুঝতে পেরেছিলাম, কাকে আটকেছি। ফ্রান্সের মিনিস্ট্রি অব সিকিউরিটি থেকে আমাকে পুরস্কৃতও করা হয়। ক্লেরোফন্তেনে গোটা ফরাসি টিম আমাকে আমন্ত্রণ করেছিল। ‘লে কিপ’-এর হয়ে ফ্রান্স ফুটবলার ব্লেইজ মাতুইদি আমার একটা সাক্ষাৎকারও নেয়! মাতুইদি এমনিতেই আমার খুব ভাল বন্ধু। কিন্তু সে দিন যে কথাটা ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় বলেছিল ও, শুনে অসম্ভব ভাল লেগেছিল। মাতুইদি বলল, সেলিম, দেশের নায়ক লে ব্ল্যুজ নয়। নায়ক তুমি। তুমি আসল হিরো। তুমি মাঠে সে দিন জঙ্গি আক্রমণ ঘটতে দাওনি। তুমি না থাকলে লে ব্লুজের কী অবস্থা হত কে জানে।

দেখে ভাল লাগছে যে, সেই মাতুইদিরা রবিবার ইউরো ফাইনাল খেলতে নামবে। মাতুইদি, গোটা ফ্রান্স টিমের জন্য আমার শুভেচ্ছা রইল। আশা করি, আমরা ইউরো কাপটা জিতব। তবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই আমরা এখনই জিতে গিয়েছি। গোটা ফ্রান্সের নিরাপত্তারক্ষীদের টিম দারুণ কাজ করেছে। কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে দেয়নি। রবিবারের নিরাপত্তা নিয়েও সবাই আশ্বস্ত থাকতে পারে। ইউরো কাপে নিরাপত্তার ফ্রান্স কিন্তু হিট।

তবে হ্যাঁ, যদি জিজ্ঞেস করেন ফ্রান্স ইউরো কাপ জিতলে জঙ্গিহানার দগদগে ঘা-টা আমরা ভুলে যাব কী না, তা হলে বলব, না। ভোলা সম্ভব নয়। ফ্রান্স কেন, সন্ত্রাসে গোটা ইউরোপেই এখন এক অবস্থা। ভেবে খারাপ লাগে, ওই আতঙ্ক, ওই ভয় নিয়েই দুনিয়াকে এখন বাঁচতে হবে। কোথাওই নিজেদের সুরক্ষিত আর আমরা ভাবতে পারব না...।”

Security personnel terror attack
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy