Advertisement
০৪ ডিসেম্বর ২০২৪
Rafael Nadal

আদর্শ ব্রাজিলের রোনাল্ডো, তাঁর মতোই হতে চেয়েছিলেন রাফা, হয়েছেন টেনিসের নাদাল!

নাদাল যত বড় চ্যাম্পিয়ন, তার থেকেও বড় যোদ্ধা। খেতাবের থেকে তাঁর চোটের সংখ্যা বেশি। ফেডেরারের মতো সম্পূর্ণ, জোকোভিচের মতো নিখুঁত নন। নাদালের টেনিস অনেকটা চাঁদের মতো। কলঙ্কময়!

picture of Rafael Nadal

রাফায়েল নাদাল। —ফাইল চিত্র।

অভিরূপ দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২৪ ১৫:৫৩
Share: Save:

রজার ফেডেরার, অ্যান্ডি মারের পর রাফায়েল নাদাল। টেনিসকে বিদায় জানালেন ফ্যাব ফোরের আরও এক জন। যিনি তারকা নন, মহাতারকা। নাদাল আসলে টেনিসকে বিদায় জানাননি। জানাতে চাননি। জানাতে বাধ্য হলেন।

আরও কিছু দিন খেলার জন্য মন চাইলেও শরীর সায় দিচ্ছিল না। ধকল নিতে পারছিল না। বছর দুয়েক ধরে বিদ্রোহ করছিল একাধিক চোট। পিঠ, কোমরের পিছনের অংশ, পায়ের পাতা, কব্জি— যন্ত্রণাক্লিষ্ট শরীর আধুনিক টেনিসের অন্যতম সফল ব্যক্তিত্বকে কোর্ট থেকে দূরে সরিয়ে দিল।

নাদালের অবসর ‘পাওয়ার টেনিস’-এর সৌন্দর্য কমাবে নিঃসন্দেহে। বিশ্বের অসংখ্য টেনিসপ্রেমীকে হতাশ করবে। নোভাক জোকোভিচ কোর্টে নেমে চ্যালেঞ্জের অভাব অনুভব করতে পারেন। ফরাসি ওপেনের আয়োজকেরা সফলতম খেলোয়াড়ের অনুপস্থিতিতে বিহ্বল হতে পারেন। অতি নাদাল ভক্ত কেউ টেনিস দেখাই বন্ধ করে দিতে পারেন। তাতে অবশ্য স্পেনের টেনিস ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। পেশাদার টেনিসে দু’দশকের বেশি স্পেনের পতাকা বহন করার পর নাদাল আগেই তা তুলে দিয়েছেন কার্লোস আলকারাজ়ের হাতে। পরবর্তী প্রজন্মের হাতে ব্যাটন তুলে দিয়ে নিশ্চিত হতে পারেন নাদাল। তাতে টেনিস দুনিয়ার ক্ষতিপূরণ সম্ভব নয়।

টেনিস ঈশ্বর নাদালকে সাফল্যে ভরিয়ে দিয়েছেন। কেরিয়ার গোল্ডেন স্ল্যাম দিয়েছেন। যা ফেডেরারকেও দেননি। পাশাপাশি দিয়েছেন একাধিক চোট। টেনিস ঈশ্বর হয়তো নাদালের রাজকীয় বিদায় চাননি। টেনিস জনতাও সেই অর্থে নাদালকে রাজার সম্মান দেয়নি কখনও। ফেডেরারের পর জোকোভিচকে সেরা মনে করেছেন টেনিসপ্রেমীদের একটা বড় অংশ। নাদাল লড়াকু, পরিশ্রমী যোদ্ধার মতো তাঁদের সাম্রাজ্যে থাবা বসিয়েছেন। যে থাবার শক্তি মাঝেমধ্যেই টালমাটাল করে দিয়েছে তাঁদের সাম্রাজ্য।

ফেডেরারের মতো সম্পূর্ণ খেলোয়াড় নন নাদাল। জোকোভিচের মতো নিখুঁত নন। তিনি অনেকটা চাঁদের মতো। গ্রহ নন, উপগ্রহ। তাঁর টেনিসে কলঙ্ক বা খুঁত রয়েছে। আর এটাই নাদালের টেনিসের সৌন্দর্য। বাঁহাতি খেলোয়াড়দের খেলায় একটা স্বাভাবিক সৌন্দর্য থাকেই। নাদাল সেই সৌন্দর্যের সঙ্গে মিশিয়ে ছিলেন এক সূক্ষ কৌণিক দক্ষতা। যা বারে বারে সমস্যায় ফেলেছে ডানহাতি খেলোয়াড়দের।

রক্ষণশীল টেনিস বিশেষজ্ঞদের একাংশ মানের নিরিখে নাদালকে কিছুটা পিছিয়ে রাখেন ফেডেরার বা জোকোভিচের থেকে। তবে তাঁর সাফল্যকে উপেক্ষা করার দুঃসাহস দেখাতে পারেননি কেউ। ২২টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম, অলিম্পিক্স সিঙ্গলস এবং ডাবলসে সোনা, ২০৯ সপ্তাহ বিশ্বের এক নম্বর, টানা ৮১টি ম্যাচ সুরকির কোর্টে অপরাজিত থাকা নাদাল নিঃসন্দেহে বিশ্বের সর্বকালের সেরাদের এক জন। টেনিসজীবনের প্রাপ্তি নিয়ে নাদালের বক্তব্য, ‘‘যা কিছু অর্জন করেছি, তার জন্য জীবনকে ধন্যবাদ দিতে চাই। টাকা দিয়ে কোনওটাই কেনা সম্ভব নয়।’’ আর এক বার তিনি বলেছিলেন, ‘‘সাফল্যের সবচেেয়ে বড় অস্ত্র হল সব সময় খুশি থাকা। যা করবেন, সব সময় সেটা উপভোগ করবেন। মানসিক ভাবে সব সময় তরতাজা থাকতে হবে।’’

ফর্মে থাকা নাদালকে হারানো কঠিন ছিল না। প্রায় অসম্ভব ছিল। খেলা ক্লে কোর্টে হলে তো কথাই নেই। নাদালই শেষ কথা। ১৪টি ফরাসি ওপেন তারই প্রমাণ। রাহুল দ্রাবিড় এক বার সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পর্কে বলেছিলেন, অফ সাইডে প্রথমে ক্রিকেট ঈশ্বর, তার পরেই সৌরভ। ক্লে কোর্টেও বোধহয় টেনিস ঈশ্বরের পরেই নাদাল। বিলি জিন কিং নাদাল সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘‘ইতিহাস লেখার জন্যই নাদালের জন্ম। সুরকির কোর্টে নাদালই চ্যাম্পিয়ন। ওর ধারেকাছে কেউ নেই। অবিশ্বাস্য দক্ষতা।’’

picture of Rafael Nadal

ফরাসি ওপেনে ছিল নাদালের আধিপত্য। —ফাইল চিত্র।

চোট জর্জরিত নাদাল বার বার চেষ্টা করেছেন প্রিয় কোর্টে ফেরার। ফিরেওছেন। তবু সব কিছু গুছিয়ে উঠতে পারেননি। অনুশীলন, ফিটনেস ট্রেনিং খামতি রাখেননি কিছুই। ওপেন যুগে সবচেয়ে কম বয়সে (২৪ বছর) কেরিয়ার স্ল্যাম জয়ী নাদাল থেকে যাচ্ছিলেন অতীতের ছায়া হয়েই। প্রথম খেলোয়াড় হিসাবে এক বছরে তিন ধরনের কোর্টে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতা প্রথম খেলোয়াড় শেষ কয়েকটা বছর নিজের প্রতি সুবিচার করতে পারছিলেন না কিছুতেই।

নাদাল অবসর নিতে পারেন, এই জল্পনা চলছিল বেশ কিছু দিন ধরেই। নাদাল নিজেও ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। তবু বোধহয় কোর্টকে বিদায় জানাতে মন সায় দিচ্ছিল না তাঁর। মাত্র তিন বছর বয়সে হাতে টেনিস র‌্যাকেট তুলে নেওয়া নাদাল হয়তো চাইছিলেন যত দিন সম্ভব টেনিসের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে। অথচ এই নাদালের টেনিস খেলোয়াড় হওয়ার ইচ্ছাই ছিল না। কাকা টোনি নাদাল তাঁকে টেনিসের প্রেমে ফেলেছিলেন। তিনিই তাঁর কোচ। জ্ঞান হওয়া থেকেই নাদাল ছিলেন ফুটবল ভক্ত। তাঁর আর এক কাকা মিগুয়েল নাদাল ছিলেন ফুটবলার। বার্সোলোনার হয়ে খেলেছেন। স্পেনের জাতীয় দলের হয়েও খেলেছেন। ছোট্ট নাদালের লক্ষ্য ছিল ব্রাজিলের রোনাল্ডোর মতো ফুটবলার হওয়া। মিগুয়েল তাঁকে বার্সেলোনার সাজঘরে নিয়ে গিয়ে রোনাল্ডোর সঙ্গে ছবি তুলে দেওয়ার সুযোগও করে দিয়েছিলেন। টেনিসের পাশাপাশি ফুটবলও শিখতেন। আট বছর বয়সেই একটি অনূর্ধ্ব-১২ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। ১১ বছর বয়সে স্পেন এবং ইউরোপের অনূর্ধ্ব-১২ চ্যাম্পিয়ন। এর পর বাবা তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘ফুটবল এবং টেনিসের মধ্যে থেকে একটি বেছে নিতে হবে। না হলে দুটোই ছেড়ে দিতে হবে।’’ নাদাল বেছে নিয়েছিলেন টেনিস।

স্পেনকে পাঁচ বার ডেভিস কাপ দেওয়া নাদাল পেশাদার টেনিসে প্রথম ডাবলস খেলেছিলেন ভারতের মাটিতে। ২০০৪ সালে চেন্নাই ওপেনে। ভারতের একমাত্র এটিপি প্রতিযোগিতায় সিঙ্গলস খেতাব জেতা হয়নি তাঁর। দু’বার ফাইনালে উঠেও ট্রফি জিততে পারেননি। সেই আফসোস বয়ে বেড়িয়েছেন বহু দিন। পরে ইচ্ছা থাকলেও চেন্নাই ওপেন খেলার সুযোগ (ক্রমতালিকার নিয়মে) ছিল না তাঁর।

নাদাল কতটা দক্ষ খেলোয়াড়? একটা গবেষণার কথা বলা যেতে পারে উদাহরণ হিসাবে। আমেরিকার টেনিস গবেষক জন ইয়ানডেল উচ্চ ক্ষমতার ক্যামেরা এবং বিশেষ সফ্‌টঅয়্যারের মাধ্যমে একটি গবেষণা করেছিলেন। দেখতে চেয়েছিলেন এক জন খেলোয়াড়ের ফোরহ্যান্ড প্রতিপক্ষের কাছে পৌঁছনো পর্যন্ত টেনিস বল কত বার স্পিন করে বা ঘোরে। পিট সাম্প্রাস এবং আন্দ্রে আগাসির ক্ষেত্রে সেই সংখ্যা ছিল মিনিটে ১৮০০ থেকে ১৯০০ বার। ফেডেরারের ক্ষেত্রে মিনিটে ২৭০০ বার। আর নাদালের সর্বোচ্চ ৪৯০০ বার। গড়ে ৩২০০ বার।

নাদালের টেনিসের সবচেয়ে দুর্বলতা হিসাবে ধরা হয় তাঁর সার্ভিসকে। প্রথম দিকে যথেষ্ট ভুগতে হয়েছে তাঁকে এ জন্য। পরে অবশ্য অনেক উন্নতি করেন। এ নিয়ে নাদাল এক বার বলেছিলেন, ‘‘কেউ নিখুঁত নয়। সবাই কিছু না কিছু বোকার মতো কাজ করে। ভুল করে।’’

পরাজয় কখনও হতাশ করেনি নাদালকে। প্রতিটি ম্যাচ থেকে শেখার চেষ্টা করতেন তিনি। এ নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘‘হারকে ভয় পাই না। পরাজয় আমার শত্রু নয়। সব সময় নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করি। না হারলে কখনও জয়কে উপভোগ করা যায় না। সেটার জন্যই হারা প্রয়োজন। প্রতি দিন খেলোয়াড় এবং মানুষ হিসাবে উন্নত হওয়ার চেষ্টা করি।’’ ব্যর্থতা কখনও নাদালের আত্মবিশ্বাস কমাতে পারেনি। সব সময় নিজেকে সেরা মনে করে কোর্টে নামতেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমিই বিশ্বের একমাত্র খেলোয়াড়, যে আমাকে হারাতে পারে।’’ নাদাল বিশ্বাস করতেন প্রতিপক্ষের কাছে হারেননি। হেরেছেন নিজের ভুলের জন্য। নিজে খেলতে না পারার জন্য। কখনও অজুহাত খোঁজেননি ব্যর্থতাকে ঢাকার জন্য। সত্যিই তো নাদাল নিজের মতো করে খেলতে পারলে তাঁকে হারাবে কে? তাঁর সেরা দিনে সবাইকেই তাঁর সামনে সাধারণ মনে হয়েছে। সে ফেডেরার হোন বা জোকোভিচ। ফেডেরারের মতে, নাদালই প্রতিপক্ষ হিসাবে কঠিনতম। অবসর নেওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, ‘‘নাদালই আমাকে সবচেয়ে বেশি সমস্যা ফেলেছে। ওর টপ স্পিন সামলানো প্রচণ্ড কঠিন। সেটা আরও ভয়ঙ্কর করে তোলে বাঁ হাতে খেলা। নাদালের বিরুদ্ধে যারা খেলেছে, এটা শুধু তারাই বুঝতে পারবে।’’ জোকোভিচ বলেছেন, ‘‘ফেডেরার আর নাদালই আমাকে জোকোভিচ হতে সাহায্য করেছে। নাদাল তো আমার জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছে। ১৫ বছর ধরে শুধু ওকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। ওর কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’’

সমুদ্র বড় প্রিয় নাদালের। সমুদ্রের বিশালত্ব, গভীরতা তাঁকে আকর্ষণ করে। নিজের জীবনকে সমুদ্রের মতো করতে চেয়েছেন সব সময়। টেনিসের মহাসাগর হতে চেয়েছেন প্রতি মুহূর্তে। যে টেনিসে গভীরতা থাকবে। ব্যাপ্তি থাকবে। বৈচিত্র থাকবে। বিপদ থাকবে। আবার টাটকা বাতাস, সতেজতা থাকবে।

(বাঁ দিকে) রাফায়েল নাদাল এবং রজার ফেডেরার।

(বাঁ দিকে) রাফায়েল নাদাল এবং রজার ফেডেরার। —ফাইল চিত্র।

নাদাল বলতেন, ‘‘আমি জেতার জন্য খেলি। প্রতিটা পয়েন্টের জন্য খেলি। আমার সাফল্য কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।’’ রড লেভার এক বার নাদাল সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘‘নাদালকে খেলতে দেখা আমার জীবনের সৌভাগ্য। অন্য গ্রহে পৌঁছে দেয় সকলকে। চ্যাম্পিয়ন অনেকে। কিন্তু নাদাল এক জনই।’’ ঠিকই বলেছেন লেভার। নাদাল এক জনই। যাঁকে দেখে আরও ভাল খেলার রোখ চাপে জোকোভিচের মধ্যে। যাঁকে আদর্শ করে উঠে আসেন আলকারাজের মতো খেলোয়াড়। আলকারাজ বলেছেন, ‘‘নাদাল অতি সাধারণ। অতি সুন্দর। অতি ভয়ঙ্কর।’’

নাদালহীন আধুনিক টেনিস অনেকটা কলঙ্কহীন চাঁদ। যে চাঁদের সব থাকবে। শুধু কলঙ্ক থাকবে না! পেশাদার টেনিসে একঝাঁক তরুণ প্রতিভা উঠে এসেছেন। নাদালের মতো কেউ নন। নাদাল যত বড় চ্যাম্পিয়ন, তার থেকেও বড় যোদ্ধা। তাঁর সাফল্যের থেকেও বেশি তাঁর অনুপ্রেরণা। খেতাবের সংখ্যার থেকেও বেশি তাঁর চোটের সংখ্যা। তিনি পেশাদার এবং অপেশাদার (অলিম্পিক্স, ডেভিস কাপ) টেনিসে সমান সফল, আন্তরিক এবং প্রত্যয়ী।

তাঁর অবসর নিঃসন্দেহে টেনিসকে দরিদ্র করবে। তবে সমৃদ্ধ করতে পারে ফুটবলকে। সেই ছোট বয়সের ভালবাসা এখনও অটুট। প্রাক্তন হয়ে যাওয়া নাদাল পা রাখতে পারেন ফুটবলের দুনিয়ায়। রিয়াল মাদ্রিদের বাস যে তাঁর হৃদয়ে। টেনিস খেলোয়াড় হিসাবে বিশ্ব জয় করা নাদালের লক্ষ্য, কর্তা হিসাবে ফুটবল দুনিয়ায় রাজ করা। তাঁর টেনিস অ্যাকাডেমি থাকছেই। যেখান থেকে উঠে আসবেন আরও আলকারাজ বা ক্যাসপার রুডেরা। নাদালের ছায়া এড়াতে পারবেন না টেনিস ঈশ্বরও।

অন্য বিষয়গুলি:

Rafael Nadal Tennis retirement Spain
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy