Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
নানা রঙের যুবভারতী

স্পেনের ট্রেনিং ও তারকা বর্জনে বাজিমাত

বহু দিন ধরে আমি এই টুর্নামেন্টটার অপেক্ষায় বসেছিলাম। যে দিন প্রথম শুনলাম আইএসএল বলে একটা টুর্নামেন্ট হবে ভারতে, যেখানে বিশ্ব ফুটবলের প্রাক্তন মহাতারকাদের সঙ্গে খেলবে আমাদের ছেলেরা, মনে হয়েছিল আইএসএল ভারতীয় ফুটবলের অবস্থানটাই না পুরো পাল্টে দেয়! রবিবারের যুবভারতী যে ফুটবল দিল নব্বই মিনিট ধরে, তাতে সে দিন ভুল ভেবেছিলাম বলে মনে হচ্ছে না।

প্রথম গোল ফিকরুর। ছবি: উত্‌পল সরকার

প্রথম গোল ফিকরুর। ছবি: উত্‌পল সরকার

চুনী গোস্বামী
শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৪ ০২:৫৯
Share: Save:

আটলেটিকো দে কলকাতা-৩ (ফিকরু, বোরহা, আর্নাল)
মুম্বই সিটি এফসি-০

বহু দিন ধরে আমি এই টুর্নামেন্টটার অপেক্ষায় বসেছিলাম। যে দিন প্রথম শুনলাম আইএসএল বলে একটা টুর্নামেন্ট হবে ভারতে, যেখানে বিশ্ব ফুটবলের প্রাক্তন মহাতারকাদের সঙ্গে খেলবে আমাদের ছেলেরা, মনে হয়েছিল আইএসএল ভারতীয় ফুটবলের অবস্থানটাই না পুরো পাল্টে দেয়! রবিবারের যুবভারতী যে ফুটবল দিল নব্বই মিনিট ধরে, তাতে সে দিন ভুল ভেবেছিলাম বলে মনে হচ্ছে না।

ফুটবলের প্রথম বিশ্বের একটা দেশে এক মাসের ক্যাম্প, একজন ভাল কোচের হাতে দিনের পর দিন ট্রেনিং, মহাতারকাদের পিছনে না ছুটে টিম কনসেপ্টে যাওয়া কতটা মারাত্মক করে দিতে পারে একটা টিমকে তার জলজ্যান্ত প্রমাণ রবিবারের আটলেটিকো দে কলকাতা। ফুটবলে মহাতারকা থাকলেই আপনার টিম দুর্ধর্ষ হয়ে যাবে, এমন নয়। বরং যদি টিমে সাত-আট জন একই মানের ফুটবলার রাখা যায়, যারা অসাধারণ না হলেও ‘খুব ভাল’ পর্যায়ের, লাভ বেশি। কারণ তাতে এক জন আটকে গেলেও বাকি ছ’সাত জন থাকবে যারা ম্যাচটা বার করে দেবে। টিমকে জিতিয়ে ফিরবে। টিমে শুধুই মহাতারকা রাখলে তাদের আটকালেই তো কাজ শেষ।

আটলেটিকো দে কলকাতা কিন্তু এই জায়গায় ভাল রকম ঝামেলায় ফেলতে চলেছে বাকি ফ্র্যাঞ্চাইজিদের। এটা ঠিক আমাদের একটা আলেসান্দ্রো দেল পিয়েরো নেই, রবার্ট পিরেস নেই। নিকোলাস আনেলকাও নেই। কিন্তু বোরহা ফার্নান্দেজ-ফিকরু-গার্সিয়ার মতো প্লেয়াররা আছে যারা একই মানের। অসাধারণ না হলেও যারা ‘খুব ভাল’ ফুটবলারদের গোত্রে পড়বে। যাদের এক জন না পারলে, আর এক জন দায়িত্বটা নিয়ে নেবে। তবে অবাক করার ব্যাপার হল, আটলেটিকোর ভারতীয়দের দেখেও ওই একই মানের মনে হচ্ছে! বিশ্বজিত্‌ সাহা, অর্ণব মণ্ডল, বলজিত্‌ সাইনি ওদের দেখে মনে হল না ফুটবলের তৃতীয় বিশ্বের বাসিন্দা। দিব্যি বোরহা-ফিকরুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে খেলে গেল, এক বারের জন্যও বেমানান মনে হল না। শুভাশিস রায়চৌধুরী আর এক জন। আটলেটিকোর গোলের নীচে যে পরের পর সেভগুলো ও করল, সেগুলো আন্তর্জাতিক ফুটবলে দেখা যায়!

এতটুকু বাড়িয়ে বলছি না। যা দেখেছি, বলছি। আর বলতে গিয়ে মনে হচ্ছে, গোটা আটলেটিকো টিম এই ফুটবল কলকাতাকে দিতে পারত না, যদি না স্পেনে গিয়ে এক মাস পড়ে থাকত। বিভিন্ন দেশের ফুটবলারদের নিয়ে টিম তো তৈরি হয়েছে ওখানেই।

ম্যাচ শুরুর প্রথম থেকে মনে হচ্ছিল, আন্তোনিও হাবাসের টিম, ওয়েল ট্রেন্ড টিম। প্রত্যেকে জানে বাকি দশ জন কী চাইছে, বা কী করবে। প্লেয়ারদের মধ্যে বোঝাপড়া শুধু নয়, ম্যাচের প্রথম থেকে শেষ খুব ভাল স্ট্যান্ডার্ডের ফুটবল খেলে গেল টিমটা। আর সেটা এমনই মানের, যা আমাদের ময়দান এত দিন ভাবতে পারেনি। তাতে খুব দোষ দেওয়াও যায় না। এত দিন তো আইএসএল বলে কোনও টুর্নামেন্টও ভারতে আসেনি।

লিগ কর্তারা বুঝতে পেরেছিলেন, ভারতে একটা ঘুমন্ত ফুটবল-সাম্রাজ্য পড়ে আছে যেখানে বিদেশ থেকে সদ্য অবসর নেওয়া ভাল প্লেয়ার আনলে, ভারতীয় ফুটবলকেও তুলে আনা যাবে। টার্গেটটা ছিল তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বছরের বিদেশি ফুটবলার যারা খুব বেশি দিন আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নেয়নি, ফুটবল থেকে যারা একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। আটলেটিকো তার সঙ্গে আরও একটা কনসেপ্ট জুড়েছে। ভাল বিদেশি শুধু নয়, একই মানের বিদেশি আনা। যাদের এক মাস স্পেনে রেখে ট্রেনিং করিয়ে মুম্বইকে স্রেফ উড়িয়ে দেওয়া হল।

মুম্বইয়ে আজ আনেলকা খেলেনি। লিউনবার্গ খেলেনি। কিন্তু খেললেও আটলেটিকোকে হারাতে পারত বলে মনে হয় না। কারণ, ফুটবল ম্যাচ জিততে গেলে আপনার যেমন হাতে ভাল ফরোয়ার্ড লাইন থাকা দরকার, তেমন প্রয়োজন ভাল ডিপ ডিফেন্সের। কলকাতার যেটা ছিল। টিমটার ফরোয়ার্ড লাইন, মাঝমাঠ ছেড়ে দিলাম, ডিপ ডিফেন্সও এত ভাল যে মুম্বই খুব বেশি কিছু করে উঠতে পারেনি নব্বই মিনিটে। তিনটে গোল হল। আরও একটা হতে পারত বলজিত্‌ সাইনি হেডটা ঠিকঠাক রাখলে। ওই গোলটা করা উচিত ছিল বলজিতের। মাঝে একটা কুড়ি মিনিটের স্পেলে মুম্বই চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কলকাতার কিপার শুভাশিস অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠায় সেটাও সম্ভব হয়নি। বরং অতি-আক্রমণে উঠতে গিয়ে আরও দু’টো গোল খেয়ে গেল মুম্বই।

আরও একটা ব্যাপার। লুই গার্সিয়ার নাম শুনছিলাম এত দিন। রবিবার বোরহা বা ফিকরুর যে খেলাটা দেখলাম তাতে গার্সিয়ার চেয়ে কোনও অংশে কম মনে হল না ওদের। কেন জানি না আজ গার্সিয়ার খেলা অত ভাল লাগেনি। উপরে ফিকরু মাঝেমধ্যেই একা পড়ে যাচ্ছিল, অনেক সময় ওকেই গোলের সুযোগ তৈরি করতে হচ্ছিল। গার্সিয়া আজ যা খেলেছে, তার চেয়ে ও অনেক বড় গেমমেকার। আগামী দিনে সেটা ও প্রমাণ করেও ছাড়বে। বরং মুগ্ধ হলাম আমি ফিকরুর খেলা দেখে। ছেলেটা নাগাড়ে বিপক্ষের পেনিট্রেটিভ জোনে ঘুরঘুর করে, গোল করার একটা সহজাত ইন্সটিংক্ট ওর মধ্যে কাজ করে। এ দিন একটা গোল নিজে করল, আর একটা দুর্দান্ত ভাবে করাল। বোরহার গোলটাও অসাধারণ। লা লিগা বা ইপিএলে ওই রকম গোল হয়। তা ছাড়া মাঝমাঠটা একা কন্ট্রোল করে বোরহা। যা বুঝছি, ফিকরু-সাইনি-বোরহারা সামনের আড়াই মাসে কিন্তু ভাল জ্বালাবে বাকি ফ্র্যাঞ্চাইজির ডিফেন্সকে।

মুম্বই পারেনি, পারার কথাও ছিল না। পরের ম্যাচ নর্থ-ইস্ট ইউনাইটেডের সঙ্গে, ওরাও কতটা কী করবে সন্দেহ। শুধু ওরা কেন, সন্দেহ আছে বাকিরাও কতটা ঝামেলায় ফেলতে পারবে আটলেটিকো দে কলকাতাকে।

ভুল হল। টিম আটলেটিকো দে কলকাতাকে!

আটলেটিকো দে কলকাতা: শুভাশিস, ডেঞ্জিল, হোসে রে, অর্ণব, বিশ্বজিত্‌, বোরহা, লুই গার্সিয়া (আর্নাল), হোফ্রে (পদানি), নাটো, বলজিত্‌ (সঞ্জু), ফিকরু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE