Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
সাকিবের দাপটে স্মিথদের হারিয়ে ইতিহাস বাংলাদেশের

অস্ট্রেলিয়া বলেই শুধু জয় নয়, জবাবও

বুধবার বাংলাদেশে ভোরের সূর্য উঠেছে জয়ের বার্তা নিয়ে। দেশ জুড়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টেস্ট জয়ের আবাহন। কিছুদিন আগে হলেও কি এমন বলা যেত! মনে হয় না।

আশীর্বাদ: জয়ের পরে ড্রেসিংরুমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভিনন্দন সাকিবকে। ছবি: টুইটার।

আশীর্বাদ: জয়ের পরে ড্রেসিংরুমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভিনন্দন সাকিবকে। ছবি: টুইটার।

উৎপল শুভ্র
ঢাকা শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৭ ০৩:২৪
Share: Save:

শত ব্যস্ততা পাশে সরিয়ে রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে জয়োৎসবে শামিল হতে মিরপুর স্টেডিয়ামে ছুটে এলেন, এতে বাইরের পৃথিবী বিস্মিত হতে পারে, তবে বাংলাদেশের আম জনতার কাছে এটা মোটেই অভূতপূর্ব কিছু নয়। শেখ হাসিনার ক্রীড়াপ্রেম যে সর্বজনবিদিত। বিশেষ করে ক্রিকেটের প্রতি। বাংলাদেশ স্মরণীয় কোনো জয়ের সুবাস পেতে থাকলেই তিনি ঠিক হাজির হয়ে যান স্টেডিয়ামে। এ দিনও এলেন।

বুধবার বাংলাদেশে ভোরের সূর্য উঠেছে জয়ের বার্তা নিয়ে। দেশ জুড়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টেস্ট জয়ের আবাহন। কিছুদিন আগে হলেও কি এমন বলা যেত! মনে হয় না। টেস্টের চতুর্থ দিনে অস্ট্রেলিয়ার জিততে দরকার ছিল ১৫৬ রান। বাংলাদেশের ৮ উইকেট। বছর দুয়েক আগে হলেও বলে দেওয়া যেত, মিরপুরে নির্ঘাত লেখা হতে চলেছে স্বপ্নভঙ্গের আর এক গল্প। বাংলাদেশ আশা জাগিয়েও পারবে না। কারণ বাংলাদেশ পারে না।

কিন্তু এই বাংলাদেশ যে অন্য বাংলাদেশ! যারা শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের আগেই ২–০–তে জেতার ঘোষণা করে দেয়। বিশ্ব ক্রিকেটের মহাশক্তিদের চোখে চোখ রেখে ছিনিয়ে আনতে জানে জয়। গত অক্টোবরে ইংল্যান্ড এর প্রমাণ পেয়েছে। ঠিক আগের টেস্টেই শ্রীলঙ্কা। এ বার পেল অস্ট্রেলিয়াও। বদলটা কোথায় হয়েছে? বিশ্বাসে মেলায় বস্তু কথাটা তো শুনেছেনই। আগে এই বিশ্বাসটাই ছিল না।

একটা সময় ছিল, বাংলাদেশের জন্য টেস্ট ক্রিকেট ছিল এক বিড়ম্বনার নাম। জয়–পরাজয়ের মতো ‘তুচ্ছ’ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানো ছিল বিলাসিতা। টেস্ট ক’দিন টেনে নেওয়া যায়, এটাই থাকত গেম প্ল্যানের বড় একটা অংশ জুড়ে।

আরও পড়ুন: ইউএস ওপেনের প্রথম রাউন্ডে রুদ্ধশ্বাস জয় ফেডেরারের

সেই চিন্তা থেকে সরে আসার শুরু গত অক্টোবরে ইংল্যান্ড সিরিজ থেকে। নিজেদের শক্তি আর প্রতিপক্ষের দুর্বলতার কথা ভেবে রণকৌশল ঠিক করার সাহসও। টার্নিং উইকেট বানিয়ে তিন স্পিনারকে কাজে লাগিয়ে দাও। জিতলে জিতব, হারলে হারব। মান বাঁচানোর খেলা অনেক হয়েছে।

টার্নিং উইকেট আর তিন স্পিনার ফর্মুলার কথা শুনে আপনার কি কিছু মনে পড়ছে? মনে পড়ছে গত শতাব্দীর নয়ের দশকে অজিত ওয়াড়েকর ও মহম্মদ আজহারউদ্দিনের ভারতের কথা? কাকতালীয়ভাবে দুই যুগ আগে যা শুরু ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ দিয়েই। আরও নির্দিষ্ট করে বললে কলকাতার ইডেনেই।

পদ্মার এ পারেও সেই ফর্মুলায় শুরুতেই সাফল্য। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশ এক টেস্ট হারল, এক টেস্ট জিতল। একটু এদিক–ওদিক হলে জিততে পারত দু’টোই। স্টিভ স্মিথদের জন্য তাই আর নতুন রেসিপি খোঁজার প্রয়োজন পড়েনি। তাতে মিরপুরে এমন মুখরোচক খাবার (পড়ুন ‘জয়’) তৈরি হওয়ার পর তিন দিন বাদে চট্টগ্রামে শুরু দ্বিতীয় টেস্টের উইকেট কেমন হবে, দিব্যচোখে এখনই তা দেখা যাচ্ছে।

তাতে বাংলাদেশ যদি হেরেও যায়, বড়জোর সিরিজ ড্র হবে। সিরিজ হারের ভয় তো জয় করা হয়ে গেল মিরপুরেই। সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টের আগে বাংলাদেশ ২–০ ভাবছে, আর অস্ট্রেলিয়া সিরিজে হার বাঁচানোর চিন্তায় চাপে— এই কিছুদিন আগেও শুধু কল্পকাহিনিতেই এমন চিত্রনাট্যের দেখা মিলত।

ক্রিকেটের জনক বলে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম জয় অন্য দেশগুলোর জন্য চিরকালই ‘বিশেষ’ বলে বিবেচিত হয়ে এসেছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটেও এটি আলাদা হয়েই থাকবে। গত মার্চে নিজেদের শততম টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়টাও। শ্রীলঙ্কার মাটিতে শ্রীলঙ্কাকে হারানো যে তখনও এমন ‘হেলায় লঙ্কা জয়’–এর পর্যায়ে যায়নি। এ সব মনে রেখেও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়টা দেখা দিচ্ছে অন্যরকম এক মহিমায়।

দলটা অস্ট্রেলিয়া, সেটা তো অবশ্যই একটা কারণ। তার চেয়েও বড় কারণ, এই অস্ট্রেলিয়ার কাছ থেকেই সবচেয়ে বড় অবহেলা পেয়ে এসেছে বাংলাদেশ। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার ১৭তম বছর চলছে, অথচ অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের এটি মাত্র পঞ্চম টেস্ট। টেস্ট খেলিয়ে বাকি কোনও দেশ যেখানে তিনবারের কম বাংলাদেশ সফরে আসেনি, সেখানে অস্ট্রেলিয়া এল দ্বিতীয়বার। সেটিও টালবাহানার নানা কাহিনি শেষে দীর্ঘ ১১ বছর পর।

কাদের হাত ধরে এই জয়, তা তো জেনেই গেছেন। এটাও হয়তো জানেন, বাংলাদেশের দুই ক্রিকেটারের জন্য টেস্টটি ছিল বিশেষ কিছু। সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবাল দুজনেরই এটি ৫০তম টেস্ট। এমনিতে ৫০ টেস্ট এমন কোনও ব্যাপারই নয়, কিন্তু বাংলাদেশে যে মাত্র তিনজনই তা খেলেছেন তাঁদের আগে। সাকিব–তামিমের ৫০তম টেস্ট নিয়ে এই বঙ্গে তাই অভূতপূর্ব হইচই। সেই উপলক্ষটা আরও উজ্জ্বল করে তোলার কাজটাও তাঁরা নিজেরাই করলেন। বাংলাদেশের দুই ইনিংসেই সর্বোচ্চ রান তামিমের, ব্যাটে–বলে আলো ছড়িয়ে সাকিব দেশকে এনে দিলেন ঐতিহাসিক টেস্ট জয়।

রূপকথা তো এমনই হয়!

(লেখক বাংলাদেশের নামী দৈনিক ‘প্রথম আলো’-র ক্রীড়া সম্পাদক।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE