আইফেল টাওয়ারের উপর থেকে ফ্যান জোন। ফ্রান্স-আইসল্যান্ড ম্যাচ চলাকালীন।
সিগারেটের দোকানকে প্যারিসে বলে ‘তাবাক’। কলকাতার মতো যথেচ্ছ খুপরি ঘর খুলে এখানে কেউ বসে না। দোকানগুলো বেশ বড়সড়। মোড় পিছু একটা। দোকানের এক দিকে পরপর বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেট। অন্য দিকে ‘বার অ্যান্ড স্ন্যাকস’। বিটোভেন রোডে এ রকম ‘তাবাক’ অন্তত পাঁচটা। শ্যালিটনের মতো শহরতলিতেও তিন-চারটে দেখা গেল।
প্লেতো দে ভঁ মেট্রো স্টেশনের পাঁচ মিটারের মধ্যে যেটা, তার মালিক ফ্রয়েদ ফুটবল-প্রেমে বিশেষ অন্ধ নন। বছর পঁয়তাল্লিশের ফরাসি ভদ্রলোক ফুটবল দেখেন বিশ্বকাপের সময়, বা ইউরো কাপ হলে। তাঁর প্রথম ভালবাসা বক্সিং।
তা এই তাবাক-মালিকের স্তাদ দে ফ্রাঁসে আইসল্যান্ডের উপর জিরুঁ-গ্রিজম্যানদের ‘জঙ্গিহানা’ ভাল লাগেনি। বরং বন্ধুবান্ধবদের কয়েকটা মেসেজ করে বসেছেন।
‘এত ছোট্ট দেশটার উপর মহম্মদ আলির মতো চড়াও হওয়ার কোনও দরকার ছিল?’
‘আইসল্যান্ডকে দেখে খুব খারাপ লাগছে। পাঁচ গোলের অপমান ওদের প্রাপ্য নয়।’
‘শক্তি দেখাতে হলে জার্মানির বিরুদ্ধে দেখাও। এই ম্যাচটা তো কুড়ি মিনিটেই জিতে গিয়েছিলাম।’
ইউরো থেকে বরফ-রূপকথা বিদায়ের কয়েক ঘণ্টা পরেও ফ্রয়েদ মনখারাপ থেকে পুরোপুরি বেরোতে পারেননি। অথচ ফ্রান্স জিতেছে, ষোলো বছর পর ইউরো-যুদ্ধের সেমিফাইনালে উঠেছে, প্রতিপক্ষকে পাঁচ গোল দিয়েছে। ফরাসি জনতার তো উচিত এর পর দুর্নিবার আনন্দস্রোতে ভেসে যাওয়া। বেঞ্জিমা-বিতর্কে যে দিদিয়ের দেশঁর বাড়ির দেওয়ালে ‘বিশ্বাসঘাতক’ লিখে দেওয়া হয়েছিল, সেই একই দেশঁ আজ এক যুগ পর দেশের ইউরো কোয়ার্টার ফাইনাল অভিশাপ কাটালেন। জিনেদিন জিদানদের টিম ইউরো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ষোলো বছর যে নিষ্ফলা থেকে গিয়েছে ফরাসি ফুটবল-শস্যখেত। কখনও গ্রুপ থেকে বিদায়। কখনও আর একটু বেশি, কোয়ার্টার ফাইনাল।
গত এক যুগের সেই দুঃখের বেদীতে দাঁড়িয়ে জিরুঁ আর পোগবা কুড়ি মিনিটের মধ্যে দু’টো সুখের গোল করলেন। এই ইউরোয় এখন পর্যন্ত চারটে গোল করা আঁতোয়া গ্রিজম্যান ইউরোর লোভনীয় ‘গোল্ডেন বল’-এর দিকে উসেইন বোল্টের মতো দৌড় শুরু করে দিলেন। ইউরো ২০১৬ তেইশ দিনে পড়া পর্যন্ত একটাও গোল ছিল না পল পোগবার। রবিবার তা-ও হল। ফ্রান্স এর চেয়ে বেশি কী চাইতে পারে? আর কত আশা করতে পারে?
কাল রাতেও তো দেখছিলাম। টিম জিতলে ফরাসি সমর্থনের একটা চেনা ‘টেমপ্লেট’ হল রাস্তার গাড়িঘোড়ার উপর অত্যাচার। সে দৃশ্য বড় মজার। ধরা যাক, ফ্রান্স জেতার পর সমর্থকদের ঝাঁককে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আসতে দেখে কোনও বাইক-আরোহী পাশ কাটিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করছে। জনতা খেয়াল না করলে ঠিক আছে, সে বেঁচে যাবে। কিন্তু চোখে পড়ে গেলে বাধ্য ছেলের মতো দাঁড়িয়ে পড়াটাই বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। গ্রুপ সেলফি তুলে, তুমুল ফুর্তিতে মাথায়-ঘাড়ে গোটা কয়েক চাপড় মেরে ছেড়ে দেবে তাকে। যদিও ফ্রান্সে দিন দশেক কাটানোর উপলব্ধি বলে, বাইক নয় ফরাসিদের আবেগের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে বাস-মেট্রো-প্রাইভেট গাড়ির উপর।
রবিবার গভীর রাতে সাঁ দে মার্সের রাস্তায় যে ক’টা গাড়ি ওই জনঅরণ্য ঠেলে বেরোতে চেয়েছে, ভোগান্তি ছাড়া আর কিছু উপহার পায়নি। এক সমর্থক গাড়ির ছাদের উপর দিব্যি শুয়ে পড়লেন। গাড়ি গাড়ির মতো চলছে, তিনি তাঁর মতো! একটা দল আবার সোজা গাড়ির জানালা দিয়ে নিজেদের ভেতরে চালান করে দিল! সঙ্গে দড়াম-দড়াম শব্দে বনেটে থাপ্পড়, পাগলের মতো ‘লা মার্সেই’ গেয়ে যাওয়া। শুধু তাই নয়, দেশজ টিমের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে ফ্রান্সবাসী আরও একটা ধর্ম মেনে চলে। পায়েতদের খেলা যতক্ষণ চলে, এরা ক্রমাগত লাফায়। একটা গানও আছে ‘কুই নে সতে পাস নেস্ত ফ্রাঁসিয়াস।’ বাংলা করলে— তুমি যদি না লাফাও, তুমি তা হলে ভাই ফরাসিই না!
রবিবার রাতের আইফেল টাওয়ারে তারও ব্যতিক্রম ঘটতে দেখা যায়নি। তা হলে কোন যুক্তিতে বলা যায় যে, বরফ-মায়া শেষ করেও তাদের নিয়ে চোরা দুঃখে ভুগছে ফ্রান্স?
প্রশ্ন শুনে মাথা নাড়তে থাকেন সেই ‘তাবাক’ মালিক। বলেন যে, “আপনি জানেন না। আমি জানি। বললাম না, বন্ধুদের মেসেজ করছিলাম। ওরাও বলল, ফ্রান্স জেতায় অসম্ভব খুশি। কিন্তু আইসল্যান্ডের জন্যও দুঃখ হচ্ছে। স্কোরটা ২-১ হলে ভাল হত!”
এঁদের বক্তব্য, শিল্প-আবেগ-রূপকথার কদর ফ্রান্সের চেয়ে বেশি এই পৃথিবীতে কেউ কোথাও করে না। দেশের প্রতি ভালবাসা অটুট রেখেও প্রতিপক্ষ টিমের প্রতি তারা সেটা দেখাতে পারে। আইসল্যান্ডকে তাই ফ্রান্সের ভাল লেগেছিল। দেশ অর্ধেক ফাঁকা করে আইসল্যান্ড সমর্থকদের তিন সপ্তাহ ফ্রান্সে পড়ে থাকা, মাঠে তাদের ফুটবলের মায়াবী উপাখ্যান, তাদের প্রেসিডেন্টের কাজকর্ম বন্ধ রেখে শুধু ফুটবলের জন্য জীবন সমর্পণ— ভাল লেগেছিল ফ্রান্সের।
গত রাতে কাউকে কাউকে এমনও পাওয়া গেল, যারা জনতার উদ্দাম আবেগ দেখেও নিজেদের সংযত রাখতে চায়। ফুটবল-বিচারে। ভবিষ্যৎ মাথায় রেখে। ফুটবলের নামে সবুজ মাঠে পায়েতদের কবিতা লেখা দেখেও মনকে এরা প্রভাবিত হতে দেয় না। ফ্রান্সের কাগজে এ দিন সাঁ দেনি যুদ্ধের সাত-সাতটা গোল নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। বলা হয়েছে, ইউরোতে এত দিন লোকে গোল-প্রত্যাশায় বসে ছিল। জার্মানি, পর্তুগাল, স্পেন, ইংল্যান্ড কেউ যা পারেনি, সাঁ দেনি কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্স-আইসল্যান্ড তা করে দেখিয়েছে। আর একটা প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, ফুটবল-ধর্মে সমগ্র ফ্রান্সের দীক্ষা নেওয়া নিয়ে। উদ্বাস্তু সমস্যা থেকে জঙ্গিহানার যন্ত্রণা-দুঃখের উপকরণ তো কম ছিল না দেশটার। আঁতোয়া গ্রিজম্যান, তিনি এখন ফরাসিদের কাছে জাতীয় বীর। বছর দশেক আগের থিয়েরি অঁরি যেন! গ্রিজম্যানের ফুটবল যেমন সুন্দর, তাঁর ফুটবল-উন্নতির কাহিনিও সমান আকর্ষক। ভিডিও গেমস খেলে খেলে নাকি নিজের ফুটবল-চেতনার বৃদ্ধি ঘটিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু তার পরেও দেশের স্বপ্নজালে টুকরো ফাঁক থেকে যায়।
বিয়েন স্পোর্টস সাংবাদিক বা জনৈক ফ্রান্স সমর্থক যেমন। দু’জনেই বললেন, ষোলো বছর পর ইউরো সেমিফাইনাল হলেও এই টিমে ইউরোজয়ী জিদানদের টিমের ছায়া পর্যন্ত দেখছেন না। বললেন, “দু’টো প্রজন্ম আলাদা। তা ছাড়া জিদানদের টিম ফ্রান্সের ফুটবল ইতিহাসে আলাদা জায়গায় আছে। ইউরো কেন, রাশিয়া বিশ্বকাপ জিতলেও যেখানে পোগবাদের রাখা যাবে না।” শেষে ছোট্ট সংযোজন, “আগে তো আমরা জার্মানিকে হারাই। তার পর না এত কিছু!”
গলা ছেড়ে এর পর ‘আলে, লে ব্লু’ আর বলা যায় কি? বলা সম্ভব?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy