নিজের কেরিয়ারে হারা ম্যাচ জিতেছেন। আবার জেতা ম্যাচও নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে হেরে গিয়েছেন। তবে এ বারের ইউএস ওপেনে মহিলাদের সিঙ্গলস ফাইনালে যে টেনিস উপহার দিয়েছেন এরিনা সাবালেঙ্কা, তাতে এটুকু বোঝা গিয়েছে, তিনি আগের চেয়ে অনেক পরিণত। এখন আর খামখেয়ালি আচরণ করেন না। কোর্টে আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। শান্ত থাকতে পারেন। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে নিজের জীবনের এমনই বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন সাবালেঙ্কা।
জয় শেট্টির পডকাস্টে বিভিন্ন মেজাজে ধরা দিয়েছেন বেলারুসের খেলোয়াড়। নিজের দুর্বলতা নিয়ে প্রশ্ন করতে গেলেই যেমন বলেছেন, “শপিং। ওটাকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না।” তেমনই মেনে নিয়েছেন জীবনে শৃঙ্খলার চেয়ে বড় কিছু নেই।
চার বারের গ্র্যান্ড স্ল্যামজয়ীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল সাফল্যের মন্ত্র। সাবালেঙ্কা বলেছেন, “সাফল্যের আসল মন্ত্র হল শৃঙ্খলা। প্রতিদিন সকালে ওঠা, অনুশীলনে যাওয়া। তোমার কেমন লাগছে, তুমি যেতে চাইছ কি না, এ সব ভাবলে চলবেই না। কিছু কিছু দিন আসে যখন সকালে উঠে অনুশীলনে যেতে ইচ্ছা করে না। তবু যেতে হয়। যদি আপনি সেটা করতে পারেন তা হলে সাফল্য আসবেই। আপনি যে কাজটা করছেন সেটা যদি ভালবাসেন তা হলে সফল হওয়া আটকানো যাবে না। এই জন্যই আমি এতগুলো ট্রফি জিততে পেরেছি। অনেক দিন এমন হয়েছে যে শরীর খারাপ বলে অনুশীলনে যেতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু কিছু একটা তখন আমাকে ঠেলে নিয়ে যেত। তাই আমি বার বার বলি, মানুষের এমন কাজ করা উচিত যেটা সে ভালবাসে। তা হলেই আপনি নিজেকে ঠেলে তুলতে পারবেন, অনুপ্রাণিত করতে পারবেন।”
তা সত্ত্বেও কখনও সখনও নাড়া দেয় ব্যর্থতার ভাবনা। ইচ্ছা করে খেলা ছেড়ে দিতে। সাবালেঙ্কার মনেও কি এমন ভাবনা এসেছিল? বেলারুসের খেলোয়াড় বলেছেন, “অবশ্যই এসেছিল। বছর তিনেক আগের ঘটনা। বার বার ‘ডাবল ফল্ট’ করছিলাম। কিছুতেই ঠিক করে সার্ভ করতে পারছিলাম না। তা সত্ত্বেও কোনও ভাবে প্রথম দশে চলে এসেছিলাম। খেলা ছেড়ে দেওয়ার খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। বুঝতেই পারছিলাম না সমস্যাটা কী ভাবে ঠিক করব। মনোবিদের সাহায্য নিয়েছিলাম। একই অনুশীলন বার বার করছিলাম। কিছুতেই ঠিক হচ্ছিল না। ভেবেছিলাম, এ বার খেলাটা ছাড়তে হবে। তার পর একজনের সাহায্য নিয়ে সমস্যাটা ঠিক করি। আসলে সেই সময়ে শক্ত না থাকলে হত না। হাল না ছাড়া মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম। ঠিক তার পরেই প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতি। আসলে সবার জীবনেই এ রকম সময় আসে। সেই পেরিয়ে যাওয়ার মতো শক্তি রাখতে হয়।”
দলগত খেলাই হোক বা ব্যক্তিগত খেলা, অনেক ক্রীড়াবিদকেই দেখা যাক বিশেষ কোনও কাজে বিশ্বাস রাখতে। সাবালেঙ্কাও ব্যতিক্রম নন। দু’টি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। বলেছেন, “আমি গোটা প্রতিযোগিতায় একই প্রাতরাশ প্রতি দিন খাই। অ্যাভোক্যাডো টোস্ট, দু’দিকেই ভাজা দুটো ডিম। ওটা একদম ঠিক করে করতে হবে। আমি মাঝেমাঝেই বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে আয়োজকদের সমস্যায় ফেলেছি। ডিম ভাজা একদম নিখুঁত হওয়া চাই। এ ছাড়া স্মোকড স্যালমন খাই। এই প্রাতরাশ দারুণ লাগে। সব সময় চেষ্টা করি এটাই খেতে। আরও একটা ব্যাপার আছে, কোনও বল কিডের থেকে বল নেওয়ার পর যদি পয়েন্ট জিতি, তা হলে পরের সার্ভিসের আগে তার থেকেই বল নেওয়ার চেষ্টা করি। সে যে কোণেই দাঁড়িয়ে থাকুক না কেন। জানি না কেন এটা করি। বেশ ভাল লাগে। তবে এটা আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকলেই ভাল। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সমস্যা হয়ে যাবে।”
উঠে এসেছে সেরা প্রতিপক্ষের প্রসঙ্গও। জয় বলেন, “আমি নোভাককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মানসিক ভাবে কোন প্রতিপক্ষকে তোমার সবচেয়ে শক্তিশালী মনে হয়? সাবালেঙ্কা পাল্টা প্রশ্ন করেন, “নোভাক কার কথা বলল?” জয় বলেন, “নিজের কথাই বলেছে।” সাবালেঙ্কা হাসতে হাসতে বলেন, “তাই নাকি? তা হলে আমিও তো নিজের কথা বলতে পারি।” আবার হাসেন বেলারুসের খেলোয়াড়। পর ক্ষণেই সিরিয়াস হয়ে গিয়ে বলেন, “আসলে আমি এক-দু’জনের নাম করতে পারব না। প্রত্যেকেই আলাদা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। কারওকে নিয়ে বলাই যায়, ও সবচেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষ। তাতে বাকিদের অসম্মান করা হবে। তাই নোভাক একদম সঠিক উত্তর দিয়েছে।” এর পর জয় জানতে চান, শারীরিক ভাবে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ কে? সাবালেঙ্কার উত্তর, “কোকো গফ, ইগা শিয়নটেক। ওরা যে ভাবে নড়াচড়া করে, যে ভাবে প্রতিটা পয়েন্টের পিছনে দৌড়য়, প্রতিটা বলের জন্য নিজেকে তৈরি রাখে, তা অসাধারণ।”
টেনিস খেলাকে অনেকেই বলেন, খুব একাকীত্বের খেলা, যেখানে জিতলে সেই আনন্দ কারও সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জায়গা নেই। জয় এ প্রসঙ্গে তুলে আনেন ফর্মুলা ওয়ানের কথাও। সাবালেঙ্কা বলেন, “একা একা কোর্টে খেলতে হয় ঠিকই। কিন্তু প্রত্যেক টেনিস খেলোয়াড়ের পিছনে একটা দল থাকে। আমাকে মাথায় রাখতে হয় যে আমি একা নই, পিছনে একটা দল রয়েছে। যে পরিমাণ পরিশ্রম ওরা করে তাতে ওদেরও জয়টা প্রাপ্য। ওদের কথা ভেবে আমাকে জিততে হয়। তবে ফর্মুলা ওয়ান অনেকটাই আলাদা। আমি জানি না ওরা কী ভাবে লড়াই করে। প্রতিটা দৌড়ে নিজেদের জীবন বাজি রাখে। আমার কাছে ব্যাপার অসম সাহসের। আমাদের তবু খেলার মাঝে বিরতি থাকে। ওরা না জানি কত ক্ষণ ধরে গাড়ি চালায়। ওরা যদি এক সেকেন্ডের জন্য মনোযোগ হারায় তা হলেই সব শেষ।”
আরও পড়ুন:
সাক্ষাৎকারের শেষের দিকে সাবালেঙ্কাকে প্রশ্ন করা হয় তাঁর জীবনের সেরা তিনটি ম্যাচ নিয়ে। এমন ম্যাচ যা জীবন ঘুরিয়ে দিয়েছে। সাবালেঙ্কা প্রথমেই উল্লেখ করেন দু’বছর আগে ম্যাডিসন কিজ়ের বিরুদ্ধে ইউএস ওপেনের সেমিফাইনাল। ওই ম্যাচে সাবালেঙ্কা প্রথম সেটে ০-৬ উড়ে গেলেও পরের দু’টি সেট জেতেন টাইব্রেকারে। সেই ম্যাচকে বেছে নেওয়ার কারণ হিসাবে সাবালেঙ্কা বলেছেন, “১-৫ পিছিয়ে থাকার সময় মনে হয়েছিল, এখনও ফেরার সুযোগ রয়েছে। সেমিফাইনালে ওঠাই ছিল স্বপ্নের মতো। তাই কোনও ভাবেই হাল ছাড়লে চলত না।” দ্বিতীয় ম্যাচ হিসাবে উল্লেখ করেছেন প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার ম্যাচটি। ২০১৯-এ ইউএস ওপেন জিতেছিলেন সাবালেঙ্কা। তিনি বলেন, “মনের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল যে আমিও পারব। জীবনটা অপচয় করিনি।” তৃতীয় ম্যাচটির কথা মনেই করতে পারেননি সাবালেঙ্কা।