Advertisement
E-Paper

নতুনদের প্রতিষ্ঠা দিয়ে বাড়ছে বিরাট-সাম্রাজ্য

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:১৫
রায়ডু। ১১৮ বলে ১২১ নট আউট।

রায়ডু। ১১৮ বলে ১২১ নট আউট।

ক্রিকেট যাঁরা দেখেন না বা জানেন না, তাঁদের কাছে নিঃসন্দেহে এটা চরম অঘটন মনে হবে।

অ্যাঞ্জেলো ম্যাথেউজ যে টিমটা নিয়ে ভারতবর্ষে এসেছেন, তার এগারো জনের প্রয়োজন পড়বে না। তিন মহারথীই যথেষ্ট। আর মাহেলা জয়বর্ধনে, কুমার সঙ্গকারা এবং তিলকরত্নে দিলশানের সম্মিলিত ওয়ান ডে অভিজ্ঞতা খুঁজে বার করতে ক্রিকেট-পরিসংখ্যানবিদদের খুব খাটাখাটনিও করতে হবে না।

ওটা হাজারের উপর, সঠিক হিসেবে ১০৯৭ ম্যাচ!

বিরাট কোহলি বৃহস্পতিবারের মোদী-রাজ্যে যে টিমটা নিয়ে আবার নামলেন, তাদের অধিনায়ক সমেত অর্ধেক ক্রিকেটার স্কুলে যেতেন মাহেলা জয়বর্ধনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের দিনে। আর ওয়ান ডে অভিজ্ঞতায়?

তিন নয়, গোটা এগারোকে ধরতে হবে। আর তাতেও হাজারে পৌঁছনো যাবে না, আটকে যেতে হবে মাত্র ৭৭০ ম্যাচে!

মুশকিল হল, ক্রিকেটে স্কোরবোর্ডর মতো পরিসংখ্যানও কখনও কখনও ভ্রমাত্মক হয়ে থাকে। ভারতে আসা ম্যাথেউজের লঙ্কাও ব্যতিক্রম নয়। কখনওই সেটা বলবে না, চলতি সিরিজে একটা টিমকেই টিম দেখাচ্ছে। অন্য টিমটা নামে শ্রীলঙ্কা, কিন্তু ক্রিকেট-ধর্মে নয়। মাহেলাদের দেখে কোনও ভাবেই বিশ্বাস হবে না যে এই একই টিম ওয়াংখেড়ের বিশ্বকাপ ফাইনালে নেমেছিল বা ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টির বর্তমান মুকুট এদেরই কাছে। বরং মনে হবে, ছন্নছাড়া কিছু ব্যক্তির ভারত-ভ্রমণ, যাঁদের সমষ্টিতে রূপান্তর সম্ভব নয়। আর বিরাটের টিমকে ন্যূনতম প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছুড়ে দেওয়া আরওই নয়।

ভারত শুধু তো জিতছে না, ইচ্ছেমতো জিতছে। ক্যাপ্টেন কোহলি ‘মিশন বিশ্বকাপ’কে সামনে রেখে নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন এবং প্রতিপক্ষকে পিষছেন। দৃশ্যমান আমদাবাদ-জয়কে ধরেও বলতে হবে ভারত অধিনায়কের অদৃশ্য জয়গুলো অনেক বেশি গুরুত্বের, অনেক বেশি তাত্‌পর্যের।

পরিচিত ওয়ান ডাউনে বিরাট আর নামছেন না, এখন রেগুলার নাম্বার ফোর।

ওপেনিং স্লট যত দিন যাচ্ছে, প্রতিষ্ঠালাভ করছে। শিখর ধবন নিজেকে এমন শিখরে নিয়ে যাচ্ছেন যে, অস্ট্রেলিয়াগামী ফ্লাইটে সবার আগে তাঁর নামটা লিখতে হবে।

রবীন্দ্র জাডেজা ছাড়াও বাঁ হাতি স্পিনার-অলরাউন্ডার বার করে ফেলা। গোটা পাঁচেক ম্যাচ খেলতে না খেলতেই যে অক্ষর পটেলকে মাঝেমধ্যেই জাডেজার চেয়েও বেশি ঝকঝকে দেখাবে।

তিন নম্বরে এক-এক দিন, এক-এক জন। কটকে সুরেশ রায়না, মোদী-রাজ্যে অম্বাতি রায়ডু। প্রথম জনের অবদান ঝোড়ো হাফসেঞ্চুরি এবং ফিনিশিং টাচে টিমের স্কোরকে ৩৬২-র মগডালে তুলে দেওয়া। আর দ্বিতীয় জন? এত দিনের ৭২ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করে কী ভাবে জাতীয় দলের স্বপ্নে দেখেন— তাঁকে নিয়ে এমন কদর্য কটাক্ষ আজকের সেঞ্চুরির পর থেকে থেমে যাওয়া উচিত।

রাত সাড়ে আটটার মোতেরায় দেখা গেল, গ্যালারিতে হাজার-হাজার আলোকবিন্দু জ্বালিয়ে দিয়েছে কেউ! মোবাইল ক্যামেরার আলো আসলে ওগুলো, ভারতীয় দর্শকের অধুনা উত্‌সব-পালনের রীতি যা গিয়ে মিশছে সাবেকি মেক্সিকান ওয়েভের মোহনায়। গ্যালারি নাচছে, গাইছে, চিত্‌কার করছে, আতসবাজি ফাটছে স্টেডিয়ামের ঠিক বাইরে। উপকরণ তো আর একটা নয়, এক জোড়া।

প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যানের রানের সমুদ্রে প্রত্যাবর্তন। কটকের পর আবার। সঙ্গে নতুন দুইয়ের প্রতিষ্ঠালাভের দিকে এগিয়ে যাওয়া। যাঁদের এক জন আবার ঘরের ছেলে। প্রতিষ্ঠিত যিনি, তিনি অবশ্যই ধবন। আর প্রতিষ্ঠালাভের সিঁড়িতে উঠতে শুরু করলেন যে দু’জন, তাঁরা রায়ডু এবং অক্ষর।

আর বিশ্বকাপগামী টিমের প্রেক্ষিতকে ধরতে হলে প্রথম এবং শেষাক্ত জনের গুরুত্ব কিছুটা হলেও বেশি। রায়ডুর সেঞ্চুরির নিঃসন্দেহে মর্যাদা পাওয়া উচিত, শিরোনামে আসা উচিত। ক্রিকেটমহল তাঁকে নিয়ে আক্ষেপ করে, ছেলেটা যতটা প্রতিভাবান, প্রতিভার বিকাশ ঠিক ততটা ঘটে না। ১১৮ বলে ১২১ নট আউট সেই ক্ষতে প্রলেপ দেবে ঠিকই, কিন্তু বিশ্বকাপ মিডল অর্ডারে তাঁকে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলার জন্য কোনও এক রোহিত শর্মা বসে থাকবেন। সে দিক থেকে দেখলে ধবনের ক্রমাগত রানে থাকা গুরুত্বে এগিয়ে। সাম্প্রতিকে শুরু থেকেই বোলারদের নিয়মিত ‘চড়-থাপ্পড়ে’ যাচ্ছেন না জাঠ সিংহ। গোটা চল্লিশেক বল দেখছেন, তার পর ওসবে যাচ্ছেন। প্রতিপক্ষ বোলারকে যেন বুঝিয়ে দেওয়া ‘ওই চল্লিশ বল তোমার, না পারলে বাকিটা আমার!’ কটকে সেঞ্চুরির পর এ দিন ৭৯। একটা সময় ধামিকা প্রসাদ-সূরয রণদীভদের এমন মারলেন যে, দেশে ফিরে তাঁদের না ‘কাউন্সেলিং’য়ে বসতে হয়!

এবং অক্ষর রাজেশভাই পটেল।

দুপুরে আমদাবাদ প্রেসবক্সে কোনও কোনও শ্রীলঙ্কা সাংবাদিক আক্ষেপ করছিলেন যে, একটা বাচ্চা বাঁ-হাতি স্পিনারও এখন সঙ্গা-দিলশানকে নাকানিচোবানি খাওয়াচ্ছে। দিলশানকে বোল্ড করছে। গুজরাত ক্রিকেট কর্তারা তখন ততোধিক ঊর্ধ্ববাহু। উল্টো দিকে সঙ্গকারা-জয়বর্ধনের নাম থাকলে বাঘা স্পিনারেরও যেখানে ঘুম উড়ে যায়, সেখানে নাদিয়াদের বাঁ-হাতি স্পিনার এতটা নির্লিপ্ত! শোনা গেল, এই গুণ নাকি তাঁর জন্মগত। আর উত্থানের কাহিনিও ততটাই আশ্চর্য। ছোটবেলায় ব্যাট-বল সঙ্গে নিয়ে ঘুমোতে যেতেন, শীর্ণকায় ছিলেন বলে বাবা রাজেশভাই পটেল ছেলেকে ভর্তি করেছিলেন জিমে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেখানে যেতে হত। প্রথম স্কুল ক্যাম্পে রাজেশের ছেলেকে পাঠানোর প্রথম শর্ত ছিল যে, খেলুক না খেলুক দৌড় এমন করাতে হবে যাতে বাড়ি ফিরে ছেলে যেন শুধু ঘুমোয়। কোচের ডাকে যখন-তখন নামতে হত, জীবনে নাকি নিজস্ব এজ গ্রুপেও খেলেননি অক্ষর। সব সময় বড়দের সঙ্গে। উনিশ বছরে রঞ্জি ক্যাম্পে ঢুকেছেন। তাই বোধহয় দিলশান-সঙ্গাদের মতো ক্রিকেট-পৃথিবীর ‘বড়দা’দের সামলাতে অসুবিধে হয় না।

টিভির মাধ্যমে গোটা ভারত তো দেখল যে, দেশ আরও এক বাঁ-হাতি স্পিনারকে পেয়ে গিয়েছে। যে কি না একটানা ইয়র্ক লেংথে ফেলে যেতে পারেন, বৈচিত্রে না গিয়ে। যাঁকে মারা ব্যাটিং-মহারথীদের পক্ষেও দুঃসাধ্য হয়, ওয়ান ডে-তে ওভার পিছু চারের বেশি দেন না। পাওয়ার প্লে-তেও না। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে বাঁ হাতি স্পিনারের প্রয়োজনীয়তা কী, সবাই জানে। সেখানে অক্ষরের ১০-১-৩৯-২-র কৃপণ হিসেব নির্বাচকদের নিঃসন্দেহে অক্সিজেন দেবে।

ভারত একই দিনে আরও একটা ব্যাপার দেখল। দেখল, কটকে ১৬৯ রানে জয়ের পর আমদাবাদে ২৭৪ তাড়া করে জয় পাঁচ ওভার বাকি রেখে, একের পর খুব সহজেই ২-০। পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমাঞ্চল জয় শেষে টিম ইন্ডিয়া ঢুকছে এ বার দাক্ষিণাত্য জয়ের মোক্ষ নিয়ে।

ক্যাপ্টেন কোহলির সাম্রাজ্য কিন্তু ধীরে ধীরে বিস্তৃত হচ্ছে।

সংক্ষিপ্ত স্কোর

শ্রীলঙ্কা ২৭৪-৮ (অ্যাঞ্জেলো ম্যাথেউজ ৯২ ন.আ, সঙ্গকারা ৬১, দিলশান ৩৫। অক্ষর পটেল ২-৩৯)।

ভারত ২৭৫-৪ (রায়ডু ১২১ ন.আ, ধবন ৭৯, কোহলি ৪৯)।

rajarshi gangopadhyay Virat Kohli
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy