Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

হকিতেও দরকার সিন্ধু-ঝলক

ধ্যানচাঁদের ছেলে। ভারতের একমাত্র হকি বিশ্বকাপ খেতাব জয়ের গোল তাঁরই। রিওতে সৃজেশদের ব্যর্থতা আর ওষুধ নিয়ে লিখলেন শুধু আনন্দবাজারে। সে দিন রিওর হকি ফাইনাল টিভিতে দেখছিলাম। বেলজিয়ামকে হারিয়ে প্রথম লাতিন আমেরিকান দেশ হিসেবে আর্জেন্তিনা যে অলিম্পিক্সে হকির সোনা জিতল, অনেকেই হয়তো খেয়াল করেননি। চার বছর আগেও অলিম্পিক্সে ওরা পদক তো দূরে থাক, শেষের দিকে থেকেছে।

রিও থেকে ভারতীয় হকির অন্যতম ‘প্রাপ্তি’। বোল্টের সঙ্গে সেলফি টুইটারে পোস্ট করলেন অধিনায়ক সৃজেশ।

রিও থেকে ভারতীয় হকির অন্যতম ‘প্রাপ্তি’। বোল্টের সঙ্গে সেলফি টুইটারে পোস্ট করলেন অধিনায়ক সৃজেশ।

অশোক কুমার ধ্যানচাঁদ
ভোপাল শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৬ ০৩:৪১
Share: Save:

সে দিন রিওর হকি ফাইনাল টিভিতে দেখছিলাম। বেলজিয়ামকে হারিয়ে প্রথম লাতিন আমেরিকান দেশ হিসেবে আর্জেন্তিনা যে অলিম্পিক্সে হকির সোনা জিতল, অনেকেই হয়তো খেয়াল করেননি। চার বছর আগেও অলিম্পিক্সে ওরা পদক তো দূরে থাক, শেষের দিকে থেকেছে। ২০০৮-এ কোয়ালিফাই-ই করেনি। রিওতে রুপোজয়ী বেলজিয়ামেরও হকিতে প্রথম পদক। জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডসকে পিছনে ফেলে তা হলে বিশ্ব হকিতে নতুন সাম্রাজ্যের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে!

আট নম্বরে শেষ করা ভারতীয় দল হয়তো ভেবে স্বস্তি পাবে— আমরা সোনা পাইনি ঠিকই কিন্তু হেভিওয়েটরাও তো পেল না! কিন্তু সর্দার-অল্টমান্সদের আসলে ভাবা দরকার, আট বছর আগে বেজিং অলিম্পিক্সে ভারতও কোয়ালিফাই করেনি। তার পরে দু’টো অলিম্পিক্সে আমাদের জায়গা বারো আর আট নম্বরে। অথচ একই পরিস্থিতি থেকে আর্জেন্তিনা চ্যাম্পিয়ন! হকির তেমন কোনও উজ্জ্বল ইতিহাস না থাকা আর্জেন্তিনা যদি পারে, সেটাও আবার দেশজ কোচের হাত ধরে, তা হলে আটবারের অলিম্পিক্স চ্যাম্পিয়ন ভারত রিওতে উঠে দাঁড়াতে পারল না কেন? সৃজেশদের সান্ত্বনা, রিওতে ওরা গ্রুপ ম্যাচে আর্জেন্তিনাকে হারিয়েছে! তবে সে তো আমরা যখন পঁচাত্তরে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছি, গ্রুপে আর্জেন্তিনার কাছে হেরেছিলাম।

কিন্তু সেটা নিছক কাকতালীয়। অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস, জার্মানির রিওতে খারাপ রেজাল্টের কারণ, তিন দলেরই অ্যাভারেজ বয়স বেশি। বিশেষ করে এখনকার আন্তর্জাতিক হকির প্রচণ্ড গতির তুলনায়। স্পিডে মার খেয়েছে ওরা। স্কিলের দিক দিয়ে খুব বেশি পিছিয়ে না থাকা সত্ত্বেও। তুলনায় ভারতীয় দল পিছিয়ে ছিল স্কিলে। বিশেষ করে আমাদের ফরোয়ার্ডরা। কো-অর্ডিনেশন থেকে শুরু করে বল হোল্ডিং, পজিশন জ্ঞান, ড্রিবলিং ক্ষমতা, পাসিং— সবেতে কমা। হকিতে অ্যাটাকের সময় যে একটা স্পার্কের দরকার হয়, যেটা হকির যাদুকর আমার বাবা থেকে শুরু করে শ্রদ্ধেয় বলবীর সিংহ সিনিয়র হয়ে সদ্য আমাদের ছেড়ে যাওয়া মহম্মদ শাহিদের খেলায় ছিল, এখনকার ছেলেদের নেই। হকি যতই আধুনিক হোক, খেলাটার আসল কথা হল, ওয়ান-টু-ওয়ানে তুমি ড্রিবল করে সামনে এগিয়ে যেতে পারলে কি না। এই দলের খেলায় সেটা কোথায়?

ভাগ্যিস রিওতে আমাদের ডিফেন্স ভাল খেলেছে। নইলে আরও খারাপ রেজাল্ট হত। ফরোয়ার্ডদের ব্যর্থতার মলম হতে পারত যদি ছেলেদের পেনাল্টি কর্নার থেকে গোল করার পার্সেন্টেজ আশি শতাংশ থাকত। কিন্তু ছিল মেরেকেটে তিরিশ শতাংশ। পদক আসবে কী করে! কিন্তু চার বছর পরে টোকিওতে বাঁচালে পেনাল্টি কর্নারই বাঁচাতে পারে ভারতকে।

তত দিনে সর্দার-রঘুনাথের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলার বয়স, ফিটনেস থাকবে না। ফলে ভাল নতুন মুখের দরকার। কিন্তু এ দেশের হকির পরিকাঠামোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ভাল নতুন মুখের সন্ধান খুব বেশি নেই। বিশেষ করে ফরোয়ার্ড লাইনে। সে জন্য আরও বেশি করে সেরা মানের ড্র্যাগ ফ্লিকার তুলে আনা দরকার। পেনাল্টি কর্নার পেলেই যাতে গোল তুলে নেওয়া যায়। আর্জেন্তিনার সোনা জয়ের পিছনে কিন্তু পেনাল্টি কর্নার থেকে গোলের অবদান প্রচুর।

আমাদের সে জন্য দেশে আরও অনেক অ্যাস্ট্রোটার্ফের স্টেডিয়াম, প্র্যাকটিস এরিনা দরকার। দেশে এখন হকির অ্যাস্ট্রোটার্ফ সব মিলিয়ে গোটা পঞ্চাশ। কিন্তু কয়েকটা রাজ্যে ভীষণ কম। যেমন মধ্যপ্রদেশের মতো বড় রাজ্যে আছে মাত্র ছ’টা। আরও অন্তত ষোলোটা পেলে ভাল হয়। যাতে সকাল-বিকেল ছেলেরা পেনাল্টি কর্নার প্র্যাকটিস করতে পারে। বিশ্বমানের ড্র্যাগ ফ্লিক মারতে গেলে দিনে এক হাজার বার মারা দরকার। পাকিস্তানের সোহেল আব্বাস, নেদারল্যান্ডসের টাইজ ক্রুজ যা করত।

দরকার খুব ভাল অবজার্ভার টিম। দেশ জুড়ে খুঁজে যারা সত্যিকারের প্রতিভা তুলে আনবে। প্রাক্তন প্লেয়ারের সঙ্গে ট্রেনার, ফিজিওদেরও রাখা দরকার অবজার্ভার দলে। যাতে স্পট করার সময়ই সেই তরুণ প্রতিভার স্কিলের পাশাপাশি শক্তি, ফিটনেস যাচাই করে নেওয়া যায়। অনেক প্রতিভা ফিটনেসের অভাবে অকালে নষ্ট হয়ে যায়। গোড়াতেই সেটা বুঝে ফেলা দরকার। নইলে সব পরিশ্রম পণ্ড। দেশের হকিরও ক্ষতি।

ভারতীয় হকি দল বিদেশ সফরে যায় না, ভাল এক্সপোজার পায় না— মোটেই নয়। তবে আরও বেশি সফর দরকার বিশ্ব হকির শক্তিশালী দেশগুলোতে। নিয়মিত টেস্ট সিরিজ খেলা উচিত। যাতে আধুনিক হকির সমস্ত কারিকুরির সঙ্গে আমাদের ছেলেরা রপ্ত থাকতে পারে। ফি-বছর হকি ইন্ডিয়া লিগে অনেক বিদেশি প্লেয়ার খেলতে আসে। কিন্তু ওই দু-পাঁচটা মাত্র বিদেশির পাশে খেলে, ড্রেসিংরুম শেয়ার করে লাভ নেই। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ খেলে ছেলেদের পকেট ভরছে, খেলার স্ট্যান্ডার্ড নয়।

তবে হকি দলে আসল দরকার স্পার্ক। যে স্পার্কটা রিওতে সিন্ধুর খেলায় ছিল। অলিম্পিক্সে পদক জিততে ওটার ভীষণ দরকার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

hockey team India Rio Olympics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE