বৃহস্পতিবার বিকেলে ফিফা র্যাঙ্কিং প্রকাশিত হওয়ার পরে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভারত দু’ধাপ নেমে ১০৩ নম্বরে রয়েছে। জর্ডন, ভিয়েতনাম, আর্মেনিয়া, সাইপ্রাস, এস্তোনিয়ার মতো দেশগুলো র্যাঙ্কিংয়ে আমাদের চেয়ে এগিয়ে। অথচ ভারতের জনসংখ্যা ওদের চেয়ে অনেক বেশি।
ভারত পিছিয়ে যাওয়ার জন্য অনেকেই কোচ ইগর স্তিমাচকে কাঠগড়ায় তুলছেন। বলছেন, দায়িত্ব নেওয়ার পরে যে দু’টো টুর্নামেন্টে খেলেছে সুনীলেরা, চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছে। তা হলে এত হাই প্রোফাইল কোচ এনে কী লাভ হল? সমস্যাটা কিন্তু ইগরকে নিয়ে নয়। ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ভারতের পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ, আমাদের পরিকাঠামো। ফুটবলার তুলে আনতে না পারলে কখনও উন্নতি সম্ভব নয়। ফুটবলার পণ্য নয় যে বাজারে গিয়ে পছন্দ মতো কিনে আনা যায়। ফুটবলার তৈরি করতে হয়। তার জন্য দরকার অ্যাকাডেমির।
ভারতীয় ফুটবলের উন্নতি কী ভাবে সম্ভব তা নিয়ে আলোচনা করতে বছর দু’য়েক আগে সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে বসেছিলাম। আমার প্রস্তাব ছিল, দেশের সব রাজ্যে আবাসিক ফুটবল অ্যাকাডেমি গড়ে তুলতে হবে। আমি অনুরোধ করেছিলাম, তৎকালীন ক্রীড়ামন্ত্রী রাজ্যবর্ধন সিংহ রাঠৌরের সঙ্গে যেন ফেডারেশন কর্তারা দেখা করেন। তাঁকে অনুরোধ করেন দেশের সব রাজ্যে ফুটবল অ্যাকাডেমি গড়ে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে। তার পরে কী হল জানি না।
কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে অনুরোধ করার পিছনে আমার একটা উদ্দেশ্য ছিল। উনি নিজেও ক্রীড়াবিদ। আথেন্স অলিম্পিক্সে শুটিংয়ে রুপো পেয়েছিলেন। দেশের হয়ে পদক জেতা কতটা গৌরবের তা খুব ভাল জানেন। তা ছাড়া সেই সময়ে অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ সবে শেষ হয়েছে। দেশ জুড়ে ফুটবল নিয়ে প্রবল উন্মাদনা। আমাদের উচিত ছিল সুযোগটা কাজে লাগানো।
আমাদের দেশে ২৯টি রাজ্য ও সাতটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল। সব মিলিয়ে ৩৬টি। সব জায়গায় অ্যাকাডেমি গড়তে হবে। অনূর্ধ্ব-১৪, ১৬ ও ১৮ বিভাগে ৩০ জন করে ফুটবলার নিতে হবে। প্রত্যেকটা অ্যাকাডেমি থেকে যদি এক জন করেও ফুটবলার উঠে আসে তা হলেও সংখ্যাটা কম নয়। অথচ এখনও বাংলা, গোয়া, কেরল, পঞ্জাব ও উত্তরপূর্ব ভারতের কয়েকটি রাজ্য ছাড়া সে ভাবে অ্যাকাডেমি গড়ে ওঠেনি। অনেকে যুক্তি দিয়েছিলেন, অনেক রাজ্যে ফুটবল নিয়ে কোনও আগ্রহই নেই। তা হলে সেখানে অ্যাকাডেমি করে কী হবে? সাধারণ মানুষকে ফুটবলের প্রতি আকর্ষিত করার দায়িত্বটা আমাদের। প্রয়োজনে আই এম বিজয়ন, ভাইচুং ভুটিয়া, সুনীল ছেত্রীদের নিয়ে যেতে হবে। যুক্ত করতে হবে প্রাক্তন তারকাদেরও। সবাইকে বোঝাতে হবে, ফুটবল খেলেও প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়।
অনেকেরই ধারণা, আইএসএল ও আই লিগের মাধ্যমেই ফুটবলের উন্নতি সম্ভব। আমি তাঁদের সঙ্গে একমত নই। আইএসএল ও আই লিগের ক্লাবগুলোয় বিদেশি ফুটবলারদের প্রাধান্যই বেশি। আমাদের দেশের ছেলেরা কোথায় সে ভাবে খেলার সুযোগ পায়? একটা দেশ ফুটবলে এগোচ্ছে কি না, নির্ভর করে জাতীয় দলের সাফল্যের উপরে। ঘরোয়া লিগ কতটা জনপ্রিয় তা দিয়ে নয়।
ইগর যখন কোচ হওয়ার ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলেন, তখন ওঁর সঙ্গে ফুটবলের উন্নতি নিয়ে দীর্ঘ ক্ষণ আলোচনা করেছি। ইগর শুনিয়েছিলেন, ক্রোয়েশিয়া ফুটবলের উত্থানের কাহিনি। বলেছিলেন, একদম শিশুদের কোনও ট্রেনিং দেওয়া হয় না। প্রথম লক্ষ্য থাকে ফুটবলের প্রতি ওদের ভালবাসা তৈরি করা। যাদের মধ্যে সম্ভাবনা রয়েছে, তাদের বেছে নেওয়া হয় প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। এ ছাড়া বিভিন্ন ক্লাবের স্কাউটেরা প্রতিভা অন্বেষণে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ান।
ভারতেও এই ধরনের পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। তবে শুধু অ্যাকাডেমি গড়লেই হবে না, ঠিক মতো পরিচালনাও করতে হবে। খেলাধুলোর পাশাপাশি ফুটবলারদের লেখাপড়ার দায়িত্বও নিতে হবে অ্যাকাডেমিকে। এর জন্য বেশি খরচও হওয়ার কথা নয়। ফুটবলার যদি আমরা তুলে আনতে না পারি। তা হলে এ ভাবেই পিছিয়েই পড়ব।